তাপমাত্রা প্রশমনে প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষা জরুরি

9

বাবুল কান্তি দাশ

‘অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু, / চাই বল চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু।’
জীবন কখনই একই রকম থাকে না। প্রতি দিনের রোদ ঝলমলে সূর্য ওঠা সকাল, আগের দিনের থেকে খানিকটা হলেও আলাদা হয়। কারণ আমরা প্রতিদিন অল্প অল্প করে মহামূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদকে ক্ষয় করতে ব্যস্ত। আমরা প্রত্যেকেই বেঁচে থাকি আজকের দিনের জন্য। আগামীকাল যে বিপন্ন হচ্ছে, সেদিকে খেয়াল থাকে না কারও। আশ্চর্যের বিষয় এটাই যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এখনও এই বিষয়ে অবগত নন। তাঁরা বুঝতে পারছেন না যে কার্যকর কৌশল ও সচেতন প্রচেষ্টা ছাড়া শুধু মানুষই নয়, পৃথিবীর প্রত্যেক প্রজাতি শীঘ্রই বিপন্ন প্রজাতিতে পরিণত হবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রকৃতি থেকে ধারাবাহিক ভাবে বহু প্রজাতির পাখি ও পশু হারিয়ে যাচ্ছে। বউ কথা কও, ইস্টিকুটুম, নীলকণ্ঠের মতো পাখিদের আর সে ভাবে দেখা মেলে না। কমে গিয়েছে হাড়গিলে, শকুনেরাও। শহরাঞ্চলে এই দশকের গোড়ার দিকেও শোনা যেত চড়ুইদের কিচিরমিচির। সে আজও শোনা যায় না। ময়না, কাকাতুয়ার মতো পাখিরাও বিপন্ন। শুধু প্রাণী নয়, বিপন্ন হয়েছে উদ্ভিদেরাও। আজ আর সহজে ফলসা, আঁশফল, ডেলোর মতো ফলের গাছেদের দেখা মেলে না। এর জেরে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পাখিদের খাদ্য ব্যবস্থায়। আবার ঝোপজঙ্গলের অভাবে লোকালয়ে চলে আসছে গন্ধগোকুল, বাঘরোলের মতো প্রাণীরা। ইতিমধ্যে ভোঁদর-সহ নানা প্রাণী বিপন্নের তালিকাভুক্ত হয়েছে। বিপন্ন গাধার মতো প্রাণীরাও। গাধা শব্দটির সঙ্গে ছোটবেলা থেকে আমরা পরিচিত। কিন্তু সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, গাধার সংখ্যা বেশ কম। হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলার খালবিলের মৌরলা, পুঁটি, বেলের মতো মাছেরা। তাতে টান পড়তে শুরু করেছে দরিদ্র শ্রেণির মানুষের খাদ্যভান্ডারেও। সাম্প্রতিক গরমের তীব্রতা থেকে সহজেই অনুমেয় বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। বিশ্বের একাধিক জায়গায় তাপপ্রবাহ এত তীব্র হয়ে উঠবে যে কার্যত ধ্বংসের সম্মুখীন হবে মানবসভ্যতা, এক একটি জনবহুল এলাকা হয়ে পড়বে বসবাসের অযোগ্য। একটি রিপোর্টে রাষ্ট্রপুঞ্জ ও রেড ক্রস সোসাইটি একযোগে এই আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। সংস্থা দু’টির দাবি, হর্ন অব আফ্রিকা তথা আফ্রিকার মূল মহাদেশীয় ভূখন্ডের পূর্বতম অঞ্চল, সাহিল অঞ্চল ও দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ায় তাপপ্রবাহের প্রভাব পড়বে সবচেয়ে বেশি। সোমালিয়া ও পাকিস্তানের মতো দেশ তো এখনই তাপপ্রবাহের সম্মুখীন, ধারণা করা হচ্ছে ভবিষ্যতে তাদের দুর্ভোগ বাড়বে। বাংলাদেশেও তাপ প্রবাহের তীব্রতা বিগত বছরগুলো থেকে এবার অনেক বেশি। পরিবেশের অবক্ষয় ও তাপপ্রবাহের ফলে বৈষম্য থেকে জীবনহানির আশঙ্কা রয়েছে সব কিছুরই। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবিক বিষয় সংক্রান্ত দফতরের প্রধান মার্টিন গ্রিফিথসের মতে, তাপপ্রবাহ, খরা বা বন্যার মতো পরিস্থিতিতে সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় উন্নয়নশীল দেশগুলি। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবিক বিষয় সংক্রান্ত দফতর, রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির আন্তর্জাতিক সংগঠনের (আইএফআরসি) তরফে প্রকাশ করা এই গবেষণামূলক রিপোর্টে বলা হয়েছে, এখন থেকেই জোরকদমে পদক্ষেপ না নিলে আগামী দিনে পৃথিবীর তাপমাত্রা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছবে যেখানে কোনও ভাবেই আর মানিয়ে নিতে পারবে না মানুষ। বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাহিল, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া।তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও অতিরিক্ত নগরায়ণের ফলে আগামী দশকে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির অসুস্থ ও বয়স্ক মানুষদের আয়ু কমবে অনেকটাই। একই প্রভাব দেখা যাবে শিশু ও অন্তঃস্বত্ত্বা মহিলাদের ক্ষেত্রে। ইতোমধ্যে যার প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। রিপোর্টে দাবি, জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করতে যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে এই শতকের শেষে ক্যানসার বা সংক্রামক ব্যাধির ফলে মৃত্যুর হারের সঙ্গে পাল্লা দেবে তাপপ্রবাহে মৃত্যুর হার। মোকাবিলায় পাঁচটি পদক্ষেপের প্রস্তাব দিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জ ও রেড ক্রস। সেগুলির অন্যতম হল, প্রবল গরমে মানুষকে আশ্রয় দিতে তাপনিরোধক জরুরিকালীন আশ্রয়স্থলের ব্যবস্থা। গবেষণাটি চালানো হয়েছে মহাসাগরগুলির একেবারে উপরিতলের ২ হাজার মিটার এলাকার তাপমাত্রা নিয়ে। ১৯৫৫ সাল থেকেই এই তাপমাত্রার রেকর্ড রাখা হচ্ছে। তাতে দেখা গিয়েছে, মহাসাগরগুলির তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ২০২১ সালে। প্রশান্ত মহাসাগরের পানি পর্যায়ক্রমে ঠান্ডা হওয়ার প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া ‘লা নিনা’ সক্রিয় থাকা সত্ত্বেও। গবেষণা জানিয়েছে, মহাসাগরগুলির তাপমাত্রা ২০১৭ সালে ছিল ১৮৯ জেটাজুল্‌স। ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৯৫ জেটাজুল্‌স। ২০১৯ এবং ২০২০ সালে তা বেড়ে হয়েছিল যথাক্রমে ২১০ এবং ২১১ জেটাজুল্‌স। আর গত বছরে তা বেড়ে হয়েছে ২২৭ জেটাজুল্‌স। (মহাসাগরগুলির তাপমাত্রা-বৃদ্ধির ফলে যে পরিমাণ শক্তি নির্গত হয় তা মাপার একক— ‘জুল্‌স’। একের পিঠে ২১টি শূন্য বসালে যে সংখ্যাটি হয়, তাকে এক জুল্‌স দিয়ে গুণ করলে হয় এক জেটাজুল্‌স)। মহাসাগরগুলির এই উত্তরোত্তর তাপমাত্রা-বৃদ্ধির কী কী প্রভাব পড়ছে পৃথিবীর আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপর, গবেষণাপত্রে সেই সবেরও উল্লেখ করা হয়েছে। গবেষণা জানিয়েছে, দশকের পর দশক ধরে তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে আটলান্টিক মহাসাগরের পানির। উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের পানির তাপমাত্রা আশঙ্কাজনক ভাবে বাড়তে শুরু করেছে নব্বইয়ের দশক থেকে। আর ভূমধ্যসাগরের পানির তাপমাত্রা উদ্বেগজনক ভাবে বেড়েছে গত বছর। গবেষকরা জানিয়েছেন, আশঙ্কাজনক হারে মহাসাগরগুলির পানির তাপমাত্রা-বৃদ্ধির ফলে ঘূর্ণিঝড়, হারিকেন, টাইফুন, টর্নেডোগুলি অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। বেড়েছে অতিবৃষ্টির পরিমাণ। তা আগের চেয়ে অনেক বেশি ঘনঘন হতে শুরু করেছে পৃথিবীর সব প্রান্তেই। তার ফলে প্রলয়ঙ্কর বন্যার আশঙ্কা বেড়েছে। উষ্ণায়ন ও দ্রুত হারে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মহাসাগরগুলির তাপমাত্রা আশঙ্কাজনক ভাবে বেড়ে চলেছে।
