বৈষম্য নিরসনে ঈদ উৎসবের প্রণোদন

4

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

নিবন্ধের সূচনায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম’র ‘ঈদ মোবারক’ কবিতার কয়েকটি পংক্তি উপস্থাপন করতে চাই। ‘ইসলাম বলে, সকলে তরে মোরা সবাই,/ সুখ-দুখ সম-ভাগ করে নেব সকলে ভাই,/ নাই অধিকার সঞ্চয়ের!/ কারো আঁখি-জলে কারো ঝাড়ে কি রে জ্বলিবে দীপ!/ দু’জনার হবে বুলন্দ-নসীব, লাখে লাখে হবে বদ-নসীব?/ এ নহে বিধান ইসলামের/ ঈদ-অল-ফিতর আনিয়াছে, তাই নববিধান,/ ওগো সঞ্চয়ী, উদ্বৃত্ত যা করিবে দান,/ ক্ষুধার অন্ন হোক তোমার!/ ভোগের পেয়ালা উপচায়ে পড়ে তব হাতে,/ তৃষ্ণাতুরের হিসসা আছে ও-পেয়ালাতে,/ দিয়া ভোগ কর, বীর, দেদার’ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-অঞ্চল নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজের প্রকৃষ্ট বৈশিষ্ট্য সাম্যের ধর্ম ইসলামের সকল রীতিনীতির অনুপম অনুষঙ্গ। উল্লেখ্য কবিতায় প্রতিভাত যে ঈদ-উল- ফিতর উদযাপনও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়।
আর্ত, অর্থার্থী, ভক্ত ও জিজ্ঞাসু- মানস চরিত্রকে এই চার ধারায় বিশেষিত করে বেদ ও গীতায় এর বিশদ ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে।স্রষ্টার কাছে বিপদ থেকে পরিত্রাণ নিবেদনে ব্যতিব্যস্তরা হচ্ছে ‘আর্ত’ শ্রেণির লোক। অভাব বা ইচ্ছা পূরণের লক্ষ্যে যারা আরাধনা করে তারা হচ্ছে ‘অর্থার্থী’। বিনাশর্তে স্রষ্টার কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণে নিয়োজিত ব্যক্তিরা হচ্ছে ‘ভক্ত’। আর নানাবিধ প্রক্রিয়ায় স্রষ্টার মহিমাকে উপলব্ধি করার জন্য যারা অনুসন্ধিৎসু তারা হচ্ছে ‘জিজ্ঞাসু’। অর্থাৎ যারা সত্যিকার ধার্মিক তারা কোন সম্প্রদায়ভুক্ত না হয়ে মহান স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনে ইহ-জাগতিক অতিরঞ্জিত সকল ভোগবাদকে তুচ্ছজ্ঞান করে থাকে। পার্থিব অবাঞ্ছিত বিলাসিতা বিসর্জন দিয়ে পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণে নিজেকে বিলীন করার চিন্তা-চেতনায় ঋদ্ধ ব্যক্তিরাই প্রকৃত অর্থে স্রষ্টার ভক্তকূল। মানবসেবা-মানবতার জয়গানে সমৃদ্ধ অন্বেষা তাদের জীবনের একমাত্র পাথেয়।
প্রাসঙ্গিকতায় ইসলামের মৌলিক শিক্ষায় আত্মসংযমের নিবিড় পরিচর্যা এবং ক্ষুধাতুর মানুষের কষ্ট-বেদনা অনুভবের প্রণিধানযোগ্য অনুশীলন হচ্ছে সকাল-সন্ধ্যা অনাহারে থাকা। এভাবে ধৈর্য পরীক্ষার যে সময়কাল পবিত্র কোরআনে ঈমানের মূল স্তম্ভ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত; সেটি হচ্ছে রমজান মাস। এই রমজান মাসের তাৎপর্য ইসলামের ইতিহাসে বিশাল। এই মাসেই প্রিয় নবীর নেতৃত্বে সংঘটিত হয় মহান বদরযুদ্ধ। মাত্র ৩১৩ জন সাহাবীদের নিয়ে প্রায় এক হাজার শত্রæ মোকাবেলা করে মহান আল্লাহর অপার কৃপায় ঈমানী শক্তিবলে জয়লাভ করে মুসলমানগণ। এই যুদ্ধে জয়ী হতে না পারলে আদৌ পবিত্র ইসলাম ধর্ম সুদৃঢ় হয়ে আজকের পর্যায়ে আসতে পারত কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এই পবিত্র রমজান মাসেই পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃত মহাগ্রন্থ পবিত্র কোরআন নাজেল হয়েছে। এ রকম বহু ঘটনা আছে যা এই মাসকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে অধিষ্ঠিত করেছে।
