কেমন করে এমন হলাম

2

অরুণ শীল

কত গুণীজন ভালো ভালো কাজ করে মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন, সুনাম কুড়িয়েছেন। ওরকম কিছুই আমি আজও করতে পারিনি। ওই ছোটোদের জন্য কিছু গল্প কবিতা ছড়া লিখেছি মাত্র। এটুকু লেখার কারণে হয়তো দু’চারজন আমাকে চিনতে পারেন। ‘অরুণ শীল ছড়া লেখে’ এই আমার পরিচিতি। আর এতেই আমি খুশি।
ছড়া লিখতে আমার একটুও কষ্ট করতে হয়নি। শৈশবে দেখেছি অবসর সময়ে মা রামায়ণ মহাভারত পড়তেন। বর্ষায় পড়তেন মনসার পুথি। দূর্গাপুজোর সময় পড়তেন জাগরণ পুথি। মায়ের পাশে বসে শুনতে শুনতে সেই সুর সেই ছন্দ মনে গেঁথে গিয়েছিল। আমাদের শৈশবে গ্রামে কবিগান হতো। কবিরা সুর করে পদের সাথে পদ মিলিয়ে কথা বলতেন। আমাদের গ্রামেও কয়েকজন এভাবে মিল দিয়ে কথা বলতেন, মানুষজন হাসতেন, আনন্দ পেতেন। তাদের মতো মিল দিয়ে মনে মনে কথা বলতে আমারও ভালো লাগতো। গোপনে মুখে মুখে ছড়া বানাতাম।
স্কুল পাঠ্য বইয়ের কবিতা ছড়াগুলো আমরা উচ্চস্বরে পড়তাম, আবৃত্তি করতাম। পত্রিকার ছোটোদের পাতার ছড়া গল্পগুলো আনন্দের সাথে দেখতাম, পড়তাম। তখন বাড়ির সামনে মৌলভীহাটে দৈনিক আজাদী, দৈনিক নয়াবাংলা, দৈনিক স্বাধীনতা পত্রিকা নিয়মিত দেখা হতো, মাঝে মধ্যে পেতাম দৈনিক ইত্তেফাক ও সংবাদ। পত্রিকার ছোটদের পাতাগুলো আমাকে খুব আকর্ষণ করতো। ওভাবে লেখার চেষ্টা করতাম। মাকে দেখাতাম। মা পড়তেন আর হাসতেন। স্কুলে বন্ধুদের দেখাতাম, সবাই উৎসাহ দিতেন। ১৯৭৭ সালে আমার লেখা ছড়া দৈনিক আজাদীর আগামীদের আসরে প্রথম ছাপা হয়। আমার সদস্য নম্বর ছিল ২৯৪৯। কি যে খুশি লেগেছিল বোঝাতে পারবো না। তারপর দেশের প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় লেখা ছাপানোর মোহে, নিজের নাম ছাপার অক্ষরে দেখার লোভে কত ছড়া আর ছড়া লিখেছি, মাঝে মধ্যে দু’একটা গল্প।
ছড়া গল্প হচ্ছে, কী হচ্ছে না; কেমন হচ্ছে এসব আলোচনা করার মতো কোনো লেখক কবির সাথে আমার পরিচয় ছিল না। তখন আমি পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র। পরের বছর আমি এসএসসি পরীক্ষা দেবো। বন্ধু মোহাম্মদ আবছার আমার সব লেখা পড়ে দেখে উৎসাহ দিতো। আমাদের বাংলা বইতে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর একটি গদ্য ছিল ‘পল্লী সাহিত্য’। ওটা পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে আবছারকে সাথে নিয়ে গঠন করি পল্লীসাহিত্য গোষ্ঠী নামে একটি পাঠাগার। বিভিন্ন দিক থেকে লেখা সংগ্রহ করে মাসে একটি দেওয়ালপত্রিকা করতাম।
বন্ধু প্রদীপ মুৎসুদ্দির হাতের লেখা ছিল মুক্তোর মতো (বর্তমানে বান্দরবন সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ)। সে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিতো। তার ঘর ছিল উনাইনপুরা কেয়াংয়ের (লংকারাম বিহার) পাশে। কিভাবে যেন ভান্তে ধর্মসেন মহাস্থবির খবর পেয়ে যান (পরে তিনি সংঘরাজ ছিলেন)। তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে খুব উৎসাহ দিলেন। কয়েকটি বই পড়তে দিলেন। আমার প্রাইমারি শিক্ষক আনন্দমিত্র বড়ুয়া স্যারের উৎসাহে ও সহযোগিতায় আমরা প্রকাশ করি পল্লীসাহিত্য গোষ্ঠীর ম্যাগাজিন ‘রূপক’। পটিয়া স্কুলের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক তরনীসেন বড়ুয়া ও মোহাম্মদ ইউনুস স্যার আমার ছড়া পড়তেন, খোঁজ খবর নিতেন। স্কুল লাইব্রেরি থেকে বিভিন্ন ধরনের বই পড়তে দিতেন। স্যারসহ বন্ধু-স্বজন সবার উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় আমার লেখার গতি বেড়ে যায়। স্কুল ও গ্রামের প্রায় সবাই জেনে গেছে আমি পত্রিকায় ছড়া লিখি। পত্রিকার হকার কাকুরাও আমার জন্য পত্রিকা রেখে দিতেন।
তখন দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল আর ছাত্র হিসেবে আমরা ছিলাম ¯েøাগান মুখর। তাই আমার ছড়ায় ¯েøাগানের প্রভাব পড়ে। প্রত্যেক শিল্প-চিন্তার একটি স্থানিকতা থাকে। মানুষের চিন্তা চেতনায় জল-হাওয়ার ভূমিকা অপরিসীম। ফলে আমার ছড়াও গনমুখী হয়ে ওঠে। ১৯৭৯ সালে কলেজে ভর্তি হয়ে চট্টগ্রাম শহরে চলে এলে অনেকের সাথে আমার পরিচয় ও সখ্যতা হয়। আমার ছড়ার ভালো মন্দ বুঝতে শিখি। ছড়াসূত্রে পরিচয় হয় সুজন বড়ুয়া, অজয় দাশগুপ্ত, ওমর কায়সার, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, উত্তম সেন, জসীম মেহবুব, কেশব জিপসী, এমরান চৌধুরী, আহসান মালেক, রহীম শাহ ও উৎপলকান্তি বড়ুয়াসহ অনেকের সাথে। এছাড়াও চট্টগ্রামের অনেক গুনীজনের সান্নিধ্য লাভ করি। বন্ধুদের পরামর্শে জনমুখী ছড়ার চেয়ে শিশুতোষ ছড়া লেখার চেষ্টা করি। ছোটদের জন্য লিখতে পারার আনন্দ অনেক।

এই নিয়ে আমার একটি ছড়া-
ছড়া লিখি ছড়া বলি ছোটোদের জন্য
ছড়া শুনে তারা হাসে, হাসিটা অনন্য
ছড়া কই? ছড়া বলো, ধরে তারা বায়না
কেউ বলে, ছড়া বুড়ো, ছড়া নিয়ে আয় না
ছড়া শুনে কলরোলে জেগে ওঠে পাড়াও
হাসি মুখে চুমু দিই, চুমু দেয় তারাও
ফুল হয়ে হাসে তারা স্বর্গীয় গন্ধ
মনপ্রাণ নেচে ওঠে, আহ্ কী আনন্দ!
শোনে ছড়া কবিতাও, খুশি তারা অল্পে
কেউ ডুব দিতে চায় রূপকথা গল্পে
আমি তাই ছড়া বলি ছোটোদের জন্য
প্রাণ খুলে হাসে তারা, হাসিটা অনন্য।

আমার ছড়া কবিতা ও গল্প পড়ে ছোটরা যদি হাসে, খুশি হয়, হাততালি দেয় তবেই আমি সার্থক।
পেশাগত ব্যস্ততার কারণে ১৯৮৬ সাল থেকে ছড়া কবিতা লেখা ধিরে ধিরে কমতে থাকে। দেশের দূর-দূরান্তে বদলির কারণে শিশুসাহিত্যিক বন্ধুদের থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ি। একটু স্থির হয়ে ১৯৯৪ সাল থেকে আবার লিখতে শুরু করি। তখন খুবই জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক আজকের কাগজ-এ নিয়মিত আমার ‘বীর জনতার ছড়া’ প্রকাশিত হতে থাকে।
বন্ধু কেশব জিপসী ও জসীম মেহবুবের সহায়তায় পান্ডুলিপি তৈরি হয় ও কবি রাশেদ রউফের সংস্পর্শে আসি। শৈলী প্রকাশন থেকে ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় আমার প্রথম ছড়ার বই ‘বীর জনতার ছড়া’। এটি শৈলী প্রকাশনের দ্বিতীয় প্রকাশনা এবং প্রথম ছড়ার বই। রাশেদ রউফ এর অনুপ্রেরণায় কিশোরকবিতা চর্চার মনোনিবেশ করি এবং কবি সুজন বড়ুয়ার সাহচার্য পাই। ফলে দ্রæত বেশকিছু ভালো কিশোরকবিতা পড়া ও লেখা হয়ে যায়। কবিতার সুবাদে শ্রদ্ধেয় রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের স্নেহময় স্পর্শ পাই, তিনি আমার কবিতা পড়ে প্রশংসা করেন ও ইত্তেফাকে নিয়মিত প্রকাশ করেন। ১৯৯৬ সালে শৈলী থেকে প্রকাশিত হয় আমার গল্পগ্রন্থ ‘পেট্রোবাংলার ভূত’। ১৯৯৭ সালে কিশোরকবিতার বই ‘মেঘের দেশে আলোর ঘোড়া’ এবং আমি নিয়মিত লেখক হয়ে উঠতে চেষ্টা করি। এপর্যন্ত ২২ বই প্রকাশিত হয়েছে। আজ পর্যন্ত আমার যতটুকু অর্জন হয়েছে তৎজন্য আমি কবি রাশেদ রউফ ও কবি সুজন বড়ুয়ার কাছে আজন্ম ঋণী হয়ে আছি।
