কেমন করে লেখালেখিতে এলাম

8

আবুল কালাম বেলাল

আমি তখন নিতান্তই শিশু। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। একদিন হেড স্যার (আবদুল গফুর মাস্টার) শুনিয়ে দিলেন- “বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ঐ/মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই?” আহ কী সুন্দর কবিতা! বাঁশবাগান, চাঁদ, কাজলা দিদি! তাও আবার শোলক বলা! কই?
কবিতাটি শুনে মূহূর্তেই আমি মোহাবিস্ট হয়ে যাই। আমার ভেতরে এক ধরনের ভালো লাগার আবেশ ছুঁয়ে যায়। কবিতার ছন্দ সুরের মুগ্ধতায় হারিয়ে যাই! ভাবের বিষয়টি তখনও কাজ করেনি মনে। মূলত কবিতার আবহ সুরটিই টেনেছিল আমাকে। চিত্রকল্পময় সহজপাঠ্য এ কবিতার আবেদনে কে না আমোদিত হয়? পঙক্তিমালায় সেই যে আমার মুগ্ধতা- তা পরবর্তীতে ছড়া-কবিতা পাঠে আমাকে আরও আগ্রহী করে তুলে। শ্রেণি থেকে শ্রেণিতে যতই যাই কবিতার প্রতি আকর্ষণ ততই বাড়তে থাকে। পড়তে থাকি পাঠ্যবইয়ের কবিতাগুলো। আমাকে কবিতাঘোরে পেয়ে বসে। অঙ্ক খাতায় কবিতার প্রেমপত্র রচিত হতে থাকে। অবচেতন মনেই চলছিল শব্দের কাটাকুটি। এভাবে ক্লাস সেভেনে কি এইটে- মহান স্বাধীনতা দিবসের ইশকুল দেয়ালিকায় পদ্য বিভাগে প্রথম হস্তাক্ষরে উৎকীর্ণ হয় আমার নামটি- মো. আবুল কালাম। পদ্যসমেত নিজের নামটি দেখে কী যে পুলকিত ও আনন্দিত হয়েছিলাম- তা বোঝাতে পারব না। আমার আবেগী প্রথম প্রেম- একবার দেখি বার বার দেখি… ছাত্রসখাদেরও দেখাই প্রসন্নচিত্তে। সেই স্মৃতি মনে এলে এখনও পুলকিত হই। আজও যেন হৃদয়ের বাঁকে বাঁকে বয়ে যায় সে-খুশির ফল্গুধারা। সেদিন সাহিত্যে আমার উৎসাহ দেখে স্যারেরাও মুগ্ধ হন। বিশেষ করে প্রধান শিক্ষক দীলিপ ঘোষ। তিনি আমাকে আরও বিস্মিত করে পরবর্তীতে ‘তালেব মাস্টারের হালখাতা’ নামের একটি নাটকেও অভিনয়ের সুযোগ করে দেন।
সে যা হোক, ইশকুলবেলা শেষে ১৯৮১ সালে পটিয়া সরকারি কলেজে (প্রথমবর্ষে) ভর্তি হই। তখন আমাদের গ্রাম আশিয়া থেকে কাঁচারাস্তা মাড়িয়ে আমজুর হাট হয়ে কলেজে যেতে হতো। একদিন, কলেজে যাওয়ার সময়, পথিমধ্যে দেখা হয়ে যায় পাড়াতো চাচা বিশিষ্ট রাজনীতিক (ভাসানী ন্যাপে দীক্ষিত) আবদুল গফ্ফার খান-এর সাথে। তাঁকে সালাম দিতেই তিনি পথরোধ করে দাঁড়িয়ে যান।
‘ভাতিজা কেমন আছো?’
‘ভালো আছি চাচা।’
‘কলেজে যাচ্ছো?’
‘জি¦।’
‘বেশ। তুমি আমাদের ইশকুলের ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়া ছাত্র। কলেজেও সেই সুনাম অক্ষুণœ রাখতে হবে। ভালোভাবে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে হবে। কেবল পাঠ্যবই নয়, পাশাপাশি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন, গল্প-কবিতার বইও পড়তে হবে। এই নাও এগুলো রাখো। অবসরে পড়বে।’
আমার হাতে রাশিয়ার বাংলা ভার্সন পত্রিকা ‘উদয়ন’ আর ভারতীয় ‘সানডে’ পত্রিকা গুজে দিয়ে যেতে যেতে বললেন, বিচিত্রা, সচিত্র সন্ধানী ইত্যাদিও পড়ো। আমিও সালাম জানিয়ে পথচলা শুরু করি। কলেজে গিয়ে নির্জনে আগ্রহভরে পত্রিকা দুটো খুলে দেখি- গল্প-প্রবন্ধ, ছড়া-কবিতা, ভ্রমণকাহিনি, চিঠিপত্রসহ আরও কত কী! প্রথম দর্শনেই উদয়নের প্রেমে পড়ে গেলাম। পরে গ্রাহক হয়ে নিয়মিত পাঠ করতে থাকলাম। ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা। অতপর গোপন সংশ্লিষ্টতা। পত্রিকাটি উসকে দিলো আমাকে কলম হাতে তুলে নিতে। কিন্তু কী লিখব? শুরুটা হলো চিঠিপত্র দিয়েই। উদয়ন তো বটেই বিচিত্রা, সচিত্র সন্ধানী থেকে শুরু করে দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোতে আমার নাম ছাপা হতে লাগল। এই করতে করতে এইচএসসি পরীক্ষার্থী। বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় অবসর খুব একটা পেতাম না। যা মিলত তাতে সদর্পে কলম ধরেছি। সে যা হোক, ১৯৮৩ সালের প্রথম দিকে এইচএসসি পরীক্ষার আগে একদিন বাড়ি ফেরার পথে সাম্পানে পরিচয় হয় আবদুর রউফের সাথে। যিনি এখন রাশেদ রউফ নামে পাঠকের কাছে ব্যাপক সমাদৃত। খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সংগঠক। বর্ষাকালে যাতায়াতে কর্দমাক্ত রাস্তার দুর্ভোগ থেকে রেহাই পেতে আমরা মাঝে মধ্যে ইন্দ্রপুল থেকে সাম্পানে চানখালি নদীপথে বাড়ি ফিরতাম। এ নদীর পূর্বপাশে ছনহরা আর পশ্চিমপাশে আশিয়া। তিনি (রাশেদ রউফ) নামতেন শ্রীমাই খালের বাঁকে, আর আমি কেরিঞ্জা ঘাটে। এইচএসসি পরীক্ষা শেষে যখন শহরে এলাম মাঝির ঘাটে পুনরায় দেখা হয় তার সাথে। স্মৃতির বেহাগ বাজিয়ে দুজনের সম্পর্ক গাঢ় হতে থাকে। যা আজ অবধি অটুট। এখানে এসেই রাশেদ রউফকে আবিষ্কার করি তুখোড় পত্রলেখক হিসেবে। যেহেতু আমিও ছিলাম পত্রলেখক। তাই দুজনের মধ্যে মনের মিল ঘটে যায়। শুরু হয় দেখা-আড্ডা। আড্ডার অন্যমুখ কবি আজিজ রাহমান, কবি রহমান হাবিব, প্রফেসর ছালেহ জহুর, বখতেয়ার হোসেন, মোহাম্মদ ইলিয়াস (প্রয়াত), মোহাম্মদ খোয়াজ সহ আরও অনেকের সাথে আমিও যুক্ত হয়ে যাই। সাধারণ আড্ডা রূপ নেয় সাহিত্য আড্ডায়। আমরা সমমনা ক’জন গড়ে তুলি সাহিত্য সংগঠন ‘অভিযান’। এ সংগঠন দিয়েই আমার লেখালেখির নতুন পথযাত্রা। সংগঠনের নিয়মিত আড্ডায় গল্প, প্রবন্ধ, ছড়া-কবিতা পঠন-পাঠন, আলোচনা চলতে লাগল। মূলত বড়দের সাহিত্যচর্চাই বেশি হত। এখান থেকেই বের হতো বড়দের সাহিত্য উপযোগী লিটল ম্যাগ ‘প্রেরণা’। সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন রাশেদ রউফ। সম্পাদনা পরিষদে আমারও থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। এর সুবাদে আমার সাহিত্যচর্চাও পূর্ণোদ্যমে এগিয়ে যেতে লাগল। বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিকে, সাপ্তাহিকে, মাসিক পত্র-পত্রিকায় আমার ছড়া-কবিতা-গল্প মুদ্রিত হতে থাকে। সোৎসাহে পড়ছি, লিখছি আর আড্ডা-আসরে অংশ নিচ্ছি। কখনো রাশেদ রউফ এর ব্যাচেলর রুমে, কখনো সদরঘাটস্থ বিআইডব্লিউটিসি’র সবুজ চত্বরে। বেশ কয়েকটি সাহিত্য আড্ডা আমার হাতে লেখা ব্যানার টাঙিয়েও অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আমরা নতুন স্বপ্নে, নতুন উদ্যোমে, নতুন উচ্ছ্বাসে এগিয়ে যেতে থাকি।
১৯৮৫ সালে আমরা যুক্ত হই স্বকাল শিশুসাহিত্য সংসদ-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক রহীম শাহ’র আমন্ত্রণে লালদিঘির সবুজ চত্বরে সাহিত্য আসরে। এখানে এসে পাই কবি আহসান মালেক, কবি সেলিনা শেলী, শিশুসাহিত্যিক এমরান চৌধুরী, কবি ইকবাল বাবুল, ছড়াকার উৎপলকান্তি বড়ুয়া, ছড়াকার জসীম মেহবুব, কবি অরুণ শীল, ছড়াকার অনিল চক্রবর্তী, কবি রমজান আলী মামুন, গল্পকার ইফতেখার মারুফ, ছড়াকার অপু বড়–য়া, ছড়াকার গোফরান উদ্দীন টিটুসহ আরও অনেক শিশুসাহিত্যিককে।
বলাই বাহুল্য, সাহিত্যাসরে পঠিত লেখার উপর অগ্রজদের ইতিবাচক চুলচেরা বিশ্লেষণ ও আলোচনা চলত। আসরে আমরা প্রায় সময় দুরু দুরু বক্ষে হাজির হতাম। কিন্তু অগ্রজ আলোচকরা কখনো ‘প্রতিশ্রæতিশীল’, কখনো ‘সম্ভাবনাময়’, কখনো ‘ভালো’ ইত্যাদি পূর্বাভাষ দিয়ে আমাদের অনুপ্রাণিত করতেন। আমরা নিজেদের আরও ভালো লেখার প্রয়াস চালিয়ে যেতাম।
ভেতরে ভেতরে নিজেকে গড়ে তোলার কাজও। প্রস্তুতি না নিয়ে কি লেখক হওয়া যায়? তাই গোগ্রাসে গিলতে থাকি, রবীন্দ্র-নজরুল-জসীম-সুকান্ত-সুকুমার রায় এরা তো আছেনই-নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতার ক্লাস, জীবনানন্দ দাশের কবিতার কথা, বুদ্ধদেব বসুর কালের পুতুল, শঙ্খ ঘোষের নিঃশব্দের তর্জনী, এ আমির আবরণ, পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের কবির কাজ, পাবলো নেরুদার অনুস্মৃতি, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বাংলা সাহিত্যের কথা, আবদুল মান্নান সৈয়দের ছন্দ, দশ দিগন্তের দ্রষ্টা, হুমায়ুন আজাদের লাল নীল দীপাবলিসহ আরও কত বই। পাঠ আর পাঠ। আড্ডা আর আড্ডা। সমানতালে লেখার চেষ্টাও। মূলত আমার লেখালেখির মূল শক্তি, সাহস, প্রেরণা এখান থেকেই। বলা যায়, আমি কেমন করে- ‘এমন’ নই, ‘লেখালেখিতে এলাম’ তার সূত্রপাত মোটা দাগে এই-ই।
লেখালেখির এই ফাঁকে ১৯৮৫ সালে আমরা পেয়ে যাই প্রিয় কবি খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক সুজন বড়–য়ার ‘বাড়ির সাথে আড়ি’। এটি ছিল সবাইকে তাক লাগানো নির্ভেজাল কিশোরকবিতার মডেলগ্রন্থ। বইটি আমাদের এলোপাথাড়ি লেখালেখি থেকে কিশোরকবিতার ছাদের নিচে নিয়ে আসে। আমরা কিশোরকবিতার মোহ-মায়ায় উদ্দীপ্ত হই। রচনা করতে থাকি একেকটি কিশোরকবিতা। বেগবান হতে থাকে সাহিত্যচর্চার নামে কিশোরকবিতা চর্চা। এ ধারাকে প্রতিষ্ঠিত করতে আমরা ‘অভিযান লেখকগোষ্ঠী’ লড়াকু ভূমিকায় অবতীর্ণ হই। ১৯৮৯ সালের ২২ ডিসেম্বর কবি রাশেদ রউফের উদ্যোগে বাংলাদেশে প্রথম কিশোরকবিতা নগরীর জে এম সেন হলে অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলন সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। জোয়ার আসতে থাকে কিশোরকবিতার আঙিনায়। ১৯৯১ সালে বের করেন কবি আখতার হুসেন, সুজন বড়ুয়া ও রহীম শাহ সম্পাদকত্রয় ‘বাংলাদেশের বাছাই কিশোরকবিতা’ সংকলন। এতে আমারও একটি কিশোরকবিতা ভুক্ত হয়। এসময়ে আমার প্রচুর ছড়া-কবিতা লেখা হয়ে যায়। বলে নিতে চাই, ১৯৮৬ সালে দৈনিক আজাদী’র ‘আগামীদের আসরে’ প্রথম প্রকাশ পায় ‘খেক শিয়ালের বিয়ে’ নামে একটি ছড়া। এর মধ্য দিয়েই আমার সাহিত্যে প্রকাশজীবন শুরু। ছড়া দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও কিশোরকবিতার ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কেমন করে যেন এ ক্ষেত্রে বিচরণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রেও আমার প্রথম ভালোবাসা কিশোরকবিতার বই হাতে কাছে ফড়িং নাচে। এরপর একে একে আয়রে সবুজ আয়রে অবুঝ, মাগো তোর শ্যামল মায়ায়, স্বপ্নের রঙে দেশ, রক্তে ভেজা সবুজ মাটি, সাতসকালের পাখি, প্রিয় দেশ প্রিয় স্বাধীনতা, নির্বাচিত কিশোরকবিতা প্রকাশিত হয়। অথচ ছড়াগ্রন্থ মাত্র দুটি- নাক ড্যাঙা ড্যাং ড্যাং, তাল বেতালের তাল।
তবে প্রথম সন্তানের মুখ প্রথম দর্শনে যে আনন্দ পেয়েছিলাম তা ছিল অভূতপূর্ব। পরবর্তীতে সে-আনন্দ কিছুটা কমতে থাকে। প্রথমদিকের আবেগে লাগাম টেনে ধরে এখন দায়িত্বশীলতার ভূমিকায় লেখার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি। লক্ষ্য, পাঠককে প্রীত করার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা। একে শাণিত করতে পাঠকের ভালোবাসাই হতে পারে নিয়ামক তথা সহায়ক মহার্ঘ। সবার জন্য শুভ কামনা।