তৈলারদ্বীপ সেতুর টোল কর্ণফুলী সেতুর সমান!

69

রাহুল দাশ নয়ন

শাহ আমানত সেতুর (তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু) দৈর্ঘ্য ৯৫০ মিটার। তৈলারদ্বীপ সেতুর (সাঙ্গু) দৈর্ঘ্য ৫২১ মিটার। দৈর্ঘ্যরে দিক থেকে ব্যবধান প্রায় অর্ধেক হলেও তৈলারদ্বীপ সেতু পারাপারে কয়েকটি শ্রেণির যানবাহনে টোল আদায় হচ্ছে কর্ণফুলী সেতুর সমান কিংবা তারও বেশি।
বাঁশখালী-আনোয়ারা সংযোগস্থল তৈলারদ্বীপ সেতুর টোল আদায়ে যেন পদে পদে অনিয়ম। এই সেতু পারাপারে ১৩ ধরনের গাড়ি থেকে টোল আদায়ের সরকারি হার নির্ধারণ করা হলেও তা মানছে না ইজারাদার। ট্রেইলার, মিনি ট্রাক, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, মিনি পিকআপ, হেভি ট্রাক ও মিডিয়াম ট্রাক শ্রেণির যানবাহন থেকে বাড়তি টোল আদায় করা হয়। কোনো গাড়িচালক বাড়তি টোল পরিশোধে গড়িমসি করলেই আটকে রাখা হয়। এতে গাড়িচালক, যাত্রী ও টোল আদায়কারীদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটছে। এমন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চান গাড়িচালক ও যাত্রীরা।
২০২৩-২০২৬ তিন অর্থ বছর (১০৯৫ দিন) পর্যন্ত প্রায় ৩২ কোটি টাকায় তৈলারদ্বীপ সেতুর ইজারা পেয়েছেন মোহাম্মদ জহির উদ্দিনের মালিকানাধীন জেএ ট্রেডিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান। মূলত এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধেই বাড়তি টোল আদায়ের অভিযোগ করছেন গাড়ি চালক-যাত্রীরা।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা পূর্বদেশকে বলেন, ‘তৈলারদ্বীপ সেতুতে বাড়তি টাকা আদায় নিয়ে অভিযোগটি পুরানো। ইজারাদার বেশি টাকা নিলে পাবলিক দেয় কেন? সেখানে টোলের তালিকা লাগানো আছে, তা দেখে টাকা দিলেই তো হয়। পাবলিক প্রতিবাদ করে আমাদেরকে জানাতে পারে। আমি জেলায় থাকার সময় একবার আমাকে দিয়ে তদন্ত করানো হয়েছিল। তখন এমন অভিযোগ কেউ আর দেয়নি। পাবলিক চাইলে নিজেরাই বিষয়টি নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করতে পারে।’
জানা যায়, ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের সাথে সড়ক ও জনপথ দক্ষিণ বিভাগের সম্পাদিত চুক্তির শর্তাবলীতে নির্ধারিত হারে টোল আদায়ের রশিদ ছাপানোর কথা বলা হলেও বাড়তি টাকায় রশিদ ছাপানো হয়েছে। ট্রেইলার জাতীয় যানবাহন প্রতিবার সেতু পারাপারে ৩০০ টাকা নেয়ার কথা থাকলে সেখানে নেয়া হচ্ছে ৫০০ টাকা। টোল আদায়ের নীল টোকেনে ট্রেইলারের সাথে কাভার্ড ভ্যান শব্দ যুক্ত করে এই টাকা আদায় করা হচ্ছে। অথচ সড়ক ও জনপথ বিভাগ থেকে টোল আদায়ের যে ১৩টি যানবাহন চিহ্নিত করা হয়েছে সেখানে কাভার্ড ভ্যান নামক কোন গাড়ি উল্লেখ করা হয়নি। একইভাবে মিনি পিকআপ নামে কোন যানবাহন টোলের তালিকায় নাই। কিন্তু হলুদ রঙের টোকেন দিয়ে মিনি পিকআপ উল্লেখ করে আদায় করা হচ্ছে ১৩০ টাকা। অথচ একই শ্রেণির গাড়ি শাহ আমানত সেতু (নতুন ব্রিজ) পারাপারেই ১৩০ টাকা টোল পরিশোধ করে। তৈলারদ্বীপ সেতুর টোল আদায়কালে এই শ্রেণির গাড়িতে গোলাপী টোকেন দেয়ার বিনিময়ে ১১৫ টাকা নেয়ার নিয়ম থাকলেও সেখানে ১৫ টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে।
প্রতিবার শাহ আমানত সেতু পারাপারে হেভী ট্রাক ৩০০ টাকা টোল পরিশোধ করেন। একই শ্রেণির ট্রাক তৈলারদ্বীপ সেতু পারাপারে ১৮০ টাকার স্থলে নেয়া হচ্ছে ৩০০ টাকা। মিডিয়াম ট্রাক শাহ আমানত সেতুতে ২০০ টাকা নেয়া হয়। একই শ্রেণির ট্রাক তৈলারদ্বীপ সেতু পারাপারে ১৫০ টাকার স্থলে নেয়া হচ্ছে ৩০০ টাকা। মাইক্রোবাসে ৬০ টাকার স্থলে আদায় করছে ৮০ টাকা। প্রাইভেট কার ৪০ টাকার স্থলে নেয়া হচ্ছে ৫০ টাকা। ইজারা শর্ত ভঙ্গ করেই রীতিমত অতিরিক্ত টাকার রশিদ ছাপিয়ে গলাকাটা টোল আদায় করছে ইজারাদার। যা নিয়ে গাড়ি চালক, যাত্রী ও গাড়ি মালিকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে।
মেসার্স ফারুক এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. ফারুক বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানের ছয় চাকার লোভেট গাড়ি স্কেভেটর নিয়ে তৈলারদ্বীপ সেতু পারাপার হয়। এ গাড়ি আসা-যাওয়ায় ৩০০ টাকা করে ৬০০ টাকা নেয়ার কথা থাকলেও নেয়া হচ্ছে ৫০০ টাকা করে এক হাজার টাকা। আমার গাড়িচালক বিষয়টি নিয়ে কথা বললেও তারা ছাড় দেয়নি। রীতিমত নৈরাজ্যকরভাবে বাড়তি টোল আদায় করা হচ্ছে।’
গত বছর জুলাই মাসে জেএ ট্রেডিং নামক প্রতিষ্ঠানটি ইজারাদার নিয়োগ হওয়ার পর বাড়তি টোল আদায় শুরু করলে আন্দোলনে নামে আনোয়ারা-পটিয়া-বাঁশখালী শ্রমিক ইউনিয়ন। তারা সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে তৈলারদ্বীপ সেতুতে বাড়তি টোল আদায় নিয়ে অভিযোগ দেন। পাশাপাশি মানববন্ধন কর্মসূচিও পালন করেন। এরপর সেতু ব্যবহারকারে বাস ও সিএনজি অটোরিকশা থেকে নির্ধারিত হারে টোল আদায় করছে। এই দুই শ্রেণীর গাড়ি চালকরা ঐক্যবদ্ধ থাকায় আন্দোলনের ভয়ে বাড়তি টোল আদায়ে পিছপা হলেও ছাড় পায় না ট্রাক কিংবা প্রাইভেট গাড়িগুলো। গরু, মহিষ, কাঠ কিংবা মাছ বোঝাই ট্রাক পেলেই বাড়তি টোল আদায় করা হয়।
আনোয়ারা-পটিয়া-বাঁশখালী শ্রমিক ইউনিয়ন (পিএবি) সাবেক সাধারণ সম্পাদক রফিক উদ্দিন বলেন, ‘বাঁশখালীর গাড়ি থেকে ১৫টাকা নিলেও অন্যান্য গাড়ি থেকে বেশি টাকা আদায় করতো। যে কারণে আমরা আন্দোলন করেছিলাম। আমরা এ সেতু টোলমুক্ত চাই।’
লালদীঘি এলাকার প্রাইভেট কারচালক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘তৈলারদ্বীপ সেতুর টোল প্রত্যাহার করা এখন সময়ের দাবি। শঙ্খ নদীতে আরও সেতু থাকলেও সেগুলোতে টোল নাই। অথচ ছোট এই সেতুতে টোল আদায় করা হচ্ছে। এটা রীতিমত বাঁশখালী ও পেকুয়ার মানুষের উপর বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এ সেতু পারাপারে প্রাইভেট কার থেকে ৪০ টাকা নেয়ার নিয়ম থাকলেও নেয়া হয় ৫০ টাকা।’
অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে ইজারাদারের মুঠোফোনে কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। উনার ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিত টোল পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আজিজুল হক আজিজ পূর্বদেশকে বলেন, ‘বাড়তি টোল আদায় নিয়ে অনেক আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে। মাসখানেক আগে একবার বাড়তি টোল আদায় করা হলেও তা বন্ধ করা হয়েছে। ৫০০ টাকা যে টোকেন করা হয়েছিল তাও ফেলে দেয়া হয়েছে। এখন নিয়মানুযায়ী টোল নেয়া হয়।’