পবিত্র রমজান মাসের শেষে যে ঈদ-উল-ফিতর বা ঈদ উৎসব তার পটভূমি অনুভব করতে হলে পবিত্র রমজানের দর্শন তথা সংযম-ত্যাগ-সম্প্রীতি-সৌহার্দ, আচার-আচরণ, নামাজ-দোয়া, অন্যের কষ্টে ব্যথিত হওয়া, গরীব-দুঃখীদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদির আলোকে ধারণ করতে হবে। ইফতার-সেহরী, তারাবির নামাজ, যাকাত-ফিতরা প্রদান, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান সংহার করে এক মহান ¯্রষ্টার সৃষ্ট মানব হিসেবে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ, অন্য ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা ইত্যাদি পরিত্যাজ্য। কল্যাণধর্মী মানসিকতা-মানবিক ও অসাম্প্রদায়ীকতায় দিক্ষিত হয়ে একটি উদার মনন-প্রগতিশীল ও সত্য-সন্দুরের চাষাবাদে জীবন প্রবাহের উৎকর্ষতা অর্জন পবিত্র রমজানের আদর্শিক শিক্ষা। ধারাবাহিকতায় রমজান শেষে সকলে মিলেমিশে শ্রেণী-বর্ণ-ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে ঈদ উৎসব-আনন্দ ভাগাভাগি করার মধ্যেই প্রকৃত সুখ ও শান্তি নিহিত। নানামুখী বৈষম্যের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে প্রকৃত ধর্ম-জীবনদর্শনের সমীকরণে ঈদের অনুপম বৈশিষ্ট্য অধিকতর নন্দিত অধ্যায় তৈরি করে।
প্রতিটি মুসলমান সম্যক অবগত আছেন, প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় গেলেন, তখন সেখানে জাহেলি যুগ থেকে শরতের পূর্ণিমায় ‘নওরোজ’ এবং বসন্তের পূর্ণিমায় ‘মেহেরজান’ নামক প্রচলিত দু’টি উৎসবের দিন ছিল। রাসূল (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, এই দুই দিন কীসের? মদিনাবাসী সাহাবিরা বললেন, জাহেলি যুগ থেকে আমরা এই দুই দিন খেলাধুলা ও আনন্দ করি। রাসুল (সা:) বললেন, আল্লাহ এই দুই দিনের বদলে তোমাদের জন্য নতুন দুটি উৎসবের দিন দিয়েছেন; ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা।(মুসনাদে আহমদ ১৩০৫৮) এভাবে মুসলমানদের পৃথক উৎসবের সূচনা হলো। দ্বিতীয় হিজরি অর্থাৎ ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে রাসূল (সা.) ঘোষণা করনে, ‘সব জাতিরই ঈদ বা উৎসবের দিন থাকে, এটা আমাদের ঈদ’ (সহিহ বুখারি ৩৯৩১, সহিহ মুসলিম ২০৯৮)।
আমাদের সকলের জানা যে, পবিত্র রমজান মাসে ধার্মিক মুসলমান মানব সত্তার আতিœক উৎকর্ষ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিশিষ্ট উপাদান হিসেবে চাঁদ দেখা সাপেক্ষে উনত্রিশ বা ত্রিশ দিন রোযা আদায় করেন। প্রকৃতপক্ষে ইসলামী শরিয়তের পঞ্চ বুনিয়াদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হচ্ছে রোযা। খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০০-৫০০০ বছর কালের আদি পিতা হযরত আদম (সাঃ) থেকে হযরত ঈসা (সাঃ) পর্যন্ত সকল নবী রাসুলের শরিয়তেও তাদের উম্মতগণের উপর রোযা আদায় করা বিধিবদ্ধ ছিল। রোযা আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা, পরিত্যাগ করা ও সহজ-সরল জীবন যাপনে অভ্যস্থ হওয়া। মহিমান্বিত রমজান মাসে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও ইন্দ্রিয় সূখ-ভোগ থেকে বিরত থাকাই হচ্ছে ইসলামী পরিভাষায় সিয়াম সাধনা। আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংযমের মাধ্যমে স্বীয় দেহ মনকে নিয়ন্ত্রণ এবং এর পরিপূর্ণ উপলব্ধিতে অপরের কল্যাণকে নিশ্চিত করার মধ্যেই রমজানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য উপস্থাপিত।
এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, নামায-ইবাদত-সিজদা ইত্যাদি ফেরেশতা-জিন্সহ অন্যান্য মাখলুকাতও সম্পন্ন করে থাকে। কিন্তু রোযা একমাত্র মানবজাতির জন্যই স্বতন্ত্র ইবাদত যা ঈমানের অঙ্গ হিসেবে ফরয বা অবশ্যই পালনীয়। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত রাসূলাল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, সিয়াম ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য। কিন্তু সিয়াম আমার জন্য এবং আমিই এর প্রতিদান দিব। সিয়াম ঢালস্বরূপ। তোমাদের কেউ যেন সিয়াম পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে, আমি সিয়াম পালনকারী। যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, তার শপথ! অবশ্যই সিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিসকের গন্ধের চেয়েও সুগন্ধি। সিয়াম পালনকারীর জন্য রয়েছে দু’টি খুশি, যা তাকে খুশি করে। যখন যে ইফতার করে, সে খুশি হয় এবং যখন সে তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন সাওমের বিনিময়ে আনন্দিত হবে। (সহীহ বুখারী: ১৯০৪, সহীহ মুসলিম: ১১৫১)
ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী সকলই পবিত্র ইসলামকে একটি বিশ্বজনীন ধর্ম হিসেবে ধারণ করে এবং প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (সা.) মহান আল্লাহতায়ালা প্রেরিত শেষ নবী এবং তিনি ‘ওহি’ প্রাপ্ত। ‘মুহম্মদ’ শব্দের অর্থ প্রশংসিত আর ‘ইসলাম’ শব্দটির উৎপত্তি ‘আসলামা’ থেকে যার অর্থ শান্তি এবং ‘মুসলমান’ শব্দের অর্থ আত্মসমর্পণকারী অর্থাৎ পরিপূর্ণভাবে মহান আল্লাহতালার নিকট সকল কিছুতেই আত্মসমর্পণকারীই হচ্ছেন সত্যিকারের মুসলমান। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শব্দের ‘কোর’ অর্থ পড়া আর ‘আন’ অর্থ সর্বক্ষণ অতএব এর আভিধানিক প্রত্যয় ‘সর্বক্ষণ পাঠ কর’। আল্লাহর উপর অগাধ বিশ্বাস অর্থাৎ ঈমাম, নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত এই পাঁচটি পবিত্র ইসলামের মূল ভিত্তি। এর মধ্যেই নামাজ রোযা যাকাতকে ঘিরে যে মাসটি সবচেয়ে সমাদৃত সে মাসকেই পরিপূর্ণভাবে মর্যদাসীন করার লক্ষেই এর শেষে পবিত্র ঈদ বা সর্বোচ্চ উৎসবের দিন ধার্য করা হয়।
কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘হিন্দু-মুসলমান’ নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে “একদিন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল আমার, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে। গুরুদেব বললেন : দেখ, যে ন্যাজ বাইরের, তাকে কাটা যায়, কিন্তু ভিতরের ন্যাজকে কাটাবে কে ?” নজরুল আরো বলেছেন “ন্যাজ যাদেরই গজায়- তা ভিতরেই হোক আর বাইরেই হোক- তারাই হয়ে ওঠে পশু। যে সব ন্যাজওয়ালা পশুর হিং¯্রতা সরল হয়ে বেরিয়ে আসে বাইরে- শৃঙ্গরূপে, তাদের তত ভয়ের কারণ নেই, যত ভয় হয় সেই সব পশুদের দেখে- যাদের হিং¯্রতা ভিতরে, যাদের শিং মাথা ফুটে বেরোয়নি।” নজরুলের উল্লেখিত হিংস্রতাকে নিধন করার উপযোগী পন্থাই হচ্ছে মানবতার চর্চা। অন্যের কষ্টে ব্যথিত না হওয়া, অন্যের হৃদয়ের রক্তক্ষরণে নিজের হৃদয়ে বেদনার জন্ম না নেওয়া ইত্যকার অমানবিক, অশুভ ও অসংগতিপূর্ণ আচরণ সমাজের প্রচলিত ব্যবস্থাকে কতটুকু বিপর্যস্ত করতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। পবিত্র মাহে রমজান ও ঈদ উৎসবের শিক্ষা এই মানবতাকে জাগ্রত করার জন্য কতবেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটি নতুন করে বলার অবকাশ আছে বলে মনে হয়না। তবুও এখনো যখন ধর্মীয় উম্মাদনায় ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলো নানা অপকর্মের সাথে যুক্ত হয়ে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ নির্মূলে অন্তরায় সৃষ্টি করে; তখন দুঃখের সাথে নজরুলের উল্লেখিত বাণীগুলো বার বার স্মরণে আঘাত করে। অতিসম্প্রতি আগুন সন্ত্রাসসহ নানাবিদ নাশকতামূলক কর্মযজ্ঞে যারা জড়িত থেকে রমযান মাসের পবিত্রতা নষ্ট করে ঈদ উৎযাপনের পূর্বে পণ্য সামগ্রী বিক্রেতাদের নিঃস্ব করার হীন চক্রান্তে লিপ্ত; মহান আল্লাহ যেন তাদরে হেদায়েত ও মানব ধর্মের শ্বাশত গুণাবলী হৃদয়ে প্রোথিত করার বোধসমৃদ্ধ করেন- এটুকুই ঈদ উৎযাপনে নিবিড় প্রার্থনা। এই ধরিত্রীর সকল মানব সন্তানদের প্রতি পবিত্র ঈদের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি।