কেমন করে এমন হলাম

8

পংকজ দেব অপু

আমি তখন কাটিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক ম্যাগাজিন ‘উদগম’ প্রকাশনার একটি সংবাদ নোটিশ বোর্ডে পেয়ে আমার ভেতরে হঠাৎ জেগে উঠলো দুর্দান্ত কবি সত্তা। বাবা নৃপেন্দ্রনাথ দেব ছিলেন স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। ম্যাগাজিন সম্পাদনার গুরু দায়িত্বও তাঁরই কাঁধে। আমাকে আর পায় কে! রাত জেগে লিখে ফেললাম একটি ছড়া। দুয়েকটা শব্দ পরিবর্তন করে সেটা বাবা ছাপালেন। এ ছড়া যেহেতু আমার জীবনের প্রথম মুদ্রিত লেখা, ভেতরে ভেতরে প্রবল উত্তেজনা অনুভব করলাম। ঠিকমতো ঘুমাতেই যেন পারছিলাম না। বারবার নিজের নামটা দেখার জন্য বুকের উপরেই ঠাঁই দিলাম ‘উদগম’কে। বন্ধুরা যখন লেখা পড়ে অভিনন্দন জানালো তখন থেকেই ভাবতে শুরু করলাম আমাকে অবশ্যই কবি হতে হবে। নবম শ্রেণিতে উঠে মাইকেল প্রভাবিত হয়ে লিখে ফেললাম ‘বসন্ত’ শিরোনামে একটি সনেট। সোজা কথা নয়-চৌদ্দ লাইন চৌদ্দ অক্ষর। নিজের প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ। কিন্তু আমার এক পিসি কিছুতেই বিশ্বাস করলো না এটা আমারই লেখা। তিনি বললেন-এটা কি তোর বাবা লিখে দিয়েছে? প্রচন্ড আত্মসম্মানে লাগল। কষ্ট পেলেও ভেতরের ‘কবি’কে জাগিয়ে রেখেছি নিশিদিন। বিজ্ঞানের ছাত্র। প্রি টেস্ট পরীক্ষার রসায়নের খাতায় ‘আকরিক’ লিখতে গিয়ে ছন্দে ছন্দে লিখলাম ‘খনিজ হইতে তুলিতে দ্রব্য পেয়ে লাভ পুরোধিক/নিষ্কাশনের এ ক্রিয়াকে বলা হয় আকরিক’। নিষ্কাশনের ক্রিয়া যে আকরিক নয় সেটা তাৎক্ষণিক আবেগে উপলব্ধি করতে পারিনি। বোধোদয় হল তখন, যখন স্যার এটা কেটে শূন্য বসিয়ে দিলেন। ক্লাশে খাতা দেখাবার সময় ভর্ৎসনা করে বললেন, ‘এটা রসায়নের খাতা, তোমার কবিতার খাতা নয়, তুমি যাচ্ছেতাই লিখতে পার না।’ হায় কবিসত্তা! তোমাকে বুঝি আর বাঁচিয়ে রাখা গেল না। এবার পড়াশোনায় দারুণ মনোযোগী। টেস্ট পরীক্ষায় সেকেন্ড হলাম। ভালো ফলাফল হল মাধ্যমিকে। রাঙ্গুনিয়া কলেজে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে আবার ফিরে পেলাম কাব্যদেবীকে। দৈনিক আজাদীর ‘আগামীদের আসর’ এর সদস্য হলাম। প্রতিদিন লিখছি আর পাঠিয়েই যাচ্ছি। কিন্তু আসরের নিষ্ঠুর ‘ভাইয়া’ লেখা ছাপাবেন না হয়তো এমন পণ করেই বসে আছেন। কোনো এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে ‘আগামীদের আসর’ এ ছাপা হল আমার প্রথম ছড়া ‘পড়ার চাপ’। সুবিখ্যাত পত্রিকা দৈনিক আজাদীই আমাকে ছড়াকার হিসেবে প্রথম স্বীকৃতি দিল। আমার আনন্দ দেখে কে? আগামীদের আসরে লিখতে গিয়ে দারুণ অনুপ্রেরণা পেয়েছি ভাইয়া শ্রদ্ধাভাজন আতাউল হাকিমের কাছ থেকে। অতঃপর দৈনিক নয়াবাংলা পত্রিকার ‘ছোটদের মজলিস’। এ পাতায় আমার অসংখ্য ছড়া কবিতা ছাপিয়ে আমার সাহিত্য রচনার ভিত তৈরি করে দিয়েছেন ভাইজান শামসুল হক হায়দরী (এনটিভির চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান)। মজলিসের পাতায় ‘একটি মেয়ের গল্প’ শিরোনামের কিশোর কবিতা পাঠ করে বর্তমানের খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক রহীম শাহ্ আমার সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য রাউজানের ঊনসত্তরপাড়া আমার বাবার (প্রধান শিক্ষক, ঊনসত্তরপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়) কর্মস্থলে গিয়েছিলেন। এটা আমার জীবনে বিশাল এক প্রাপ্তির ঘটনা। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার মাসখানেক আগে আমার ছড়া দৈনিক সংবাদের ‘খেলাঘর’ পাতায় প্রকাশিত হতে দেখে আমার বড় মামা (সুদর্শন চৌধুরী, প্রধান শিক্ষক, আধারমাণিক উচ্চ বিদ্যালয়) আমাকে ভীষণ বকা দিয়েছিলেন। বিজ্ঞানের ছাত্র পরীক্ষার আগে কবিতা লিখবে কেন! তখন আমাকে রোখে এমন সাধ্য কার! চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তি হয়েছি। আমার ভালোলাগার বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে। বাংলাদেশের তখনকার বহুলপ্রচারিত দৈনিক ইত্তেফাকের ‘কচিকাঁচার আসর’ তখন আমার টার্গেট। এ পাতায় লেখা ছাপাতেই হবে। পরিচালক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের পাতা বলে কথা। বহুদিন বহু লেখা পাঠাবার পর একদিন একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়ে গেল। তার প্রতিক্রিয়া আসলো সুইডেন থেকে আমার এক পিসতুতো ভাইয়ের ফোনে। অনলাইন সিস্টেম না থাকলেও তার কাছ থেকে জেনেছি ইত্তেফাক নাকি বিমানে বিভিন্ন দেশে পাঠানো হত। একটা লেখা প্রকাশের পর আমাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। অনেকগুলো প্রবন্ধ দাদাভাইয়ের পাতায় ছাপা হতে থাকলো দিনের পর দিন। অনার্সের ক্লাশে একদিন ড. সৌরেন বিশ্বাস স্যার বললেন, ‘আজকের ইত্তেফাকে তোমার একটা লেখা দেখলাম মনে হয়।’ এটা যে আমার জন্য কতোটা গৌরবের ছিল বলে বোঝানো যাবে না। চট্টগ্রামে একটি অনুষ্ঠানে শিশুসাহিত্যিক রহীম শাহ্ আমাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন প্রখ্যাত ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটনের সাথে। আমার নাম উচ্চারণ করতেই আমি বিব্রত হয়ে বললাম ‘আমি ছোট মানুষ আমাকে কি রিটনদার মতো বিখ্যাত মানুষ চিনবেন?’ রিটনদা বললেন- চিনতেই হবে। ইত্তেফাকে তোমার লেখা পড়েছি। এম, এ পরীক্ষায় অংশ নিতে নিতেই আমার চিন্তা-চেতনার সাথে প্রবলভাবে সংযুক্ত হল গান। বেতার-টিভির গীতিকবি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে পূর্ণোদ্যমে রচনা করতে থাকলাম গান। পাশাপাশি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু ড. মাহবুবুল হক স্যারের সম্পাদনায় ‘আজাদী ফিচার’ লেখার সাথে যুক্ত হয়েছি। তারপর দৈনিক আজাদী পত্রিকায় শিক্ষা ও বিভিন্ন বিষয়ে অনেক প্রবন্ধ লিখেছি উপসম্পাদকীয় পাতায়। এগুলো প্রকাশে আমাকে উদারভাবে সহযোগিতা দিয়েছেন আমার সমসাময়িক কালের লেখক আজাদীর সহযোগী সম্পাদক বাংলা একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত রাশেদ রউফ ভাই। একসময় গীতিকবিতা রচনাই হয়ে গেল আমার আরাধ্য, আমার ধ্যান-জ্ঞান। এটা অবশ্য ভিন্ন এক গল্প।