বাড়তি টোল বন্ধে এমপির হুঁশিয়ারি : বাড়তি টোল আদায় নিয়ে যাত্রাপথে গত বৃহস্পতিবার ও গত শনিবার দুইদফা টোল আদায়কারীদের সাথে কথা বলেছেন বাঁশখালীর সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমান। এসময় তিনি বাড়তি টোল আদায় নিয়ে প্রতিবাদ করেন। টোল আদায়কারীদের উদ্দেশ্যে সংসদ সদস্য বলেন, ট্রাকের টোল বেশি নেয়া হচ্ছে। প্রাইভেট কারের টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে। শাহ আমানত সেতুর সমান হারে ছোট এই সেতুতেও টোল আদায় করা হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে বাড়তি টোল আদায় বন্ধ না হলে আন্দোলন শুরু করবো। দ্রুত বড় আকারে টোল আদায়ের তালিকা টোলবক্সের দুইপাশে টাঙিয়ে দেয়ার নির্দেশনা দেন তিনি। সাংসদের প্রতিবাদে উপস্থিত টোল আদায়কারীরা কয়েকটি যানবাহনে বাড়তি টোল নেয়ার কথা স্বীকারও করেন।
টোল রশিদেও অসঙ্গতি : টোল আদায়ের পর যানবাহনে যেসব রশিদ দেয়া হয় সেগুলোতেও বড় ধরনের অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। সরকার অনুমোদিত ইজারাদার পরিচয়ে এসব টোল রশিদ সরবরাহ করা হলেও সেগুলোর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রশিদে ক্রমিক নং, বই নং লিখা থাকলেও সেখানে কোন ক্রমিক নেই। পাশাপাশি তালিখ ও আদায়কারীর স্বাক্ষর নেই। সরকারি নীতিমালায় টোল আদায়ের রশিদের নির্ধারিত রঙ উল্লেখ থাকলেও তাও মানা হয়নি।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমরা সরকারি নীতিমালা অনুসারেই সেতু ইজারা দিই। এর মধ্যে শর্তের কোন ব্যত্যয় হলে আমরা ইজারা বাতিল করতে পারি।’