বাংলা ভাষার ঐতিহ্য

14

অমল বড়ুয়া

মানবজাতির আন্তঃযোগাযোগ, ভাব-বিনিময়, আত্মপ্রকাশ ও সৃজনশীলতার অনবদ্য মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। পুরো পৃথিবীই উর্বর বিবিধ ভাষার আতিশয্যে। মানুষের ভাষা, পশু-পাখির ভাষা, কীট-পতঙ্গের ভাষা ও প্রকৃতির ভাষা। এতো এতো ভাষার মধ্যে কেবল মানুষের ভাষার মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা অন্যান্য প্রাণীর ভাষায় দেখা যায় না। আর মানুষের ভাষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো ‘সৃজনশীলতা বা সঞ্জননী’ ক্ষমতা। প্রতিটি মানুষ তার নিজ নিজ ভাষা আয়ত্ত করার সহজাত গুণ নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেন এবং সে যেই নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিবেশ-বেষ্টিত ভাষিক সমাজের অন্তর্গত, সেই সমাজে সে দৈনন্দিন ভাষাপ্রয়োগের মাধ্যমে তার নিজস্ব ভাষাজ্ঞান বিকশিত করে। দেশ, কাল ও পরিবেশভেদে ভাষার পার্থক্য ও পরিবর্তন ঘটে।

ভাষা কি ও কেন ?
কন্ঠের দ্বারা মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম ও একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। এই বাগযন্ত্রের দ্বারা উচ্চারিত অর্থবোধক ধ্বনির সাহায্যে মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যমকে ভাষা বলে। সকল মানুষের ভাষাই বাগযন্ত্রের দ্বারা সৃষ্ট। তবুও একই ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টির অর্থ বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম হতে পারে। এ কারণে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর জন্য আলাদা আলাদা ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। ভাষার ক্ষুদ্রতম একক হলো ‘ধ্বনি’। এটা ভাষার মৌলিক অংশ। ধ্বনির লিখিত রুপ হলো ‘বর্ণ’। শব্দের অংশ হলো অক্ষর। বাক্যের ক্ষুদ্রতম একক বা অংশকে শব্দ বলে। মানুষের কণ্ঠ নিঃসৃত বাক্-সংকেতের সংগঠনকে ভাষা বলা হয়। মুখের ভাষার পাশাপাশি ইশারা-ভাষা বা সাংকেতিক-ভাষা বা প্রতীকী ভাষাও মানুষ ব্যবহার করে থাকে। নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাগি টলারম্যানের মতে, ‘পৃথিবীতে মানুষই হলো একমাত্র প্রাণী যাদের ভাষা আছে, এই ভাষার কারণে আমরা অন্যসব প্রাণী থেকে আলাদা হয়েছি।’ ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মানব বিবর্তন বিভাগের শিক্ষক ও নৃবিজ্ঞানী রবার্ট ফোলি বলেন- ‘জটিল যতো বিষয় আছে তার একটি এই ভাষা এবং এটিই আমাদের মানুষ বানিয়েছে।’

বাংলা ভাষার রূপান্তর
ইন্দো-আর্য হল ইন্দো-ইরানীয় ভাষা উপবিভাগের একটি প্রধান শাখা, যা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোত্রের পূর্বাঞ্চলীয় ধরন। মধ্য ইন্দো-আর্য ভাষাগুলোর মধ্যে আছে পালিসহ প্রাকৃতের বিভিন্ন রূপ, যেগুলো পাওয়া যায় সম্রাট অশোক এবং থেরবাদ বৌদ্ধ শাস্ত্রে। পালি ভাষা সম্পর্কে শ্রীঈশানচন্দ্র ঘোষ মত দেন যে, ‘শব্দগত, উচ্চারণগত, এমনকি ব্যাকরণগত সাদৃশ্য দেখিলে মনে হয়, ইহা (পালি) উৎকল, বঙ্গ প্রভৃতি কতিপয় প্রাচ্যভাষার জননীও হইতে পারে। অধ্যাপক অটো ফ্রাঙ্ক বলেন যে, একসময়ে ভারতবর্ষে ও লঙ্কাদ্বীপে পালিই আর্য্যাদিগের সাধারণ ভাষা ছিল।’
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দ থেকে বাংলায় হিন্দু-ব্রাহ্মণগণ সংস্কৃত ভাষার চর্চা করত, কিন্তু স্থানীয় বৌদ্ধরা প্রাকৃত ভাষায় কথা বলত, যাকে ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় মাগধী প্রাকৃতের পূর্বরূপ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। প্রথম সহস্রাব্দে বাংলা যখন মগধ রাজ্যের একটি অংশ ছিল তখন মধ্য ইন্দো-আর্য উপভাষাগুলি বাংলায় প্রভাবশালী ছিল। এই উপভাষাগুলিকে মাগধী প্রাকৃত বলা হয় এবং এটি আধুনিক বিহার, বাংলা ও আসামে কথিত হত। এই ভাষা থেকে অর্ধ-মাগধী প্রাকৃতের বিকাশ ঘটে। প্রথম সহস্রাব্দের শেষের দিকে অর্ধ-মাগধী থেকে অপভ্রংশের বিকাশ ঘটে। সময়ের সাথে সাথে বাংলাভাষা একটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে বিকশিত হয়। ষষ্ঠ শতাব্দীর আশেপাশে অর্ধ-মাগধী থেকে অবহট্‌ঠ ভাষার বিকাশ ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়, এই অবহট্ঠ ভাষা কিছু সময়ের জন্য বাংলাভাষার পূর্বপুরুষ প্রোটো-বাংলার সাথে প্রতিদ্বন্ধিতা করেছিল। প্রোটো-বাংলা ছিল পালসাম্রাজ্য এবং সেন রাজবংশের ভাষা। আর পালসা¤্রাজ্যের সময়েই বাংলাভাষার আদি নিদর্শন চর্যা রচিত হয়। বাংলাভাষার রূপান্তর ক্রমকে এভাবে বর্ণনা করা যায়-
ইন্দো-ইউরোপিয়ান- য়ুস এক্ব্যোম্ স্পেক্যিএথে
শতম- য়ূস এশ্বোম্ স্পেশিএথে।
আর্য- য়ূস অশ্বম্‌ স্পশ্যাথ্।
প্রাচীন ভারতীয় আর্য- য়ূয়ম অশ্বম্‌ স্পশ্যাথ্।
আদিম প্রাকৃত- তুষ্মে ঘোটকং দৃক্ষথ্।
প্রাচীন প্রাচ্য প্রাকৃত (পালি)- তুমহে ঘোটকং দেক্‌খথ্।
গৌড়ি প্রাকৃত- তুমহে ঘোড়াঅং দেক্‌খহ।
গৌড়ি অপভ্রংশ- তুমহে ঘোড়অ দেক্‌খহ।
প্রাচীন বাংলা- তুমহে ঘোড়া দেখহ।
মধ্য বাংলা- তুমহি ঘোড়া দেখহ।
আধুনিক বাংলা- তুমি ঘোড়া দেখ।
বাংলাভাষার এই বিবর্তনকে আমরা তিনটি সময়ে ভাগ করতে পারি- প্রাচীনযুগের বাংলা, মধ্যযুগের বাংলা এবং আধুনিক যুগের বাংলা। প্রাচীনযুগ (৬৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ) এখন পর্যন্ত বাংলাভাষার সর্বপ্রাচীন যে নমুনা পাওয়া গেছে, তা হলো চর্যাপদ। চর্যাপদের অন্য অনেকগুলো নামের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো চর্যাগীতিকোষ, দোহাকোষ, চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয় এবং চর্যাগীতিকা। ধারণা করা হয়, এটি পাল-আমলে রচিত। আচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেন- এই চর্যাপদই বাংলাসাহিত্যের আদি নিদর্শন। মধ্যযুগ (১৩৫০-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ) মুসলমানরা বাংলায় আসার আগে বাংলাভাষায় যেসব শব্দের প্রভাব ছিল, তা মূলত তৎসম, অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব, অস্ট্রিক (মুÐারি, সাঁওতালি) এবং দ্রাবিড় শব্দ। ১৪০০-১৮০০ সালের মধ্যে মুসলমনাদের হাত ধরেই বাংলাভাষায় আরবি, ফারসি, তুর্কি ইত্যাদি ভাষার প্রচুর শব্দ প্রবেশ করেছিল। আস্তে আস্তে এই শব্দগুলো বাংলাভাষার শব্দ ভাÐারকে সমৃদ্ধ করেছে। আধুনিকবাংলা (১৮০১-বর্তমান) আধুনিকবাংলা ভাষার দুটি প্রধান রূপ আছে: সাধু ও চলিত। ১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আধুনিকবাংলার যাত্রা শুরু। ১৮০১ সালে উইলিয়াম কেরিকে প্রধান করে এখানে বাংলা বিভাগ খোলা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে উইলিয়াম কেরি ও তার সহকর্মীগণ গদ্যের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন, এবং তাদের প্রচেষ্টায় বাংলায় গদ্যের আবির্ভাব হয়। আর এ সময়ই সাধু ভাষার আবির্ভাব ঘটে। মূলত সাধুভাষার আবির্ভাব হয়েছিল ভাষাকে একটি বিধিবদ্ধ রূপ দেয়ার প্রয়াসে। চতুর্দশ শতকে বাংলায় শুরু হয় মুসলমানদের সালতানাত। সালতানাত বাংলাকে এই অঞ্চলের সরকারী দরবারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। এই ধারাবাহিকতায় ক্রমেই বাংলার স্থানীয় ভাষায় পরিণত হয় বাংলা।
ষোড়শ শতকে মুঘলরা বাংলা দখল করলে বাংলাভাষার সাথে যোগসাজশ ঘটে ফার্সিভাষার। বর্তমান বাংলাভাষার আধুনিক রূপটি পাওয়া যায় ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের সময় বাংলার নদীয়া অঞ্চলে কথিত উপভাষায়। এই ভাষাটির দুটি ভাগ; শুদ্ধ এবং চলিত। এগুলোর ভিত্তি গড়েছে প্রধানত মাগধী প্রাকৃত এবং পালিসহ তুর্কি, পর্তুগিজ, ফার্সি ও ইংরেজি। প্রায় ১৩০০ বছরের দীর্ঘ বিবর্তনে বাংলাভাষার সাথে যুক্ত হয়েছে প্রচুর পরিমাণে দেশীয় এবং বিদেশী শব্দ। বহু শতাব্দীর পর ১৯শতকে এসে রাজা রাম মোহন রায় ও বিদ্যাসাগরের হাতে বাংলাভাষা চ‚ড়ান্ত রূপ পায়। আজ বাংলা মানব সভ্যতার ইতিহাসে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে একটি স্বতন্ত্র ভাষা।

বাংলালিপির উৎপত্তি
বাংলা বর্ণমালা এসেছে প্রাচীন ভারতীয় ‘ব্রাহ্মীলিপি’ থেকে। ভারতে সৃষ্ট এই ব্রাহ্মীলিপির পেছনে ফিনিশীয় লিপির প্রভাব আছে বলে দাবী করা হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতক থেকে ৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারতে ব্রাহ্মীলিপির প্রচলন ছিল।
এরপর মৌর্যবংশের সম্রাট অশোকের সময়ে এটি অশোকলিপি বা মৌর্যলিপিতে বিবর্তিত হতে থাকে। এর পরে আসে কুষাণলিপি, যা কুষাণ রাজাদের আমলে প্রচলিত ছিল। এরপর লিপিটি উত্তরী ও দক্ষিণী, এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। উত্তরী লিপিগুলোর মধ্যে পূর্বদেশীয় গুপ্তলিপি উল্লেখযোগ্য, যা ৪র্থ ও ৫ম শতাব্দীতে প্রচলিত ছিল। এই গুপ্তলিপি থেকে আবির্ভাব হয় কুটিললিপির, যা ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শতক পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। কুটিললিপি থেকে উদ্ভব হয় নাগরীলিপির। ১০ম শতকের শেষভাগে এসে প্রাচীন এই নাগরীলিপির প‚র্ব শাখা থেকেই উৎপত্তি হয়েছে বাংলালিপির। বাংলা, আসামি, এবং ওড়িয়া সবারই নিজস্ব লিপি রয়েছে, যা মূলত দেবনাগরীলিপি থেকেই উদ্ভ‚ত হয়েছে। পার্সিয়ান-অ্যারাবিক লিপি ব্যবহৃত হয় উর্দু, সিন্ধি (দেবনাগরীতেও লেখা হয়) এবং পাঞ্জাবি ভাষাতে।

ভাষার জন্য আত্মদান:
আধুনিক বাংলাভাষার জন্যেই ১৯৫২ সালে প্রাণ দিয়েছিলেন বাংলার সূর্য-সন্তান রফিক, বরকত, আব্দুস সালাম, আব্দুল জব্বারেরা। পঞ্চাশের দশকে ভারতের বিহার রাজ্যের (এরাও বাঙালি) মানভ‚ম জেলায়ও হয় বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন। ১৯৬১ সালে ভারতের শিলচরেও বাংলা ভাষার আন্দোলনে ১১ জন শহীদ হন। ১৯৯৯ সালের ১৭ মে ইউনেস্কো আমাদের ভাষা এবং ভাষা শহীদদের সম্মানে ‘একুশে ফেব্রæয়ারি’-কে আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা দিবসের মর্যাদা দেয়। শুধু তাই নয় আফ্রিকা মহাদেশের সিয়েরা লিওন নামের দেশটিও স¤প্রতি বাংলাকে তাদের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়েছে। পুরো পৃথিবীজুড়ে প্রায় সাড়ে সাতাশ কোটির বেশি মানুষ বাংলায় কথা বলে। ভাষাভাষী লোকসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর সপ্তম এবং একই সাথে তিনটি দেশের রাষ্ট্রভাষা ‘আমাদের প্রাণের বাংলা’!