গরিবের চোখে-মুখেও থাকুক হাসির ঝিলিক

7

আ ব ম খোরশিদ আলম খান

একমাস সিয়াম সাধনা শেষে আসছে অনাবিল হাসি-আনন্দের ঈদ। এখন থেকেই ঘরে ঘরে শুরু হয়েছে ঈদের আমেজ। শাওয়াল মাসের ঈদের চাঁদ উদিত হওয়ার অপেক্ষায় আছেন দেশের সর্বস্তরের মুসলিম জনতা। ঈদের আনন্দে শামিল হতে রোজার মাসের শুরু থেকেই বিত্তবানরা নানা ধরনের কেনাকাটায় ব্যস্ত আছেন। একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, মুসলমান সম্প্রদায়ের কাছে রোজা ও ঈদ ত্যাগ ও আত্মসংযমের বার্তা নিয়ে এলেও ঘরে ঘরে ঈদের খুশি, রোজার ব্যতিক্রমী অনুভ‚তি সবাইকে স্পর্শ করে বলে মনে হয় না। মানুষে মানুষে মেলাতে, একে অপরের সাথে মানবিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার যে বার্তা ও আহবান নিয়ে রোজা এবং ঈদ আসে বছর ঘুরে, তা সবাই সমভাবে উপভোগ-উপলব্ধি করতে পারে জোর দিয়ে এই দাবি করা যায় না। বরং এই রোজা ও ঈদ গরিব, ভাগ্যবিড়ম্বিত, অভাবী মানুষের জন্য অনেক সময় বিষাদতুল্য ঠেকে এক শ্রেণীর বিত্তবানদের ভোগবাদী জীবনদৃষ্টির কারণেই। ঈদ মানে সর্বজনীন আনন্দোৎসব। ত্যাগ ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে পরিচ্ছন্ন জীবনবোধে সমৃদ্ধ হওয়ার প্রেরণার নামই রোজা। অথচ এই গরিব দেশে চারপাশে আমরা কী দেখছি? ত্যাগ ছেড়ে, আত্মশুদ্ধির পথ ছেড়ে বস্তুমোহে, বিলাসী জীবনে গা ভাসিয়ে দেওয়ার মহোৎসব যেন চলে রোজা-ঈদ মৌসুমে। লোডশেডিং যন্ত্রণায় দেশের মানুষের আজ হাঁসফাঁস অবস্থা। সারাদিনে দেশের বহু জায়গায় ৩/৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। যে কারণেই হোক বিদ্যুৎ সংকটে শহর-গ্রামের নাগরিক জীবন আজ কাহিল। অথচ শহরগুলোতে মার্কেটে-মার্কেটে চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা এতো বিধিনিষেধ সত্তে¡ও থামানো যায় নি। একটি গ্রামের ১০ হাজার মানুষের জন্য চাহিদার সমুদয় বিদ্যুৎ একটি মাত্র বহুতল মার্কেটের আলোকসজ্জা মেটাতে অবলীলায় হজম করে ফেলা হচ্ছে। মার্কেটগুলোর বিদ্যুৎ-জৌলুসের মাশুল গুনতে হচ্ছে হাজার হাজার বিদ্যুৎ গ্রাহককে। অনেকেই রয়েছে গভীর অন্ধকারে, অপরদিকে মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী বিদ্যুতের সীমাহীন অপচয়ে ভোগমত্ততায় দিন কাটাচ্ছে নিশ্চিন্তে। রোজা ও ঈদের আনন্দ মুষ্টিমেয় ভাগ্যবান বিত্তবানরাই দু’হাতে লুফে নিচ্ছে। এ কেমন ত্যাগ, এটাই সংযম আমাদের?
হিজরতের অব্যবহতি পর হতেই ঈদুল ফিতর উৎসব পালন শুরু হয়। উল্লেখিত ‘নওরোজ’ ও ‘মিহিরজান’ উৎসব দুটির রীতিনীতি, আচার ব্যবহার ছিল সম্পূর্ণরূপে ইসলাম পরিপন্থী। শ্রেণী বৈষম্য, ধর্ম ও দরিদ্রের মধ্যে কৃত্রিম পার্থক্য, ঐশ্বর্য অহমিকা ও অশালীনতার পূর্ণ প্রকাশে অযাচিতরূপে দীপ্ত ছিল এ দু’টি উৎসব। কিন্তু ঈদুল ফিতর ঘোষিত হবার পর আগের সমস্ত অরুচিকর আচার অনুষ্ঠান বদলে গিয়ে ঈদ যথার্থভাবে কাক্সিক্ষত নির্মল আনন্দে রূপ নেয়। এই মহান পুণ্য দিবসের উদ্যাপন শুরু হয় আজ থেকে ১৪০১ বছর পূর্বে। এটি অবশ্য সূর্য ভিত্তিক গ্রেগরিয়ান বা ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী হিসাব। চন্দ্রভিত্তিক আরবি হিজরি বর্ষপঞ্জির হিসাব অনুযায়ী এটি হবে প্রায় ১৪৪৪ বছর পূর্বে। মূলত মুসলমানগণ ঈদুল আজহার চেয়ে ঈদুল ফিতরেই বেশি আনন্দ উৎসব করে থাকে। এই দিনটি নারী-পুরুষ, ধনী-গরিব, আশরাফ-আতরাফ সকলেই এক অনাবিল আনন্দের স্রোতে ভাসিয়ে দেয়। সকলেই এক মাঠে নামাজ পড়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
সবার দ্বার থাকে অবারিত। ধনীরা সাদকাতুল ফিতর এর মাধ্যমে নিঃস্ব ও বঞ্চিতকেও তাদের আনন্দের ধারায় শামিল করে নেয়। আমাদের দেশে এই দিনটিতে সকলেই সামর্থ্য অনুযায়ী নতুন পোশাক ভূষিত হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। সমাজের দরিদ্র শ্রেণীও এদিন থাকে আনন্দাপ্লুত। তাদের পেট সেদিন অভুক্ত থাকে না, তাদের পকেটও থাকে না অর্থশূন্য। ইসলামের অর্থনৈতিক সাম্যের বিধান এ দিনই মূর্ত হয়ে ওঠে। সকলেই নতুন পোশাক পরিধান, একই মাঠে জমায়েত, একই ইমামের পিছনে তাকবির ধ্বনির সাথে নামাজ আদায়, বুকে বুক মিশিয়ে কোলাকুলিÑএক নয়নাভিরাম স্বর্গীয় দৃশ্যের অবতারণা করে। একই দৃশ্য সর্বত্র। দীর্ঘ রোজার পর ঈদুল ফিতর পরিশুদ্ধ আত্মাকে সিরাতুল মুস্তাকিমে অবিচল রাখতে প্রেরণা জোগায় এবং দীর্ঘ তাকওয়ার প্রশিক্ষণকে বাস্তব রূপ দিতে শুরু করে।
ঈদ উদযাপনের ইতিহাস নতুন নয়। যুগে যুগে প্রত্যেক জাতিই নির্ধারিত দিনে তাদের ঈদ উৎসব পালন করতো। পবিত্র কুরআনেও বিভিন্ন জাতির ঈদ উৎসবের বর্ণনা রয়েছে। হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর সম্প্রদায়ের আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই মিলে একটি উন্মুক্ত প্রান্তরে আনন্দ উৎসব করতো। একবার তারা এতে ইব্রাহীম (আ.)কেও আহবান জানালো।- “অতঃপর তিনি তারকাজির প্রতি একবার তাকালেন এবং বললেন, আমি অসুস্থ। অতঃপর তারা তার প্রতি পিঠ ফিরিয়ে চলে গেলো।” (সূরা আস্সাফ্ফাত-৮৮-৯০)। অনুরূপভাবে হযরত মুসা (আ.)-এর সম্প্রদায়ও নির্ধারিত দিনে ঈদ উৎসব পালন করতো। মুসা (আ.) যখন তাঁর রিসালাতের দাওয়াত নিয়ে ফিরাউনের প্রাসাদে উপস্থিত হলেন তখন “সে বল্লো, হে মুসা! তুমি কি আমাদের নিকট এসেছ তোমার জাদু দ্বারা আমাদেরকে দেশ থেকে বের করে দিতে? আমরাও অবশ্যই তোমার নিকট অনুরূপ জাদু উপস্থিত করবো। সুতরাং আমাদের ও তোমার মধ্যে এমন একটা স্থান ও সময় নির্ধারিত করো, যার ব্যতিক্রম আমরাও করবো না তুমিও করবে না। মুসা (আ.) বললেন, তোমাদের নির্ধারিত সময় উৎসবের দিন এবং যেই দিন পূর্বাহ্নে জনগণকে সমবেত করা হবে।” (সূরা ত্বোয়াহা-৫৭-৫৯)। হযরত ঈসা (আ.)-এর সময় তাঁর সম্প্রদায়ের উৎসবের দিনেই আকাশ থেকে খাদ্য ভরা খাঞ্চা নাজিল করা হয়েছিল। মহানবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (দ.) যখন মদিনায় হিজরত করেন তখন তিনি মদিনাবাসীদেরকে দেখতে পান তারা ‘নওরোজ’ ও ‘মিহিরজান’ নামক দুটি উৎসব পালন করছে। এতে তারা নাচ গান, খেলাধুলা, কবিতা আবৃত্তিসহ বিভিন্ন আনন্দানুষ্ঠান পালন করছে। মহানবী (দ.) এ অনুষ্ঠান দুটির তাৎপর্য জিজ্ঞাসা করলে তারা জানায় যে, তারা প্রাচীনকাল থেকেই এ দুটি উৎসব পালন করে আসছে। তখন নবী করিম (দ.) বললেন, আল্লাহ্তায়ালা তোমাদেরকে দুটি দিনের পরিবর্তে এর চেয়েও উত্তম দুটি দিন অর্থাৎ ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা দান করেছেন।
শক্তিমান-বিত্তবানদের দাপটে-উপহাসে গরিব মানুষগুলোর চোখে-মুখে আজ হাসি নেই। এদের আনন্দ-খুশি কেড়ে নেয়া হচ্ছে। লাখ দেড় লাখ টাকা দামের হাজারো লেহেঙ্গা এই ঈদে ধনীরা প্রতিদিনই হজম করে নিচ্ছে, ঈদকে বিলাস জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে ধরে নিয়ে বাহারি পণ্য ক্রয়ের উৎসবে ধনীরা মেতে আছে মাসজুড়ে। অথচ তাঁর আশপাশের শত শত গরিব অভাবী মানুষ নিজ স্ত্রীর জন্য এখনো শ’তিনশ টাকা দামের একটি শাড়ি, নিজের জন্য একটি সাধারণ লুঙ্গি, বাচ্চাদের জন্য কম দামের প্যান্ট-শার্ট কেনার সামর্থ্যও রাখে না। লাখ-পাঁচ লাখ টাকার বাজেট নিয়ে কোমর বেঁধে নেমে ঈদের আনন্দের সবটুকুই ধনীরা লুফে নেয়। অন্যদিকে গরিব মানুষেরা এই ঈদে জনপ্রতি একটি নিম্নমানের পোশাকও কিনতে পারে না। দারিদ্র্যের সীমাহীন কশাঘাতে ওরা জর্জরিত। ওরা বিপন্ন। ওরা অধিকার হারা। তবুও এই অভাবী দুস্থ মানুষের দিকে ধনীদের সহানুভ‚তির দৃষ্টি পড়ে না। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা, ভোগ-বিলাসে ডুবে থাকার নামই কী রোজার সংযম, ঈদের চেতনা ও শিক্ষা?