গত বছর মহাসাগরগুলির সেই তাপমাত্রা-বৃদ্ধি সর্বকালীন রেকর্ড গড়ে ফেলেছে। এ ছাড়াও মহাসাগরগুলির পানির উত্তরোত্তর তাপমাত্রা-বৃদ্ধি গ্রিনল্যান্ড ও আন্টার্কটিকার বরফের পুরু চাঙড়গুলিকে খুব দ্রুত হারে গলিয়ে দিতে শুরু করেছে। এই ভাবে বছরে গ্রিনল্যান্ড ও আন্টার্কটিকার এক লক্ষ কোটি টন বরফ গলে যাচ্ছে। যার পরিণতিতে মহাসাগরগুলির পানি-স্তর আশঙ্কাজনক ভাবে উপরে উঠে আসছে। সভ্যতার নানা কর্মকান্ডে বাতাসে যে পরিমাণে বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস মিশছে,তার এক-তৃতীয়াংশই মহাসাগরগুলি শুষে নিচ্ছে। তার ফলে, মহাসাগরগুলির পানি আরও বেশি পরিমাণে লবণাক্ত হয়ে উঠছে। যার পরিণতিতে এক-চতুর্থাংশ সামুদ্রিক প্রাণীর বাসস্থান যেখানে সাগর, মহাসাগরের সেই প্রবাল প্রাচীরগুলি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অসংখ্য প্রজাতির মাছের মৃত্যু হচ্ছে। এ ছাড়াও জীবাশ্ম-জ্বালানি পোড়ানো, বন কেটে বসত বানানোর উৎসাহে পরিবেশে যে বাড়তি তাপশক্তি নির্গত হয়েছে গত ৫০ বছরে তার ৯০ শতাংশই শুষে নিয়েছে সাগর, মহাসাগরগুলি। আইপিসিসি-র এই রিপোর্টটি অনুমোদন করেছে ১৯৫টি সদস্য দেশ। যা বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে সবচেয়ে বিশদ রিপোর্ট বলে মানছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বিষয়টি নিয়ে বারবার সতর্ক করলেও অভিযোগ, আমেরিকা-সহ একাধিক দেশ যেমন কার্বন নিঃসরণ কমানোর দায় চিন-ভারতের মতো দেশগুলির দিকে ঠেলতে ব্যস্ত, অন্য দিকে এই দেশগুলিও উন্নয়নের প্রসঙ্গ তুলে তা কমানোর দায় উন্নত বিশ্বের কোর্টেই ঠেলে দিচ্ছে। সব মিলিয়ে প্যারিস থেকে গøাসগো জলবায়ু আলোচনা বা চুক্তি- সবই থেকে গিয়েছে নিছক কাগজে-কলমেই। রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমায়িত করার যে আন্তর্জাতিক লক্ষ্য রয়েছে, তা কার্যত ‘লাইফ সাপোর্টে’ রয়েছে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ওই তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রিতে বেঁধে দেওয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছিল, তার দ্বিগুণেরও বেশি, অর্থাৎ তিন ডিগ্রিরও বেশি তাপমাত্রা বাড়তে পারে এই গ্রহের। এই তাপমাত্রাকে কমিয়ে আনার যে সময়সীমা দেওয়া হয়েছে, তা বেশ কম বলেই মানছেন সকলে। আইপিসিসি-র রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১০-২০১৯ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী গড় গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ মানব সভ্যতার ইতিহাসে সর্বোচ্চ পরিমাণে ছিল। বর্তমানে তা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে প্রতীয়মাণ। বিশ্ব উষ্ণায়নকে নিয়ন্ত্রণে আনতে শক্তি ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে জানানো হয়েছে রিপোর্টে। এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে জোর দেওয়া হয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর উপরে। এর পাশাপাশি বিকল্প জ্বালানির (হাইড্রোজেন) ব্যবস্থাও যে প্রয়োজন, তা জানাচ্ছে রিপোর্ট। আইপিসিসি শীর্ষ কর্তা হুসাং লি জানিয়েছেন, বেশ কিছু দেশ পরিবেশগত ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে এবং বাস্তবায়নে সক্রিয় রয়েছে। এই ব্যবস্থা যদি আরও ব্যাপক ভাবে প্রয়োগ করা হয়, নতুন উদ্ভাবনের পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণও কমিয়ে আনা যাবে। রিপোর্টের অন্যতম লেখিকা জয়শ্রী রায় বলেছেন, ‘‘এখনও সময় আছে।তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ঠেকানো সম্ভব।’’ অন্তত ১৮টি দেশ দেখিয়ে দিয়েছে, গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানো সম্ভব। কার্বন মুক্ত কিংবা কার্বন পরিমাণ কম, এমন প্রযুক্তির মাধ্যমে জীবাশ্ম জ্বালানির দহন কমানো সম্ভব হয়েছে। পরিবহণ ক্ষেত্রেও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির মাধ্যমে দূষণ কমানো সম্ভব হয়েছে। গত এক দশকে ব্যাটারির দাম ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাওয়াও এর একটা বড় কারণ। ডিজিটালাইজেশনের ফলেও পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির পরিমাণ বেড়েছে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, গত কয়েক দশকে মেরু অঞ্চলে যে ভাবে বরফ গলে চলছে, পৃথিবীর নানা প্রান্তে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটেছে, তা এই বিপর্যয়েরই ইঙ্গিত। বারবার সতর্ক করা হলেও অধিকাংশ দেশই তা কার্যত অগ্রাহ্য করেছে। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরেই পরিবর্তন চোখে পড়ছিল। তবে আগে যা ছিল স্তিমিত, ধীর গতি, এখন সেই পরিবর্তন ঘটছে দ্রুত গতিতে। এখনই সংযত না হলে ধ্বংসের আর বেশি বাকি নেই। বেশ কয়েক বছর ধরে সতর্ক করার পর এ বার জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এমনই লাল সঙ্কেত দিল রাষ্ট্রপুঞ্জ। ১৯৫টি সদস্য দেশকে নিয়ে বৈঠকে জলবায়ু পরিবর্তনের ষষ্ঠ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের আন্তঃরাষ্ট্র প্যানেল (আইপিসিসি)। তাতে বলা হয়েছে, এ ভাবে চলতে থাকলে কোনও দেশই রক্ষা পাবে না। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন কতটা উদ্বেগজনক জায়গায় পৌঁছেছে, তা-ও বিশদে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ওই রিপোর্টে। বলা হয়েছে, কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যে এই উষ্ণতা বৃদ্ধি সীমাবদ্ধ নেই। বিশ্বের সর্বত্র লাগাতার এই বৃদ্ধি ঘটছে। দ্রæত গতিতে উষ্ণতা বাড়লেও, তা শীতল হতে সময় লেগে যাচ্ছে অনেকটা, এত দিন যা লক্ষ করা যায়নি। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণেই জলবায়ু সহনশীলতার মাত্রা পেরিয়ে যাচ্ছে। তাই ১৯৫০ সালের পর থেকে তাপপ্রবাহের তীব্রতা ক্রমাগত বেড়ে চলছে এবং আগের থেকে তা ঘন ঘন তাপপ্রবাহ বইছে। সেই তুলনায় শৈত্যপ্রবাহের তীব্রতা অনেক কম এবং ঘন ঘন তার প্রকোপে পড়তে হয় না বলে দাবি করেছেন বিজ্ঞানীরা।
বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য মনুষ্যঘটিত কারণগুলির উপরই জোর দিয়েছেন এ বিজ্ঞানীরা। তাঁদের দাবি, শহর এলাকাগুলিই উষ্ণায়নের মূল কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।লাগাতার তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে উষ্ণ বাতাস সেখানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে, যা শীতল হতে দীর্ঘ সময় লাগে। এই একই কারণে নদী, হ্রদ, জলাধার তো বটেই, গাছগাছালিতে ঘেরা সবুজ এলাকাগুলিতেও উষ্ণতা বহু ক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। এভাবে চললে, প্রতি ১০ বছরে এক বার বা প্রতি ৫০ বছরে এক বার যে তীব্র বন্যা, খরা হয়, আগামী দিনে তা আরও ঘন ঘন দেখা দেবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীরা। যে সব জায়গায় এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সচরাচর চোখে পড়ে না, সেগুলিও বাদ যাবে না বলে জানিয়েছেন তাঁরা। এমনকি একই জায়গায়, একই সময়ে তাপপ্রবাহ এবং খরা একই সঙ্গে দেখা দিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না বলে মত তাঁদের। বিজ্ঞানীদের দাবি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বাতাসের গুণমান একই মুদ্রার দুই পিঠ, পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তাই বিশ্ব উষ্ণায়নকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে একসঙ্গে দু’টো দিকেই নজর দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে ঘনবসতি, যত্রতত্র গগনচুম্বী ভবন নির্মাণে রাশ টানতে হবে। অন্যায্য জলাধার ভরাট, পাহাড় ও বৃক্ষ কর্তনের নিয়মিত সক্রিয়শীলতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যেকোনো উপায়ে। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট নির্মাণের সরঞ্জামের দিকে নজর দিতে হবে। আরও বেশি করে সবুজ জঙ্গল, উদ্যান তৈরি করতে হবে। গার্হস্থ্য এবং শিল্পজনিত উষ্ণতাবৃদ্ধির কারণগুলিও খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে হবে সব দেশের সরকারকে। জীবাশ্ম জ্বালানি, গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন কমিয়ে আনতে হবে। তাতে চলতি শতকের কিছুটা হলেও বিশ্ব উষ্ণায়নে রাশ টানা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তাঁরা। দাবানল, অতিবৃষ্টি, বন্যায় যখন পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ বিধ্বস্ত, তখনই আর একটা খারাপ খবর এল। জানা গেল, যা হিসেব করা গিয়েছিল, তার চেয়েও অনেক দ্রুত গরম হয়ে উঠছে পৃথিবী, এবং চলতি দশক শেষ হওয়ার আগেই তা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বিপদসীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে। যে ধরনের তাপপ্রবাহ অর্ধশতকে এক বার হত, তা এখন প্রতি দশকেই দেখা যাচ্ছে। বিশ্বের তাপমাত্রা আর ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেই এমন ঘটনা প্রতি সাত বছরে দু’বারও ঘটতে পারে। ক্রমশ দ্রæততর হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন, যার ফলে জলবায়ু সংক্রান্ত বিপর্যয়ের ঘটনা বেড়ে চলছে। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জাতিসংঘের আন্তঃসরকার সংগঠন ‘আইপিসিসি’-র সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বিপর্যয়ের আঁচ দেওয়া হয়েছে। তিন হাজার পৃষ্ঠারও বেশি দীর্ঘ এই প্রতিবেদন তৈরি করেছেন ২৩৪ জন বিজ্ঞানী। তাঁরা দেখিয়েছেন, ক্রমশ দ্রæততর হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন, যার ফলে জলবায়ু সংক্রান্ত বিপর্যয়ের ঘটনা বেড়ে চলছে। সম্প্রতি আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলে একই সঙ্গে ঘটে গিয়েছে দাবানল, খরা ও তাপপ্রবাহ। এবং, এই ধরনের ঘটনা এখন বাড়তে থাকবে বলেই অনুমান। মানুষের কর্মকান্ডের ফলে বিশ্ব উষ্ণায়ন যত বাড়বে, তত বৃদ্ধি পাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, গলে যাবে মেরু অঞ্চলে বরফের আবরণ, আর বেড়ে চলবে তাপপ্রবাহ, খরা, বন্যা ও ঝড়ের মতো আবহাওয়ার চরম আচরণ। আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনার সঙ্গে সভ্যতার অবস্থার একটা সরাসরি যোগ আছে। বিজ্ঞানীরা এখন জানেন যে, ১১ হাজার বছর ধরে সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সুস্থিত ও অনুমানযোগ্য আবহাওয়া পরিস্থিতির সম্পর্ক আছে। আবহাওয়া বিষয়টা যত বাঁধাধরা হিসেবের মধ্যে এসেছে, মানবজাতি ততই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে পেরেছে। তারা মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে কৃষিব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হয়েছে, নির্ভরতা দিতে পেরেছে বৃহৎ সংখ্যক গোষ্ঠীকে। আবার, আবহাওয়ার আচমকা বদলের ফলে বহু সভ্যতার পতন ঘটেছে, সেগুলি সময়ের সঙ্গে মুছেও গিয়েছে। এই ধরনের বিপর্যয় যদিও বিরল, বিচ্ছিন্ন। ৯০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তাদের দর্শনীয় নগরগুলি ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেন মধ্য আমেরিকার মায়া সভ্যতার মানুষেরা। এ সময় সেখানে প্রবল ও দীর্ঘকালীন খরা দেখা দিয়েছিল।আজ বহু মায়ান এই পৃথিবীতে বাস করলেও তাঁদের প্রাচীন শক্তিশালী সাম্রাজ্যের চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট নেই। সেই সাম্রাজ্য কিন্তু টিকেছিল ৩,০০০ বছর। এখনই যদি সতর্ক না হই তাহলে মানব সভ্যতা হুমকিতে পড়বে নিশ্চয়।মানব সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে এখনই প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। প্রয়োজন সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা ও সক্রিয়তায়। আইপিসিসি-র প্রণেতারা দেখাচ্ছেন যে, সমস্ত রাষ্ট্র এক সঙ্গে হাত মেলালে আসন্ন বিপর্যয় রুখে দেওয়া যেতেও পারে। কিন্তু পৃথিবী কি পাল্টাবে? মানুষ কি ভোগ কমিয়ে সংরক্ষণ বাড়াবে? তারা কি প্রকৃতির সঙ্গে লগ্ন হয়ে থাকার চেষ্টা করবে? সহজ-সরল জীবনযাপনে কেউই রাজি হবে না। প্রগতির ধারণাই হল ক্রমবর্ধমান ঐশ্বর্য— আরও বেশি ভোজন-ভ্রমণ-পরিধান-অর্থব্যয়। প্রাণিজাত প্রোটিন, ভ্রমণ, বিলাস ও ভোগের চাহিদা বজায় রাখতে আরও আরও শক্তি খরচ করবে মানুষ। সবাই এখন ভোগের দুর্দমনীয় স্পৃহায় মত্ত। বলা হচ্ছে এ পথেই জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা, দেখানো হচ্ছে বস্তুগত চাহিদা পূরণের স্বপ্ন। এখনই যদি সতর্ক না হই তাহলে মানব সভ্যতা হুমকিতে পড়বে নিশ্চয়। মানব সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে এখনই প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। আমাদের সাথে প্রকৃতি ও পরিবেশের সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে। সবুজের সমারোহ, প্লাস্টিকের বর্জন এবং তা বাস্তবায়ন।প্রাচীনকালে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকে মানুষ অন্যতম কর্তব্য বলেই বিবেচনা করত। ফলে, আলাদা করে পরিবেশ বাঁচানোর আন্দোলনের দরকার হয়নি। পরে, প্রাকৃতিক পরিবর্তনের হার এত তীব্র হয়েছে যে, তাকে রক্ষা করার ডাক দিয়ে বারবার পথে নামতে হয়েছে মানুষকে। নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে সর্বোপরি মানবসভ্যতাকে বেগবান রাখতে পরিবেশের প্রতি যতœবান হই। কবিগুরুর ভাষায়- ‘এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে, এসো করো স্নান নবধারাজলে।’
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট