রমজানে ডায়াবেটিক রোগীর করণীয়

4

তানজিনা হোসেন

পবিত্র রমজান মাসে একজন ডায়াবেটিক রোগীর খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম, জীবনাচরণ ও ওষুধের নিয়মে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। এক মাসের জন্য এই নতুন ধরনের জীবনাচরণপদ্ধতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে তাঁদের কিছু নিয়মকানুন পালন করতে হয়। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) রমজান মাসে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে গাইডলাইন প্রকাশ করেছে। এরই আলোকে বাংলাদেশের রোজাদার ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য সংক্ষেপিত আকারে এই নির্দেশনামা তৈরি করা হয়েছে।
কিছুসংখ্যক জটিল রোগী বাদে অধিকাংশ ডায়াবেটিক রোগী বড় ধরনের কোনো সমস্যা ছাড়াই রোজা পালন করতে পারেন। রোজা পালনের কারণে ডায়াবেটিক রোগীরা কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারেন। যেমন ১. হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা রক্তে শর্করা স্বল্পতা, ২. হাইপারগ্লাইসেমিয়া বা রক্তে শর্করা অত্যধিক বেড়ে যাওয়া, ৩. ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা, ৪. কিটো অ্যাসিডোসিস এবং ৫. থ্রম্বোসিস বা রক্ত জমাট বাঁধা।
ঝুঁকি বিবেচনা করে কিছু রোগীকে চিকিৎসকেরা উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যাঁদের রোজা পালন না করাই ভালো, তাঁরা হলেন, রোজার আগে তিন মাসের মধ্যে যাঁদের তীব্র হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা হাইপারগ্লাইসেমিয়াজনিত জটিলতা হয়েছে, যাঁদের বারবার রক্তে শর্করা কমে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে বা যাঁরা রক্তে শর্করা কমে গেলে টের পান না, ডায়াবেটিসজনিত কিডনি রোগ বা হৃদ্রোগ আছে যাঁদের, রমজানরে সময় আকস্মিক অসুস্থতা (জ্বর, সংক্রমণ ইত্যাদি), বয়স্ক রোগী ও অন্তঃসত্ত্বা ডায়াবেটিকে রোগী যাঁরা ইনসুলিন গ্রহণ করেন।
রমজান মাসে সাধারণত ইফতার ও সাহ্রিতে দুটি মূল খাবার গ্রহণ করা হয়। লক্ষ রাখতে হবে যে রমজান মাসেও দৈনিক ক্যালরি চাহিদা একই রকম থাকবে, কেবল সময়সূচিতে পরিবর্তন আসতে পারে। অন্য সময়ের মতোই চিনি বা চিনিযুক্ত খাবার খাওয়া নিষেধ। জটিল শর্করা যেমন: লাল চালের ভাত, রুটি, ওটস, কর্নফ্লেক্স খাওয়া ভালো। যথেষ্ট পরিমাণে শাকসবজি, তাজা ফলমূল খেতে হবে। ইফতারে অতিরিক্ত ভাজা-পোড়া ও তেলযুক্ত উচ্চ ক্যালরি খাবার পরিহার করা উচিত। একসঙ্গে অনেক খাবার না খেয়ে ভাগ করে খাওয়া উচিত। রমজান মাসে প্রযোজ্য দুটি খাদ্যতালিকা এখানে সংযুক্ত করা হলো। এ ছাড়া কয়েকটি বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখুন। সাহ্রি না খেয়ে রোজা রাখবেন না। সাহ্রিতে ভাত বা রুটি, সবজি, মাছ বা মাংসসহ একটি পূর্ণাঙ্গ খাবার খেতে হবে।
ইফতারে শরবত বা মিষ্টি জুস না খেয়ে ডাবের পানি, ফলের রস, লেবুপানি পান করতে পারেন। ইফতার ও সাহ্রির মাঝখানে দুধ, ফলমূল, চিড়া, দই ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। রাতের বেলা পর্যাপ্ত পানি পান করুন।
রমজান মাসে দিনের বেলায় ব্যায়াম বা ব্যায়ামের উদ্দেশ্যে হাঁটাহাঁটি না করাই ভালো। সন্ধ্যার পর হালকা ব্যায়াম করা যেতে পারে।
রমজান মাসেও সময় নির্ধারণ করে রক্তে শর্করা পরিমাপ করতে হবে। খারাপ লাগলে বা হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে রক্তে গ্লুকোজ মাপতে হবে। হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণগুলো হচ্ছে দুর্বল লাগা, মাথা ঝিমঝিম করা, চোখে ঝাপসা দেখা, ঘাম হওয়া, হাত কাঁপা, মাথা শূন্য বোধ হওয়া ইত্যাদি।
রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ ৩.৯ মিলিমোল বা ৭০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটারের কম হয়ে গেলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ ১৬.৬ মিলিমোল বা ৩০০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটারের বেশি পাওয়া গেলে এবং যেকোনো আকস্মিক অসুস্থতায় চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
রক্ত পরীক্ষা করে আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে রমজানে ওষুধ বা ইনসুলিনের ডোজ এবং শর্করা পরিমাপের সময়সূচি সম্পর্কে জেনে নিন। শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় এই মাত্রা একেকজনের জন্য একেক রকম হতে পারে। সাধারণভাবে মেটফরমিন, ইনক্রিটিন গোত্রের ওষুধের মাত্রায় তেমন কোনো পরিবর্তন দরকার হয় না, কেবল সময়সূচি পরিবর্তন করলেই চলে। কিন্তু সালফোনাইল ইউরিয়া গোত্রের ওষুধ বা ইনসুলিনের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত জরুরি। রমজান মাসে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা পরিমাপ করে কীভাবে ওষুধ বা ইনসুলিনের মাত্রা সমন্বয় করবেন, তাও শিখে নিন।
লেখক: হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