রমজান মাসে হৃদরোগীদের করণীয়

8

অধ্যাপক ডা. মো. মাহবুবুর রহমান বাবু

ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা রোজা পালনে বিরত থাকতে চায় না। আর তাই হৃদরোগীরাও প্রায়ই চিকিৎসকের কাছে প্রশ্ন রাখে তারা রোজা রাখতে পারবে কি না।
সাধারণত হৃদরোগীদের কাছ থেকে রমজানবিষয়ক যেসব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়—
হৃদরোগীদের জন্য রোজা পালন নিরাপদ কি না?
রোজার মাসে হৃদরোগীদের কী কী খাবার খাওয়া উচিত বা উচিত নয়, পানি কতটুকু খেতে হবে?
রমজান মাসে ব্যায়াম কিভাবে করা উচিত?
রমজান মাসে ওষুধ খাওয়ার নিয়ম।
রমজান মাসে ঘুমের নিয়ম।
এসব প্রসঙ্গে প্রথমে যে কথাটি বলতে হয় তা হলো, একজন হৃদরোগী রোজা রাখতে পারবে কি না, তা একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী ঠিক করা উচিত। রমজান মাসের আগেই এ জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীকে রোজা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। এমনিতে একজন হৃদরোগী, যে সুস্থ আবস্থায় এবং কোনো খারাপ উপসর্গ ছাড়া আছে সে রোজা রাখতে পারবে। বরং অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা রমজান মাসে সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও নিয়ম-কানুন মেনে রোজা পালন করে, সেসব হৃদরোগীর এসংক্রান্ত জটিলতা কম হয়।
তবে কেউ যদি নিচের উপসর্গগুলোর মধ্যে কোনো একটি অনুভব করে, তবে তার স্বাভাবিক রুটিনে ফিরে যেতে হবে এবং অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে:
গোড়ালিতে তরল জমা হয়।
শ্বাসকষ্ট ও ক্লান্তি।
স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি প্রস্রাব করা।
মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
দ্রæত হৃদস্পন্দন বা বুকে ধাক্কা।
বুকে ব্যথা বা চাপ।
স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য গ্রহণ
রমজান মাসে স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। সাহরির সময় (ভোরের আগের খাবার), এমন খাবার খাওয়া উচিত যা সহজে হজম হয় এবং যা থেকে ধীরে ধীরে ক্যালরি অবমুক্ত হয়। উচ্চ ফাইবার খাবার এ সময় আমাদের জন্য উপকারী এবং এগুলো আমাদের হজমশক্তিকে ভালো রাখতেও সাহায্য করবে।
যেমন: শস্যজাত খাবার, ঢেঁকিছাঁটা চালের ভাত, রুটি, ওটস ইত্যাদি। ঐতিহ্যগতভাবে অনেক মুসলিম পানির সঙ্গে খেজুর খেয়ে তাদের রোজা শুরু করে, যার মধ্যে থাকা প্রাকৃতিক শর্করা থেকে ফাইবার ও শক্তি পাওয়া যায়।
ধীরে ধীরে হজম হওয়া কার্বোহাইড্রেটগুলো অন্তর্ভুক্ত করে আপনার সন্ধ্যার খাবারকে পূর্ণ করুন। প্রচুর ফল, শাক-সবজি এবং কিছু চর্বিযুক্ত বা কম চর্বিযুক্ত প্রোটিন অন্তর্ভুক্ত করুন। আপনার খাবার ভাজাপোড়ার পরিবর্তে বেক করুন বা গ্রিল করুন।
চর্বি ও চিনিযুক্ত খাবার সীমিত করুন, যাতে রমজানে আপনার অনিচ্ছাকৃতভাবে ওজন না বেড়ে যায়। প্রোটিনের উৎস হিসেবে লাল মাংসের পরিবর্তে মাছ খাওয়া ভালো। এ ছাড়া দুধ ও ডিম প্রোটিন ও প্রয়োজনীয় চর্বির ভালো উৎস হতে পারে। ইফতার ও সাহরিতে প্রচুর চিনিমুক্ত পানীয় যেমন: পানি বা চিনিমুক্ত স্কোয়াশ পান করুন, যাতে আপনি পানিশূন্য না হন। এ ছাড়া লবণ ও নোনতা খাবার এড়ানোর চেষ্টা করুন, যা আপনাকে তৃষ্ণার্ত করে তুলতে পারে, একই সঙ্গে আপনার রক্তচাপের জন্যও ভালো নয়।
ইফতারিতে নোনতা, মসলাদার খাবার ও চিনিযুক্ত পানীয় যা তৃষ্ণার উদ্রেক করে তা এড়িয়ে চলা উচিত। হার্টের সুস্বাস্থ্যের জন্য সমভাবে মিষ্টি, পেস্ট্রি, সিরাপযুক্ত মিষ্টি এবং অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার এড়ানোও অপরিহার্য। চা, কফিও কম খাওয়া উচিত। কারণ এগুলো প্রস্রাবের মাত্রা বাড়িয়ে পানিশূন্যতা ঘটাতে পারে।
ইফতারির সময় দ্রæত অনেক কিছু খেয়ে ফেলা ঠিক নয়। প্রথমে খেজুর বা অন্য যেকোনো ফলমূল আর পানি খেয়ে রোজা ভেঙে নামাজ আদায় করতে হবে। এরপর ধীরে ধীরে অন্য খাদ্য গ্রহণ করা যেতে পারে। এতে সার্বিক সুস্থতা ও হজমশক্তি ভালো থাকে। কখনোই পেট বোঝাই করে খাওয়া ঠিক নয়। কারণ এতে হঠাৎ হার্টের ওপর চাপ পড়ে। এভাবে ওজন বৃদ্ধিরও আশঙ্কা থাকে।
ইফতারি ও সাহরির মধ্যে আমাদের আবহাওয়া অনুসারে ২ থেকে ২.৫ লিটার পানি খাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। যদি পানির ভারসাম্য উপেক্ষা করা হয়, তাহলে হার্টের ওপর কাজের চাপ বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে রোগীর অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, হার্ট অ্যাটাক ও হাইপোভোলেমিয়ার (শরীরের ডিহাইড্রেশন) কারণে মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটতে পারে। কারো হার্টের চিকিৎসার অংশ হিসেবে যদি তরল সীমিত করার জন্য পরামর্শ দেওয়া থাকে, তবে রোজার আগেই সে বিষয়ে চিকিৎসকের কাছ থেকে স্পষ্ট ধারণা নিয়ে নিতে হবে।
কোন সময় কোন ওষুধ খেতে হবে, সে সম্পর্কে সঠিক ব্যবস্থাপত্র নিয়ে নিতে হবে। খালি পেটের ওষুধগুলো রোজা ভাঙার সময় খেয়ে ফেলতে হবে। সাধারণত এক বা দুই বেলা খেতে হয় এমন ওষুধ দেওয়া উচিত। ডায়াবেটিসের ওষুধের ক্ষেত্রে সাধারণত সকালের ডোজ ইফতারির সময় এবং রাতের ডোজ সাহরির সময় খেতে হয় বা নিতে হয়। অন্যান্য ওষুধের সময়কাল সচরাচর অপরিবর্তিত থাকে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধের সময়কাল পরিবর্তন করা বা বাদ দেওয়া একেবারেই উচিত নয়।
ব্যায়াম করার ক্ষেত্রে সময়কাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভুল সময়ে করা শারীরিক কার্যকলাপ এরই মধ্যে ডিহাইড্রেটেড ব্যক্তির হার্টের ওপর ভার আরো বাড়িয়ে দিতে পারে, যার ফলে অবাঞ্ছিত পরিণতি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এবং হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। তাই যাঁরা ব্যায়াম করতে চান তাঁরা ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে ইফতার করার ঘণ্টা দুয়েক পরে ৩০ মিনিট হাঁটতে পারেন। তবে কোনো সমস্যা অনুভব করলে, অতিরিক্ত দুর্বল লাগলে, অতিরিক্ত ঘাম হলে, বুকে ব্যথা বা শ্বাসকষ্ট হলে ব্যায়াম করা থেকে বিরত থাকা উচিত।
হৃদরোগীদের জন্য পর্যাপ্ত ঘুম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বল্প নিদ্রা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হার্টের কাজের চাপ বাড়িয়ে দেয় এবং হৃদরোগজনিত জটিলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। ইফতারের পর এবং সাহরির আগে রাতে অন্তত চার ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন ঘুম, সাহরির পর আরো কয়েক ঘণ্টা ঘুম এবং দিনে ২০ মিনিটের ছোট ঘুম হৃদরোগীদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী। তবে খাওয়ার পরপরই বিছানায় যাওয়া ঠিক নয়।
সর্বোপরি হৃদরোগীদের মনে রাখতে হবে, তাদের সামান্যতম লক্ষণও অবহেলা করার উপায় নেই। সুস্বাস্থ্যের নিয়ম পালন এবং যথাসময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণই পারে তাদের সুস্থ জীবনযাপন নিশ্চিত করতে।