একগুচ্ছ কিশোরকবিতা ‘সবুজের সাথে মন মাতাতে’

7

কুমুদনী কলি

‘মেঘ তোমাকে দিলাম ছুটি আজ’। ভীষণ ভালোলাগার একটি কবিতা। এতটা ভালো লেগেছে, বারবার পড়েছি। যদিও শিশুতোষ কবিতা, তবুও পড়েছি। কারণ আমরা প্রত্যেকেই একটি শিশুমন লালন করি নিজেদের মধ্যে। শৈশবকে ধারণ করি, সুন্দর সময়কে মনে করতে গিয়ে শৈশবকে তুলে ধরি। শৈশব আমাদের কাছে ভীষণ আদুরে, ভীষণ কোমল, ভীষণভাবে দামী একটা সময়। আর শিশুসাহিত্য নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা সাহিত্যের কঠিন একটা দিক নিয়ে কাজ করে থাকেন। নিজের শৈশবের ছাঁচে ফেলে শিশুমন বিশ্লেষণের এমন কঠিন সাধনা, সত্যিই দুরূহ। ইসমাইল জসীম একজন শিশুসাহিত্যিক। শিশুসাহিত্য নিয়ে কাজ করে চলেছেন দীর্ঘদিন ধরে।
সাহিত্যে ‘কিশোর ও মেঘবালিকা’ কিশোর কাব্যগ্রন্থের জন্য চট্টগ্রাম একাডেমি প্রবর্তিত ‘অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ শিশুসাহিত্য পুরস্কার’(২০১৩) লাভ করেছিলেন এই গুণী কবি। ইসমাইল জসীমের সপ্তম গ্রন্থ ‘সবুজের সাথে মন মাতাতে’। বইটিতে ঊনিশটি কবিতা আছে। বইটির নাম নিয়ে কোনো কথাই হবে না। অসাধারণ ছন্দময় একটি নাম। কবিতাগুলোর শিরোনাম এককথায় অসাধারণ। নামকরণের যথার্থতা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বলা যায়, কবির রুচিবোধ নান্দনিক। কবিতার শিরোনামের সাথে কবিতাগুলোর সামঞ্জস্যপূর্ণ বর্ণনা প্রশংসনীয়। বিশেষ করে ‘মেঘ তোমাকে দিলাম ছুটি আজ’, ‘প্রজাপতি’, ‘আকাশের সাথে মিতালি’, ‘বাবা আমার নীল আকাশের তারা’, ‘কোথায় পাবো মাঠ’, ‘ডানপিটে মন ছেলে’, ‘আমার একটি বেলুন ছিলো’ এসব কবিতায় জীবনঘনিষ্ঠ কাহিনিকে উপজীব্য করে কবি তাতে ছন্দের গাঁথুনি দিয়েছেন। প্রতিটি লাইন যেনো জীবনের কথা বলে।
‘বাবা আমার নীল আকাশের তারা’ কবিতাটিতে হৃদয়স্পর্শী কিছু পংক্তি আছে, যা পাঠমাত্রই পাঠকের চোখ আদ্র হয়। মনে হয় সত্যিই তো, বাবা আমার নীল আকাশের তারা। যারা বাবার ছায়াহীনতায় আছেন তারা তো বটেই, অন্যরাও এই কবিতা পাঠে মনে মনে বাবার কথাই ভাববে।
‘আকাশের সাথে মিতালি’ কবিতায় এক কিশোরের নাগরিক বন্দীত্বের কথা প্রকট হয়ে উঠেছে। হৃদয়ানুভূতির প্রবলতা উঠে এসেছে বিশেষ বিশেষ ভাবে। এক কিশোর অথবা কিশোরীর মনের অব্যক্ত ইচ্ছে, যা হয়তো কাল্পনিক কিন্তু প্রবলভাবে তাকে নাড়া দেয় সেসব উঠে এসেছে সহজেই।
‘কোথায় পাবো মাঠ’ কবিতায় চমৎকারভাবে ছন্দে ছন্দে উঠে এসেছে বর্তমান সময়ে কিশোর কিশোরীদের দৈনন্দিন চালচিত্র। তাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে খেলার মাঠ, পুকুর, দিঘি, নৌকায় নদী পারাপার, বন্ধুদের সাথে খেলার সময় ইত্যাদি।
এদিকে নতুন তথ্যপ্রযুক্তির বহুল ব্যবহারের কথা ও চমৎকারভাবে তুলে ধরা হলো একই কবিতায়।
এভাবে প্রায় প্রতিটি কবিতাই নিখুঁত বিশ্লেষণে বিশেষভাবে ধরা দেবে পাঠকের কাছে। আর কবি এই কবিতাগুলো সৃষ্টিতে ফিরে গিয়েছিলেন ফেলে আসা অতীতে, তা সহজেই অনুমেয়। একদম নিজ জীবনের অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিশেষ অনুভূতিগুলোকে একত্রিত করে সৃষ্টি করলেন তাঁর কাব্যগ্রন্থটি। ছন্দের ক্ষেত্রে বিশেষ মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন প্রত্যেকটি কবিতায়। একদম আলাদা আলাদা স্বাদ ও তৃপ্তি ছড়িয়ে দেবে আবৃত্তিশিল্পীদের মাঝে, এটা অনুমান করা যায়। গতানুগতিক ছন্দে আবদ্ধ করতে চাননি তাঁর সৃষ্টিকে, এটাই সবচে আরামপ্রদ বিষয়।
এককথায় সুখপাঠ্য! শব্দচয়নের ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ উদারতা দেখিয়েছেন। একদম সহজ সরল অনাড়ম্বর শব্দকে ছন্দে আবদ্ধ করে শিশু থেকে বয়োবৃদ্ধ সবার পাঠ উপযোগী করে তুলেছেন। সাধারণ সৃষ্টিতে অসাধারণতা এনেছেন সহজেই। কবিতার পটভূমি একদম সাদামাটা। আমাদের শৈশবের সেই বিস্তৃত প্রান্তর, পুকুর, নদী, বৃষ্টি, আকাশ, মাটি, ঝোপঝাড়, বনবাদাড়, বেলুন, ফুলপরী, স্কুল, স্বপ্ন ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার মনে হলো যেনো সুদূর অতীত শৈশবের পথে হাঁটছি।
স্বাধীন দেশ, স্বাধীনতার আনন্দ কিশোর মনে যে দারুণ প্রভাব ফেলেছে তা উঠে এসেছে বেশ সহজেই। সময়ের এই অতি আধুনিক স্তরে এসেও স্বাধীনতার মূল বিষয়বস্তু নিয়ে কিশোরেরা একবার ভাবতে বাধ্য হবে হয়তো। পরিণতরা ভাববেন, সত্যিই তো আমরা তেমনটাই ভেবেছিলাম সেই সময়। বর্ণিল প্রচ্ছদে বইটিকে নজরকাড়া করেছেন মোমিন উদ্দীন খালেদ। কবিতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছবিতে কবিতাগুলোকে জীবন্ত করেছেন পীযূষ সরকার। এককথায় শৈলী প্রকাশনার অনন্য এক সৃষ্টি বলা যায় ‘সবুজের সাথে মন মাতাতে’। বইটির দাম রাখা হয়েছে মাত্র ২২০ টাকা।
সাহিত্যে বরাবরই সাহিত্যিকের ব্যক্তিজীবন প্রতিফলিত হয়, এটা স্বাভাবিক। সাহিত্যিকের যাপিত জীবন, সময়কাল, দেশ তথা বৈশ্বিক বিষয়বস্তুর প্রভাবও প্রতিফলিত হয়। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কবির ব্যক্তিগত চিন্তা চেতনার সুস্পষ্ট ও সুগভীরতায় প্রতিটি কবিতা হয়ে উঠেছে অনন্য। কবি আর কবির সৃষ্টির প্রতি অশেষ শুভকামনা।