ইউসুফ চৌধুরী : সোনার বাংলাদেশ গড়ার সোনার মানুষ

9

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

মানুষ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন যে কত স্বাপ্নিক হয়ে উড়ে যায় নেই তার শেষ। স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেয়া এ এক কঠিন বিষয়। শূন্য হাতে যাত্রা শুরু করে মহৎ স্বপ্ন বাস্তবায়ন চাট্টিখানি কথা নয়। আলহাজ ইউসুফ চৌধুরী কঠিনকে সহজ করেছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের অমর পংক্তি-
‘সত্য যে কঠিন
কঠিন রে ভালবাসিলাম
সে মোরে করে না বঞ্চনা।’
কঠিনকে ভালবেসে আলিঙ্গন করা তাঁর পক্ষে সহজ ছিল বলেই তিনি সত্য সাধনে স্বপ্ন বাস্তবায়নে সফল হয়েছেন।
মরহুম ইউসুফ চৌধুরী সহজ সরল মায়া মমতা মাখা কর্মট সফল এক মানুষের নাম। নিষ্ঠাবান দেশপ্রেমিক দূরদর্শী দক্ষ সংগঠক তাঁর মত খুব কম লোকই আছে। মানুষের প্রতি ¯েœহ প্রবণ বিচক্ষণ এবং জীবন পথে চলার ব্যাপক অভিজ্ঞ মনন ও প্রজ্ঞাশীল মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর প্রজ্ঞার পরিচয় ঘটেছে তাঁর কর্মে। কথায় বলে মানুষ বেঁচে থাকে বয়সে নয় তাঁর কর্মে। মরহুম ইউসুফ চৌধুরীও বেঁচে থাকবে তাঁর কর্ম ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। দেশের বিত্তবানরা যখন বিদেশে অর্থবিত্ত পাচারে মগ্ন তখন তাঁর সফল ব্যবসার অর্থবিত্ত কিসের এক অজানা নেশায় বিনিয়োগ করেন দেশের সৃষ্টিশীল প্রতিষ্ঠানে। তাঁর সৃজনশীলতার প্রধান স্বাক্ষর দৈনিক পূর্বকোণ। বাংলাদেশে ১৯৮৬ সালের দিকে আধুনিক ফটো কম্পোজের ব্যবহার তেমন ছিল না। চট্টগ্রামে দৈনিক আজাদী ছাড়া তেমন কোন উল্লেখযোগ্য পত্রিকা ছিল না। তখন তিনি আধুনিক কম্পিউটার কম্পোজ ব্যবহার করে দৈনিক পূর্বকোন প্রকাশ করেন। চট্টগ্রামের অভাব অভিযোগ, সমস্যার কথা ব্যাপক ভাবে তুলে ধরার মাধ্যমে পত্রিকাটি জাতীয় দৈনিকের সমকক্ষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সুন্দর ছাপা ও ছবি, তথ্য তত্ত¡ সত্যে অবিচল থেকে পত্রিকাটি পাঠকের কাছে অসাধারণ গ্রহণযোগ্য হয়েছে হচ্ছে। এসবের পিছনে মূল মন্ত্রক ছিলেন ইউসুফ চৌধুরী।
তাঁর জীবনের সমস্ত চিন্তা চেতনা ছিল মানব কল্যাণমূলক স্বপ্নের বস্তবায়ন করা। সচেতন সুনাগরিক গঠনে দৈনিক পূর্বকোণ কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্ত করতে ভেটেরিনারী বিশ্ববিদ্যালয়, ডৈইরী ফার্ম প্রতিষ্ঠা, ডেইরী চিষ্টা দিয়ে জৈবসার তৈরীর পরিকল্পনা, জন্মস্থান রাউজানে তরুণ বয়সে সৃজনশীলতার টানে ছাত্রবন্ধু লাইব্রেরী ও সমাজকে আলোকিত করতে রুচিশীল লাইব্রেরী নিউজ ফ্রন্ট প্রতিষ্ঠা, শিশু কিশোরদের মেধা বিকাশে ‘দোলনা’ পত্রিকা প্রকাশ , আধুনিক প্রযুক্তিতে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান ‘সিগনেট প্রেস’, মানুষের জীবন বাঁচাতে ঔষধ উৎপাদন করতে ‘ইউনাইটেড ফার্মাসিটিক্যালস’ প্রতিষ্ঠা, ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটকে বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) করার, কর্ণফুলী তৃতীয় সেতৃ নির্মাণ, ওয়াসার ডিপ টিউবওয়েলের যৌক্তিক বিল ধার্যের আন্দোলনের মাধ্যমে মানব কল্যাণের পথ পরিক্রমণ করেছে। পবিত্র কোরআনে পাকে আল্লাহ জাল্লে শানহু ইরশাদ করেছেন, ‘ওয়াহসিনু ইন্নাল্লাহ ইয়াহিবুবল মোহসেনিন’ অর্থাৎ মানুষের কল্যাণ কর, কল্যাণকারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন। রাসুলে খোদা হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এক ব্যক্তি বিজ্ঞাসা করেছিরেন, সর্বোত্তম ব্যক্তি কে ? উত্তরে তিনি বলেছিরেন, ‘খায়রুন্নাসে ইয়ানফিউন্নাস’ যিনি মানুষের কল্যাণ করেন তিনি সর্বোত্তম। সৈয়ত মুজতবা আলী বলেছেন, ‘জীবনটাকে লম্বায় বড় করা যায় না পরিধিতে বাড়াতে চেষ্টা করুন’। আলহাজ ইউসুফ চৌধুরী আল্লাহ পাক হতে যতটুকু হায়াতে জিন্দাগী এনেছেন তা লম্বায় বৃদ্ধি করতে না পারলেও মানবকল্যাণ ও কর্মপরিধিতে বাড়িয়েছেন অনেক অনেক বেশি।
বিশিষ্ট সাহিত্যিক বৃদ্ধিজীবী অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘ইউসুফ চৌধুরী সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় ছোট থেকে বড়ো হয়েছিলেন। তার মূলে ছিল তাঁর উচ্চাকাক্সক্ষা, অদম্য মনোবল ও অন্তহীন কর্মস্পৃহা। কেবল নিজে প্রতিষ্ঠা লাভ করবেন, তা নয়, সমাজকে কিছু দেবেন এই ছিল তাঁর স্বপ্ন। প্রতিকূলতার কাছে তিনি মাথা নত করেন নি, অকুতোভয়ে সংগ্রাম করেছেন এবং সেই সংগ্রামের জয়লাভ করেছেন।’
তিনি ছিলেন এক কর্ম পাগল মানুষ। কাজের মধ্যে থাকতে তাঁর আনন্দ। কাজ করতে গিয়ে অসুস্থতা ও বার্ধক্যকে তিনি পাত্তাই দিতেন না। অসাধারণ মনের জোরে সমস্ত কাজ করতে তিনি বয়সের বাধা মানতেন না।
ইউসুফ চৌধুরীকে অসত্যের কাছে কখনও মাথানত করতে দেখিনি। তিনি শৈশব হতে স্বীয় প্রচেষ্টায় স্বপ্নের এক একটি সৌধ নির্মাণ করেছেন যাতে একমাত্র বৈষয়িক উন্নতির লক্ষ্যে ছিল না, ছিল মহৎ এক ব্রত। জগত সংসারে তিনি এসেছেন পথের বাধা পথের কাটা সরাতে। এখানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার পংক্তির উদ্ধৃতি করছি :
‘সংসার মাঝে দু’একটি সূর
রেখে যাব করিয়া মধুর
দু’একটি কাঁটা করে দেব দূর
তার পর ছুটি নেব।’
মরহুম ইউসুফ চৌধুরী সংসারের জঞ্জাল কাঁটা সরিয়ে চলে গেলেন আমাদের মাঝ থেকে দূরে বহু দূরে।
তিনি অঙ্গীকারাবদ্ধ এক মানুষ ছিলেন। তাঁর অঙ্গীকার ছিল সমাজ দেশ জাতির নিকট। নিজের গড়ার অঙ্গীকার থেকে পশ্চাতে হটেনি বলেনই সকল অঙ্গীকার পালন করা সহজতর হয়েছে।
বিশিষ্ট লেখক সবিহ উল-আলমের নিকট সিগনেট প্রেসে বসে তাঁর অতীত জীবনের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘একদিন ঘাট’ পার হওয়ার পয়সা না থাকায় পারানীকে অনেক অনুরোধ করে ছিলাম, ঘাট পার করে দিতে। বলেছিলাম, কাগজ বিক্রি করে তার পয়সা বিকেলেই শোধ করে দেবো। পারানী আমার অনুরোধ রাখেনি, উপরন্তু যাচ্ছে তাই ব্যবহার করেছিল। সেদিন শপথ করেছিলাম, আমি উঠে দাঁড়াবেই’। তিনি যখন এসব বলেছিলন, তখন তাঁর কণ্ঠ ছিল আর্দ্রঃ চোখে পানি। (সূত্র : সবিহ-উল-আলমের লেখা ‘মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী এবং তাঁর নিউজ ফ্রন্ট এর ভূমিকা’, দৈনিক পূর্বকোণ, ১৪ নভেম্বর ২০০৭)
তিনি দাঁড়িয়ে অঙ্গীকার রক্ষা করেছিলেন। এমন উপরে দাঁড়িয়েছেন যেখানে কোন নিন্দুকের থুথু নিক্ষেপ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি বরং নিজের থুথু নিজের শরীরে পড়েছে।
বুদ্ধিদীপ্ত চির সবুজ মন, তরুণের মত আকাক্সক্ষা, দেশের রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতির পরিবর্তন এবং ভবিষ্যত, প্রজন্মের আধুনিক এক বাংলাদেশ গড়ার কাজই ছিল তাঁর আনন্দের বিষয়। মানুষের বাহবা পাওয়ার আগ্রহ ছিল না তাঁর। মিতভাষী আত্মপ্রচার বিমুখ মানুষটিকে কেউ খুশি করতে প্রশংসা করলে তিনি তা এড়িয়ে যেতেন। অসন্তুষ্ট হতেন।
মরহুম ইউসুফ চৌধুরীর ছিল চট্টগ্রামের প্রতি অসম্ভব দরদ। তিনি মনে করতেন চট্টগ্রামের উন্নয়ন হলে সমগ্র বংলাদেশের উন্নয়ন হবে। জাতীয় আয়ের ৭০% যোগান দেয় চট্টগ্রাম বন্দর। চট্টগ্রামকে অবহেলা করে জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। তিনি আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা নিয়ে চট্টগ্রামের উন্নয়নে কাজ করেছেন। সরকারের পদস্থ কোন ব্যক্তির সাক্ষাৎ হলেই তিনি চট্টগ্রামের ন্যায্য অধিকারের কথা তুলে ধরতেন। শেষ জীবনে এসে বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির ব্যানারে চট্টগ্রামের অধিকারের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাঁর আন্দোলনে কোন রাজনীতি ছিল না। লোক দেখানো এবং পদপদবীর কোন লোভ ছিল না বলেই তিনি চট্টগ্রামের সামাজিক আন্দোলনের কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছিল। বৃদ্ধ বয়সে লাঠিতে ভর করে শারীরিক কষ্ট উপেক্ষা করে ওয়ার্ডে গিয়ে চট্টগ্রামের অধিকার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন ও সংগঠিত করেছেন। তাঁর হাতের লাঠিতে ছিল প্রচন্ড শক্তি। সেই শক্তি দিয়ে চট্টগ্রামকে আলোকিত করতে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত সংগ্রাম করেছেন।
আলহাজ ইউসুফ চৌধুরী আলোকিত দক্ষ কর্মী গড়ার কারিগর। কি করে একজন মানুষ নিজেকে নির্মাণ করে দক্ষকর্মী বাহিনী সৃষ্টি করে রেখে যান তিনি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তাঁর হাতের স্পর্শ যেখানে পড়েছে সেখানে ফলন হয়েছে।
ড. মনিরুজ্জামান তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বলেন,‘সর্বত্র তিনি জ্বেলে রেখে গেছেন ভাস্বরতার দেদীপ্য এবং আলোর ঝর্ণাধারা। তাঁর কর্মক্ষেত্রটি ছিল বহু বিস্তৃত, সংকীর্ণতার দেয়ালে সীমিত ছিল না তার কখনই’।
ইউসুফ চৌধুরী প্রচন্ড একজন ভালবাসার মানুষ ছিলেন। শিল্পী, সাহিত্যিক, জ্ঞানিগুণীদের ভালবাসায় ও কদরে কার্পণ্য করতেন না। তাঁর সান্নিধ্যে যারা গেছে তারা আত্মার আত্মীয় হয়েগেছে। তাঁর সাথে আমার তেমন পরিচয় ছিল না। দৈনিক পূর্বকোণে প্রকাশিত আমার ধর্মীয় লেখা পড়ে তাপস বাবুকে বলে রেখেছিলেন, আমি অফিসে গেলেই যেন তাঁর কক্ষে আমাকে নিয়ে যায়। আমি অফিসে গেলে তাপস বাবু আমাকে নিয়ে যান চেয়ারম্যানের কক্ষে। আমি তাঁর সাথে প্রথম আলাপেই মুগ্ধ হয়েগেলাম। তিনি আমাকে উপসম্পাদকীয়সহ বিভিন্ন ধর্মীয় লেখা পূর্বকোণে লিখতে বললেন। তাঁর মায়া মমতামাখা কথা হৃদয় ছুয়ে গেলে। তাঁর মধুময় স্মৃতি চিরজীবন বহে যাবে আমার অন্তরে। সব বয়সের মানুষকে সহজে আপন করে নেয়ার অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী মানুষটি আমাদের শিখিয়ে গেছেন মানুষের মাঝে প্রচন্ডশক্তি আছে। আছে অপরিসীম সম্ভাবনা। কবি হেলাল হাফিজের কাব্য পংক্তি ‘এটম বুঝ / মানুষ বুঝ না’। মানুষের শক্তি সম্ভাবনাকে মানব কল্যাণে আত্মনিয়োগ করাই ছিল ইউসুফ চৌধুরীর শিক্ষা। জীবনের সময় শক্তি সম্পদ অপচয় করা ছিল তাঁর অপছন্দ।
বাংলাদেশকে মনে করতেন তিনি কৃষি বিপ্লবের উপযোগী স্থান। কৃষি উন্নয়নে ছিল তাঁর অত্যন্ত বাস্তব সম্মত চিন্তা। সাহিত্যিক আসহাব উদ্দিন আহমদ বলতেন, ‘সেক্সপিয়র রবীন্দ্র চর্চা দুই বছর বন্ধ রাখলে জাতির বড় ক্ষতি হবে না। আমার কৃষক একছর কাজ না করলে জাতির ধ্বংস অনিবার্য।
ইউসুফ চৌধুরী মানুষের রুটি রুজির কোন কাজকে কখনো ক্ষুদ্র দৃষ্টিতে দেখেন নি। প্রচÐ পরিশ্রমী আজন্ম একভাগ্য গড়ার কারিগর হিসেবে আমাদের মাঝে এক অনন্য দৃষ্টান্ত তিনি।
একুশ শতকের যুগপোযোগী সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ার সোনার মানুষটির জীবনাবসান আমাদের অভিভাবক হারানোর এক অসাধারণ বেদনা। তিনি ছিল আমাদের প্রেরণার উৎস। ¯েœহ মায়া ভালোবাসা এবং উৎসাহ প্রদানে তিনি আর আমাদের মাঝে নেই। তাঁর শূন্যতা পূরণ হবার নয়। আল্লাহ পাক মরহুম আলহাজ ইউসুফ চৌধুরীকে জান্নাত নসিব করুন। (আমিন)

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক