চিকিৎসা সংবাদ, স্বাস্থ্য সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম প্রসংগে

5

ডা. হাসান শহীদুল আলম

(১ম পর্ব)
স্বাস্থ্য সাংবাদিকতা হলো সাংবাদিকতার সেই শাখা যেখানে স্বাস্থ্য সংকটে কিংবা কোন ধরনের সংকটহীন সময়ে বিভিন্ন স্বাস্থ্য ইস্যু বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করে সাধারণ নাগরিকদের সহায়তা করা হয়। গণমাধ্যম হচ্ছে সংগৃহীত সকল ধরনের মাধ্যম যা গণযোগাযোগ কার্যক্রমে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর ইত্যাদিকে চিকিৎসা সংবাদ বলা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সাংবাদিকতার স্বরুপ উন্মোচনে নি¤েœর ফেসবুক স্ট্যাটাস দুটি দ্রষ্টব্য- ক. ঢাকার বারডেম হাসপাতালে কোন এক রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কোন এক এএসপি পুলিশের ইন্ধনে ৬০-৭০ জন মানুষ মিলে ডাক্তারদের বেধড়ক মারধর করে। পালিয়ে টয়লেটে আশ্রয় নেয়া এক নারী চিকিৎসক তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি।অনেকগুলো মানুষ মিলে টয়লেটের দরজা ভেংগে তাঁকে বের করে এনে দারুণ উন্মাদনায় সবাই মিলে মারধর করে। রাস্তায় ছিনতাইকারী বা চোর ধরা পড়লে যেভাবে অনেক মানুষ মিলে মারধর করে কিছুটা হয়তো তেমনই।এবার সেই নারী চিকিৎসকের জায়গায় কল্পনা করুন সেখানে আপনারই বোন, আপনারই বন্ধু বা আপনারই প্রিয় কোন মানুষের কথা। কোন এক রাতের বেলা ধবংসের উন্মাদনায় মত্ত ৬০-৭০ জন মানুষ ধেয়ে আসছে তার দিকে। কোন পথ না পেয়ে অবশেষে টয়লেটের ভিতরে নিজেকে লুকিয়ে ফেললো সে। কিন্তু মেয়েটির আশা অপূর্ণ রেখেই ভেংগে গেল টয়লেটের দরজা। কিছু লোমশ হাত ধেয়ে আসলো মেয়েটির দিকে (প্রথম আলো, ১৫-০৪-১৪)।
খ. গতকাল সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ সার্জারী থেকে কল এলো, তীব্র পেটব্যথা এর রোগী দেখার জন্য। গিয়ে দেখি আমিনা বেগম নামের ৩৫ বছরের একজন মহিলা টুইসটেড ওভারিয়ান টিউমার নিয়ে কাতরাচ্ছে। স্বামী রিক্সা চালক। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, রোগীর অবস্থা ক্রমশঃ খারাপ হচ্ছে। এখুনি পেট খুলে টিউমার বের করতে হবে। সে কোন খরচ করতে পারবে না। বললাম সিট ভাড়া,অপারেশন চার্জ মাফ করানোর ব্যবস্থা করে দেবো। অন্ততঃ ওষুধের খরচ তার বহন করতে হবে। আরো অনেকক্ষণ বোঝানোর পর কনসেন্ট পেপারে বৃদ্ধাংগুলির ছাপ দিয়ে মনে হলো ডাক্তার সমাজকে করুনা করলো। অপারেশন রুমে ঢোকানোর আগে বললাম, আত্মীয় স্বজন যে কজন পারো খবর দিতে, রক্ত লাগবে। আমার এসিসটেন্ট প্রফেসর ও রেজিস্ট্রার অপারেশন শুরু করলেন। ল্যাপারেটমি বা পেট কাটার পর দেখা গেল ভালো রকম রক্তক্ষরন হয়েছে।রক্তচাপ নেমে গিয়েছে। এনেসথেটিস্ট বললেন, আপা রক্ত আনান কুইক। ইন্টার্নী ডাক্তার এসে জানালো, ম্যাডাম, রোগীর স্বামী গায়েব। দৌড়ে সামনে বের হয়ে পেলাম পঞ্চম বর্ষের এক ছাত্রকে। বললাম বাবা যে ভাবে সম্ভব অন্ততঃ দুই ব্যাগ রক্ত জোগাড় করো। একই বর্ষের অপর এক ছাত্র আইটেম পরীক্ষা দিতে এসেছে। রক্তের কথা শুনেই দৌড়ে আসলো। মুহূর্তের মধ্যেই ওরা রক্ত নিয়ে এলো। বøাড ব্যাংক এবং ক্রস ম্যাচিং এর পুরো খরচটাই ইন্টার্নী ডাক্তার তার পকেট থেকে দিলো। বেলা আড়াইটার দিকে সবাই হাসিমুখে অপারেশন রুম থেকে বের হলাম।তখনও রোগীর স্বামী ফিরে আসেনি (জনৈক সহযোগী অধ্যাপক চিকিৎসক, সাউদার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম, ডাক্তার ডট কম, ২৭-০৭-১৮)।
এবারে ফেসবুক স্ট্যাটাস দুটির বিশ্লেষণে আসা যাক। প্রথম স্ট্যাটাসটিতে দেখা যাচ্ছে যে, বাথরুমের দরজা ভেংগে নারী চিকিৎসককে বের করে এনে ৬০-৭০ জন মারমুখী লোক নির্মমভাবে পেটালো। এর প্রতিবাদে যখন বারডেমের চিকিৎসকগণ কর্মবিরতি পালন করলেন তখন সংবাদ মাধ্যমে রোগীদের কষ্টটাই শুধু দেখানো হলো, কিন্তু নিরীহ নির্দোষ মেয়েটির উপর নিমর্ম অত্যাচারের কোন প্রতিবাদ হলো না বা প্রতিবাদ প্রকাশিত হলো না। যার কারণে দর্শক শ্রোতা প্রকৃত সত্য না জেনে চিকিৎসকদের একতরফা দোষারোপ করতে থাকে। দ্বিতীয় স্ট্যাটাসটিতে দেশের সকল সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালের প্রাত্যহিক জীবনের একটি অংশকে দেখানো হয়েছে। এভাবে অধ্যাপক,চিকিৎসক ও ছাত্রদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অনেক অসহায় রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হয়, যেগুলোর সংবাদ কখনও মিডিয়ায় আসে না। বরং মানুষের মধ্যে ক্রমাগত ভ্রান্ত, অসত্য, অবাস্তব, তথ্য প্রচার করে রোগী ও চিকিৎসকদের মধ্যে দূরত্ব তৈরী করা হচ্ছে।
সাংবাদিকদের প্রতি আমার আস্থা ও শুভেচ্ছা মনে রেখে সাংবাদিকতা সম্পর্কে দু’জন বিশিষ্ট ব্যক্তির উক্তি তুলে ধরছি- (ক) ‘মিথ্যা খবর খুবই সস্তা হয়ে থাকে, এগুলো তৈরী করা সহজ। কিন্তু সত্যিকারের খবর খুঁজে বের করা খুব কঠিন একটা কাজ।’Ñ দার্শনিক থমাস হেন্ড্রিক লিভস (খ) ‘যখন মিথ্যা খবরগুলো বার বার ঘুরে ফিরে চোখের সামনে আসে, তখন সাধারণ জনগণের কাছে সত্য মিথ্যার ফারাক বোঝাটা খুবই দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।’Ñ আমেরিকান কংগ্রেসম্যান জিমি গোমেজ। এবারে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য সাংবাদিকতার আরো কিছু স্বরুপ উন্মোচন করছি-
ক. চিকিৎসাসেবা কর্মে চিকিৎসকদের শারীরিক মানসিক সূস্থতা অপরিহার্য়, এটা আমরা সবাই জানি। তাই চিকিৎসক যিনি দুপুরের কার্যকালে কাজ করেন তাঁকে বৈকালিক কার্যকাল থেকে ছুটি দেয়া হয়। যিনি বৈকালিক কার্যকালে কাজ করেন তাঁকে রাত্রিবেলায় ছুটি দেয়া হয় এবং যিনি রাত্রিবেলা নিদ্রাহীন কাজ করেন তাঁকে পরদিন সকাল-দুপুর কার্যকালে ছুটি দেয়া হয়। এমনি নিয়ম হাসপাতালে পালিত হয়। কিন্তু বৈকালিক বা রাত্রিকালীন বা রাত্রিকালীন পরবর্তী ছুটি উচ্চ মহলের বক্তব্যে বা সংবাদপত্রে আসে চিকিৎসকের অনুপস্থিতি হিসাবে। অথচ এটা ভ্রান্ত তথ্য। এ ধরনের ভ্রান্ত সংবাদ পরিবেশন চিকিৎসক ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে। এমনিভাবে ভুল চিকিৎসার ভ্রান্ত সংবাদে রোগীর স্বজনরা চিকিৎসকদের উপর মারমুখী হয়ে পড়ে।
খ. মিডিয়া কর্তৃক ভ্রান্ত সংবাদ প্রচারের কারনে চিকিৎসকদের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়াঃ চিকিৎসা পেশা সংক্রান্ত বেশীর ভাগ সংবাদেই কোন না কোন ভুল পরিলক্ষিত হয়। যেমন হার্টে রিং পরানোর সংবাদ হয় হাতে রিং পরানো। ধর্ষন করে গ্রামের ওষুধ বিক্রেতা বা কোয়াক। কিন্তু হেডলাইন হয় চিকিৎসক। রোগের জটিলতায় মৃত্যুর খবর হয়ে যায় চিকিৎসকের অবহেলায় মৃত্যু। হাসপাতালের কেনাকাটায় আমলাতান্ত্রিক বা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের খবরের দায়ভার আসে চিকিৎসক সমাজের উপর। অথচ এরূপ কেনাকাটায় চিকিৎসক কোনভাবেই জড়িত নয়। এ ধরনের ভ্রান্ত সংবাদ পরিবেশন চিকিৎসক ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে। রোগীর স্বজনরা চিকিৎসকদের উপর মারমুখী হয়ে পড়ে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের জ্ঞানের সাথে সম্পর্কহীন একজন মানুষ হতে পারেন তিনি সাংবাদিক, কিভাবে বলতে পারেন ভুল চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এবং পত্রিকায় শিরোনাম দিচ্ছেন চিকিৎসকের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু বা ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু। (চলবে)
লেখক : ডায়াবেটিস ও চর্মযৌনরোগে
¯œাতকোত্তর প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত চিকিৎসক চট্টগ্রাম