১৯৯৮ সালে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সান্নিধ্যে এসে স্কুল ভিত্তিক বই পড়ানোর কাছে আত্মনিয়োগ করি। গড়ে তুলি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, চট্টগ্রাম বন্দর শাখা। ১৯৯৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সে কী উদ্দীপনাপূর্ণ সময়। কত তারুণ্যের সাথে সংযোগ! ক্লাস সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত ১৬টি করে ১৬০টি বই। এই বইগুলো ১৯৯৮ সালেই পড়ে নিতে হয়েছে। তার পাশাপাশি কলেজ কর্মসূচির বই। বইয়ের এক বিশাল জগতে প্রবেশ করে আমি অভিভূত হয়ে পড়ি। দেশ বিখ্যাত লেখক সাহিত্যিকদের সঙ্গ আমাকে মুগ্ধ করে। বইপড়া কর্মসূচির কল্যাণে ২২টি স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের সাথে পরিচয় হয়েছে, বন্ধুত্ব হয়েছে। তাদের ইচ্ছে অনিচ্ছা সম্পর্কে ধারণা হয়েছে। তাদের মনোজগতে প্রবেশের চেষ্টা করেছি। ছোটোদের বন্ধু হতে না পারলে আজ ছোটোদের লেখক হতে পারতাম কি না সন্দেহ।
আমি নিজেকে একজন শিশুসাহিত্যিক ছাড়া আর কিছুই ভাবি না। শিশু আপন মনে খেলে আনন্দ অনুভব করে। আমিও লেখালেখি করে নিজে আনন্দ পাই ও ছোটোদের আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করি। আমার বুকের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে শিশু-কিশোরদের জন্য সাহিত্য সৃষ্টি করতে চাই। হয়তো জনপ্রিয় হতে পারিনি।
সস্তা জনপ্রিয়তা চাইও না। ভালো কিছু লেখার চেষ্টা করেছি এবং করছি। এখানে আমি ফাঁকি দিইনি ও দেবো না। এতদিনের পরিশ্রমের স্বীকৃতি স্বরূপ কয়েকটি পুরস্কারও পেয়েছি, তৎমধ্যে চসিক একুশে সাহিত্য সম্মাননা, এম. নূরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার, বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি পদক, প্রতীকী ছড়াসাহিত্য পুরস্কার অন্যতম। একজন লেখকের জীবনে পুরস্কারের ভূমিকা অপরিসীম, যদি সে পুরস্কার হয় খাঁটি ও নিখুঁত। এসব পুরস্কার আমার দ্বায়িত্ববোধ বৃদ্ধি করেছে। তাই, একজন প্রকৃত শিশুসাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই।
আমি পাড়া গাঁয়ের ছেলে। কর্মের খাতিরে শহরে বাস করলেও নাড়িরটান সবসময় গ্রামের দিকে। তাই গ্রাম বাংলার প্রকৃতি আমার কবিতার উপজীব্য।
চট্টগ্রামের মেঘ রোদ্দুর সাগরের নোনা ঘ্রাণ, শ্যামল পাহাড়ের উতলা হাওয়া, নদীর কলতান ও সুঘ্রাণ আমার কবিতায় ধারন করার চেষ্টা করি। এই গ্রাম্যতা আমার সৃষ্টি চেতনাকে সজীব রেখেছে। একজন শিশুসাহিত্যিক হিসেবে বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করি। অস¤প্রদায়িক মূল্যবোধ মনে লালন করি। মানবিকতা ও সহনশীলতার চর্চা করি। লেখায় দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধ জাগ্রত করে ছোটোদের মনে বড় স্বপ্ন ও প্রেরণা সৃষ্টি করতে চাই।