প্রিয়নবী (দ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজে পেট পুরে খায়, অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধায় কাতর থাকে সে তো আমার উম্মতের দলভুক্ত নয়’। এখানে প্রিয়নবী (দ) বলেছেন একজন সচ্ছল ব্যক্তিকে তার প্রতিবেশীর প্রয়োজন পূরণে এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিবেশী সে মুসলিম বা অন্য ধর্মাবলম্বী যেই হোক না কেন। বলা হয়েছে প্রতিবেশীর কথা। প্রতিবেশী সে যে ধর্মের, গোত্রেরই অন্তর্ভুক্ত হোক তার দুর্দশায়- দুর্দিনে পাশে দাঁড়ানোর কড়া নির্দেশনা স্বয়ং নবীজীর (দ)। তাহলে যে বিত্তবান মানুষগুলো লাখ টাকা দামের লেহেঙ্গা কিনে কৃত্রিমভাবে ঈদের আনন্দের ষোলোকলা পূর্ণ করছে, তার পাশের দরিদ্র পরিবার অভাবে-কষ্টে ঈদের আনন্দে শামিল হতে পারছে না- ওই পরিবারটির দিকে চোখ মেলে তাকানোর, সহানুভ‚তি-সহমর্মিতা দেখানো খুব জরুরি নয় কি? দেশ ও সমাজের সবাইকে হাশি-খুশিতে রাখাই তো বিত্তবান, সমাজপতি ও সরকারের নৈতিক-ধর্মীয় দায়িত্ব। খলিফাতুর রসুল ইসলামের সোনালি দিনের ন্যায়নিষ্ঠ শাসক হযরত ওমর (রা) রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন- ‘শুধু কোনো মানুষ নয়, আমার শাসনের আওতাভুক্ত ফোরাত নদীর তীরে একটি কুকুরও যদি না খেয়ে মরে তাহলে আমি ওমরকে আল্লাহ্র কাছে দায়িত্বে গাফলতির জন্য জবাবদিহি করতে হবে। এর জন্য আমি ওমরই দায়ী থাকবো’। এই হচ্ছে ইসলামের জীবন দর্শন। সাহাবায়ে কেরামের দায়িত্বনিষ্ঠা ও ত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই একটি বাণী থেকে আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিবর্গের, নেতৃত্বের বহু কিছু শেখার আছে। একেই বলে প্রজাবাৎসল্য, মানবতাবোধ ও ইনসাফ। এক টুকরো চাঁদ একটি জাতির জীবনে কতোখানি আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত শাওয়ালের নতুন এক ফালি চাঁদ। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো ঈদের প্রকৃত চেতনা ও শিক্ষা থেকে আমরা যোজন যোজন দূরত্বে থেকে এর ফযিলত ও মাহাত্ম্য ভুলে গেছি। ঈদ যেন আজ কেবলই আচার-আনুষ্ঠানিকতা ও খেল তামাশায় রূপ নিয়েছে। ঈদের মূল শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে ছেড়ে মুসলিম জাতি ক্রমশই ভোগবাদী অপসংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ভোগ সর্বস্ব জীবনই বেছে নিচ্ছে আমাদের অনেকেই। অথচ নিঃস্ব অসহায়দের মুখে হাসি ফোটানোই ঈদের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও শিক্ষা। আজ ঈদের মূল শিক্ষা আমাদের মধ্যে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। ব্যথিতের কষ্ট দূর করা ও তার ব্যথাই সমব্যথী হওয়াই ঈদের শিক্ষা। সেই ব্যথিত ব্যক্তি আমার প্রতিবেশী হোক, আত্মীয় হোক কিংবা তার অবস্থান হোক সহস্র যোজন দূরে। নবী করিম (দ.) বলেছেন-মুমিন সমগ্র একটি দেহের ন্যায়। তার কোনো একটি অঙ্গ অসুস্থ হলে গোটা দেহ কষ্ট অনুভব করে। মুমিনদের আত্মাগুলোকে একটি সূত্রে গ্রন্থনই ঈদের মৌলিক আবেদন।
নিজে যথেচ্ছ খেয়ে দেয়ে নিশ্চিন্তে কাটানোর মোহ, খুব দামি পোশাকে ঈদ করার যে অভীপ্সা-আকাক্সক্ষা তা তখনই সার্থক ও পরিপূর্ণ হয় যখন চারপাশের মানুষেরাও একই মানের না হলেও কোনো রকম দিন চালানোর ভরসা পায়, ঈদ উদযাপনের আনন্দে শামিল হবার যদি সুযোগ পায়। অবর্ণনীয় কষ্টে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হওয়া নদীভাঙনে গৃহহারা, ছিন্নমূল পথ শিশুদের দিকে এই ঈদে একটু নজর দিন। তাদের প্রয়োজন পূরণ করুন। সুখে-দুঃখে সমব্যথী হোন। এই মানবিক দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্র, Ñবিত্তবান সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। তৃণমূলের দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের চোখে-মুখেও থাকে যেন ঈদের হাসি, আনন্দের ঝিলিক। এটাই সিয়াম ও ঈদের অন্তর্নিহিত দর্শন ও আহবান।