লুসাই কন্যা কর্ণফুলী নদীকে বাঁচাতে হবে দূষণের হাত থেকে

80

মাসুদ নাসির

লুসাই পাহাড় থেকে নেমে আসা দেশের ঐতিহ্যবাহী এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত কর্ণফুলী নদী এখন বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। আমাদের প্রয়োজনে নদীকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। পরিবেশ রক্ষায় সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে কর্ণফুলী নদী দূষণে যাতে বিষাক্ত না হয়। এক পরিসংখ্যানে কর্ণফুলী নদতে গড়ে প্রতিদিন ৫শ টন বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে কর্ণফুলী নদী। পানিতে দূষণের মাত্রা বর্তমানে মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ নদীর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে অনেক আগেই। কর্ণফুলী পেপার মিলের শ’শ টন বর্জ্য এ নদীতে ফেলার কারণে পানি দূষণের মাত্রা আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে চলেছে। আর এই দূষিত পানির যথেচ্ছা ব্যবহারের কারণে নদী তীরবর্তী এলাকার লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করছে বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে। এক পরিসংখ্যানে নদী তীরবর্তী অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ ইতোমধ্যেই জটিল রোগে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানা যায়। শীঘ্রই এ নদীর পানি দূষণমুক্ত করার কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে নদী তীরবর্তী দুই পাড়ের কয়েক লক্ষ মানুষ নানারকম দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা।
কর্ণফুলী নদীর উৎপত্তি হয় আসামের লুসাই পাহাড়ে। খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা সীমান্তে দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ। বাংলাদেশের অংশে দৈর্ঘ্য ১৬০ কিলোমিটার। অববাহিকা ১২৯৬ বর্গকিলোমিটার। কাপ্তাইয়ের এই নদীতে বাঁধ দিয়ে স্থাপন করা হযেছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ও এক মাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র।
অপর দিকে দুই দশক ধরে ক্যাপিটাল ড্রেজিং হয়নি। ক্যাপিটাল ডেজিং না করায় কর্ণফুলী নদীর দুই তীর ক্রমশঃ সংকুচিত হচ্ছে। ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদীর তলদেশ। প্রতিদিনই কর্ণফুলী নদীর বিস্তীর্ণ অংশে জেগে উঠছে নতুন নতুন চর। আর এ চর নদীর বিস্তীর্ণ অংশ প্রতিদিন দখল করে নিচ্ছে নদীখেকো ভূমিদস্যু। নদীটির সর্বশেষ ক্যাপিটেল ডেজিং হয় ১৯৮২ও ১৯৮৮ সালে। শুধু নেভিগেশন চ্যানেল থেকেই ৩৩ লাখ ঘনমিটার পলিমাটি উত্তোলন করা হয়েছিল। পরে গত ২৩ বছরে পরিকল্পিত আর কোন ড্রেজিং হয়নি। দুই দশকে নদীতে পলি জমে অনেকটাই ভরাট হয়ে গেছে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ। পানি ধারন ক্ষমতা কমে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুম এবং জোয়ারেও ছাপিয়ে যায় কর্ণফুলী নদীর দুই কূল। ড্রেজিং করার জন্য ১৫ বছর মেয়াদী মহাপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হলেও মহাপরিকল্পনা এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
১৯৫৩ সালে তৎকালিন পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিজ ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন (পি.আই.ডি.সি) উন্নতমানের কাগজ উৎপাদনের জন্য কর্ণফুলী নদীর তীরে পেপার মিল প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই মিলের শ’শ টন বর্জ্য পদার্থ নদীতে এসে মিশছে। এ ব্যাপারে শুরুর পর থেকে বর্জ্য নিষ্কাশন ও পরিশোধনের কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় মিলের যাবতীয় বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে ফেলে আসছে মিল কর্তৃপক্ষ। সে সময় কর্ণফুলী নদীর পানি ব্যবহার করার মতো মানুষ ছিল না বলে বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষ আলাদাভাবে চিন্তা ভাবনা করেনি বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে কর্ণফুলী নদীর পাড়কে উপজীব্য করে এখন কয়েক লক্ষ মানুষের বসবাস। আর কর্ণফুলী পেপার মিলসহ নদী তীরবর্তী প্রায় ১০/১২টি শিল্প কারখানা ও ১টি তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত দূষিত রাসায়নিক বর্জ্য পদার্থে কর্ণফুলী নদীর পানি দূষিত হওয়ার পাশাপাশি নদীর নাব্যতা হ্রাস পেয়ে এখন মানুষের জন্যে হুমকি হয়ে পড়েছে।
কর্ণফুলী পেপার মিল থেকে প্রতি ২৪ ঘন্টায় ১শ টন তরল রাসায়নিক বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে ফেলা হয়েছে উৎপাদন যখন পুরোদমে ছিল। এখন আগের সেই উৎপাদন নেই পেপার মিলে। বর্জ্য বতর্মান পরিস্থিতিতে অনেক কমে গেছে।
প্রতিদিন এখনও বিপুল পরিমাণ বর্জ্য পদার্থ নদীর পানিতে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ফলে এর প্রভাব পড়েছে জনস্বাস্থ্যের ওপর। এছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে কর্ণফুলীর পানি দূষিত হওয়ার কারণে নদীতে মৎস্য প্রজনন ও মাছের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। কর্ণফুলী পেপার মিলের নি¤œাঞ্চলের নদীর পানি থেকে যে মাছ ধরা হয় সেসব মাছ রান্না করার পর কস্টিক সোডার গন্ধের জন্য খাওয়া যায় না। নদীর পানি দূষণের ফলে ইতিমধ্যে কর্ণফুলী থেকে প্রায় ৫৪ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে জানায় পরিবেশবিদরা। এছাড়াও কর্ণফুলীর শাখা নদীগুলোতে চিংড়ি মাছের যে প্রাকৃতিক প্রজনন প্রক্রিয়া ছিল তা সমূলে ধংস হয়ে গেছে। ফলে কয়েক হাজার জেলে পরিবার ও প্রজনন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত মৎস্যজীবীরা কর্মহীন হয়ে গেছে।
দেখা গেছে কর্ণফুলী নদীর বিষাক্ত বর্জ্যে সরাসরি সাগরে পতিত হওয়ায় কর্ণফুলীর মোহনায় সাগরের পানিও মারাত্মক দূষিত হয়ে পড়েছে। এতে কর্ণফুলী নদী থেকে প্রায় ৬৩ প্রজাতির মাছ জলজ উদ্ভিদ হারিয়ে গেছে। পরিবেশবাদী একটি সংগঠনের মতে ১৯৯২ সালে কর্ণফুলী নদীর দীর্ঘ ২৯২ বর্গমাইল এলাকায় ৭ শতাধিক বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল। বর্তমানে এর সংখ্যা ৩ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এর কোনটির বর্জ্য শোধনাগার বা ইটিপি (ইফুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) নেই। কর্ণফুলী নদী দূষণের জন্য এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানই দায়ী। পরিবেশবাদী সংগঠন গুলোর জরিপে ২১৭টি প্রতিষ্ঠান ভয়াবহভাবে তাদের বিষাক্ত বর্জ্য সরাসরি কর্ণফুলী নদীতে নিক্ষেপ করে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৯টি ট্যানারী ফ্যাক্টরী, ২৬টি টেক্সটাইল মিল, ২টি রাসায়নিক কারখানা, ৪টি সাবান ফ্যাক্টরি. ২টি তেল শোধনাগার, ৫টি মৎস্য প্রক্রিয়াজাত করন কারখানা, বিটুমিন প্লান্ট ,সিইউএফএল, কাফকো, চন্দ্রঘোনা পেপার মিল, অন্যতম। দূষন তালিকায় শীষের্ রয়েছে সরকারি ৪টি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ,ওয়াসা, চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা, কর্ণফুলী কাগজ কল। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কোন বর্জ্য শোধনাগার নেই। শুধু সিটি করর্পোরেশন প্রতিদিন ৭৬০ থেকে ৮০০টন বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে ফেলে। এ ছাড়া জাহাজের দূষিত পানি তেল অন্যান্য আবর্জনা প্রতি দিনই ফেলছে। নদীর দুই পাড়ে গড়ে উঠেছে প্রায় ৮০লাখ মানুষের বসতি। মানবদেহের বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ নদীতে মিশে পানি দূষিত হচ্ছে। এছাড়া বর্ষা মৌসুমের সময় পাহাড় ধসের ফলে পাহাড়ের বালি ও মাটি কর্ণফুলী নদীর তলদেশ ভরাট করে ফেলছে এতে নদীর গভীরতা কমে যাচ্ছে।
পাবর্ত্যাঞ্চলের কাপ্তাই, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, বোয়ালখালী উপজেলা, চট্টগ্রাম বন্দরসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলের ওপর দিয়ে কর্ণফুলী নদী প্রবাহিত এবং এ সকল অঞ্চলের হাজার হাজার পরিবার ব্যবহারের জন্য কর্ণফুলী নদীর ওপর নির্ভরশীল। গোসল, ধোয়া মোছা ও পান করার জন্যে তারা নদীর পানি ব্যবহার করে। রাসায়নিক বর্জ্য পদার্থে এই পানি দূষিত হয়ে যাবার ফলে উল্লেখিত অঞ্চল সমূহের জনসাধারণ নানা রকম পেটের পীড়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এবং তাদের স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। অপরদিকে কেপিএম থেকে অব্যাহত গতিতে রাসায়নিক বর্জ্য পদার্থ নির্গত হওয়ার ফলে নদীর গভীরতাও ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। কেপিএম গবেষণাগারে নিয়মিত নদীর পানি পরীক্ষা করার নিয়ম থাকলেও তা কেবলই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের আশু দৃষ্টি নিবন্ধিত করা প্রয়োজন বলে অভিজ্ঞমহল মত প্রকাশ করেছেন।
পরিবেশবিদদের তথ্য মতে, গড়ে প্রতিদিন ৫শ টন বর্জ্যে দুষিত হচ্ছে কর্ণফুলী নদী। কর্ণফুলী পেপার মিলের পাশাপাশি নদীতে এসে মিশছে কর্ণফুলী জুট মিল, ফোরাত কর্ণফুলী কার্পেট ফ্যাক্টরি ও ইস্টার্ণ কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রিজের বিষাক্ত রঙ ও বর্জ্য। এছাড়াও চট্টগ্রামের বিভিন্ন ট্যানারি, টেক্সটাইল মিল, তেল শোধনাগার, স্টিল মিল, কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রি, ইউরিয়া সার কারখানা, সিমেন্ট ফ্যাক্টরিসহ ছোটবড় অসংখ্য শিল্পকারখানার বর্জ্য এসে পড়ছে এ নদীতে। বিভিন্ন জাহাজ ও নৌযান সহ নানা ধরনের পণ্যবাহী ইঞ্জিনচালিত বোটের পোড়া তেল ও মবিল ফেলার কারণেও পানির দূষণ মাত্রা বাড়ছে বলে পরিবেশবিদদের অভিমত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব শিল্পকারখানা থেকে ৬২ ধরনের মারাত্মক ক্ষতিকর রাসায়নিক বর্জ্য নদীর পানিতে মিশে যাচ্ছে প্রতিদিন। এসব বর্জ্যরে মধ্যে রয়েছে সায়ানাইড ক্রোমিয়াম পারদ ক্লোরিন নানা ধরনের এসিড দস্তা নিকেল ফসফোজিপসাম সিসা ক্যাডমিয়াম লোহা অ্যালকালির মতো ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য।

লেখক : সাংবাদিক