প্রিয় নবীর (সা.) আদর্শ অনুসরণই হোক মিলাদুন্নবীর অঙ্গীকার

8

 

নবম হিজরি। রমজান মাস। প্রচন্ড তাপদাহে জনজীবন ওষ্ঠাগত। আকাশ থেকে যেন আগুন ঝরছে। সূর্য অগ্নিরূপ ধারন করেছে। মদীনার অলি-গলিতে বয়ে যাচ্ছে লু হাওয়া। বাগানে থোকায় থোকায় খেজুর হলুদাভ হয়ে উঠেছে। একদিকে খাদ্য সংকট অন্যদিকে নতুন ফসলের হাতছানি। এমন সময় ডাক এলো তৎকালীন বিশ্বের সর্ববৃহত পরাশক্তি রোম সা¤্রাজ্যের সাথে জিহাদের! মদীনা থেকে প্রায় ৭০০ কিমি দূরের পথে যাত্রা শুরু করলেন প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম ও তাঁর জিহাদী কাফেলা। মাথার উপর সূর্যের তীব্র প্রখরতা আর পায়ের নিচে পাথুরে মাটি যেন অগ্নিগোলা! খাদ্য সংকট, যুদ্ধ সরঞ্জাম ও রসদের তীব্র অভাব আর সমস্ত প্রতিক‚লতাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের প্রেমে ভাসিয়ে দিয়ে ছুটে চললো কাফেলা। মদীনা প্রায় খালি হয়ে গেল। শুধু মুনাফিক আর মুষ্টিমেয় কয়েকজন সাহাবী ছাড়া বাকি সবাই শহীদি শূরা পানের আকাক্সক্ষায় তাবুকের পথে। এই মুষ্টিমেয় কয়েকজনের মধ্যে একজন সাহাবী হলেন হযরত আবু খায়সামা (রা.)। পায়চারি করছেন বাগানে কিন্তু নয়নাভিরাম খেজুর বাগান, পাকা খেজুর, বাগানের শীতল ছায়া কোন কিছুই ভালো লাগছে না। সবকিছু থাকার পরও হৃদয়ে যেন কীসের হাহাকার! কোথাও শান্তি নেই, সময়গুলি যেন ভারী হয়ে আসছে। তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় ছটপট করছে আবু খায়সামা (রা.)। প্রিয় স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্য দুই স্ত্রী বাগান মাঝে গাছের ছায়ায় নরম বিছানা পেতে দিলেন, শীতল পানি আর বাহারি খাবারের আয়োজন করলেন কিন্তু পৃথিবীর কোন ঐশ্বর্য তাঁর কাছে ভালো লাগছে না। তিনি ভাবতে লাগলেন মানবতার মুক্তির দূত, শাফায়াতের কাÐারি, আল্লাহর প্রিয় রাসুল উত্তপ্ত পাথুরে পথ পাড়ি দিচ্ছে আর আমি আরামদায়ক বিছানায় বিশ্রামে থাকব! না, তা কখনো হতে পারে না। তাঁর রক্ত প্রবাহে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) প্রেমের ঢেউ বয়ে গেল। অন্তরাত্মায় প্রচÐ এক ঝড় উঠল। সাথে সাথে পার্থিব সুখের সকল আয়োজনকে দুমড়ে মুচড়ে রওয়ানা হলেন তায়েফের পথে, নিজেকে বিলীন করে দিলেন নবী (সা.) প্রেমের সুগভীর সমুদ্রে। আবু খায়সামা ময়দানে পৌঁছুলে প্রিয় নবী তাকে সম্বোধন করে বললেন- ধ্বংসের উপত্যকা থেকে তুমি বের হয়ে এসেছ, তোমাকে স্বাগতম।
এভাবে অগনিত ত্যাগের সমুজ্জ্বল সাধনায় ভাস্বর ছিল প্রিয়নবীর (সা.) সাহাবায়ে কেরামগণের জীবন। আর আজকে আমরা মাহে রবিউল আউয়াল আসলেই কেবল নবী প্রেমের চর্চা করি। অন্যান্য পার্থিব বিষয়ের মতো দ্বীনের বিষয়কেও যেন আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। মিলাদুন্নবীর মাস আসলে আমাদের মনে পড়ে রাসুলে আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের আগমনে আইয়্যামের জাহেলিয়াতের অমানিষার কালো মেঘ সরে গিয়ে পৃথিবী আলোর মুখ দেখেছিল। পাপাচার আর মূর্খতার অভিশপ্ত রাত পেরিয়ে সৌভাগ্যের আলো ঝলমল প্রভাত এসেছিল। এ মাসেই আমাদের মনে পড়ে মানবাধিকার বঞ্চিত সমাজে প্রিয়নবী এসেই মানবাধিকারের বীজ বপন করেছিলেন, ফিরিয়ে দিয়েছেন নারীর অধিকার এবং বসিয়েছেন সম্মানের এক অনন্য উচ্চতায়। অত্যাচার, অনাচার আর সকল অনৈতিকতা প্রতিকারের মহৌষধ নিয়ে তিনি পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন, মানবতাকে ধ্বংসের উপত্যকা থেকে টেনে তুলে সত্যিকারের এক মানবিক সমাজ উপহার দিয়েছিলেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। কিন্তু কীভাবে তিনি এসব করেছিলেন তার কথা আমাদের স্মরণে আসে খুবই কম। আমরা ভুলে গেছি প্রিয় রাসুলের সংগ্রামী জীবনের কথা, তাঁর উপর কাফের মুশরিকদের অত্যাচারের কথা। আমরা ভুলে গেছি তাঁর শিক্ষানীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, সমরনীতির কথা। দুজাহানের বাদশাহ হওয়ার পরও অতি সাধারণ জীবন যাপনের কথা আমরা ভুলে গেছি। আমরা ভুলে গেছি কাবান্ত্যরের ৩৬০ মুর্তি অপসারণ করে ঐসব মুর্তিপুজকদের কীভাবে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিয়ে খাঁটি ঈমানদার বানিয়েছেন। ভুলে গেছি তায়েফের ময়দানে পাথরে পাথরে জর্জরিত করা রক্তাক্ত ইতিাসের কথা। ভুলে গেছি বদরের ময়দানে অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ, উহুদের রক্তের স্রোত ধারা, খন্দকের ভয়াল রাতের কঠিন পরীক্ষা, হুনায়নের যুদ্ধে শত্রুদের তীরবৃষ্টি, তাবুকের চামড়া ঝলসে দেয়া সূর্যতাপ! প্রিয়নবীর হিজরতের কথা. প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যাওয়ার সে কী বেদনা, প্রিয়নবীর প্রিয় সাহাবীদের জ্বলন্ত কয়লার উপর টানা হেঁচড়া করা, গলায় রশি পেঁচিয়ে মক্কার গলিতে ঘুরানোর নির্মমতা আমরা ভুলে গেছি। আমরা ভুলে গেছি আল-আরওয়া থেকে তাবুক পর্যন্ত ২৭টি যুদ্ধে প্রিয়নবীর সক্রিয় অংশ গ্রহণের কথা। আমাদের মনে পড়েনা শি’আবে আবি তালিবে বর্ণনাতীত কষ্ট আর যাতনার সেই নির্বাসনের কথা। আজকে আমরা রাসুল প্রেমের কথা বলি অথচ নিজেদের কথা-কাজে, চিন্তা-চেতনায়, শিক্ষা-দীক্ষায় কতটুকু তা লালন করি তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। যে রাসুল (সা.) সারাজীবনে উম্মতের জন্য কেঁদেছেন সেই উম্মত হয়ে আমরা কতটুকু কী করছি তা ভাববার বিষয়। আল্লাহর জমিনে দ্বীন ইসলামকে প্রতিষ্ঠার জন্য রাসুল (সা.) সারাজীবন যে সাধনা ও ত্যাগ দিয়েছেন তা নিজেদের জীবনে কতটুকু ধারন করি বা রাসুল (সা.) প্রেমে নিজেদেরকে সঁপে দেয়ার জন্য আমরা কতটুকু প্রস্তুত তা গভীর ভাবে ভাবতে হবে!
সময় এসেছে চিন্তার পরিধিকে প্রসারিত করে আনুষ্ঠানিকতার বাহুল্যতাকে প্রাধান্য না দিয়ে মৌলিকত্বের দিকে বেশি বেশি ফোকাস করা। ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রিয় নবীর (সা.) দর্শন চর্চা করে ইসলামের সুমহান ও কালজয়ী আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করা। মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন আন্ষ্ঠুানিকতায় ভরপুর না করে আমাদেরকে প্রিয়নবীর (সা.) পূর্ণাঙ্গ জীবন দর্শন নিজেদের জীবনে কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায় এবং সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পরিমÐলে তা কীভাবে বিস্তৃত করা যায় সেই বিষয়ে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া অতীব জরুরি। জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রিয়নবীর আদর্শের প্রতিফলন ঘটাতে না পারলে অনুষ্ঠাননির্ভর মিলাদুন্নবী (সা.) পালন আমাদের জীবনে সামগ্রিক কোন পরিবর্তন আনবে না। আল্লাহ! আমাদের সকলকে তোমার প্রিয় হাবীবের (সা.) পথে ও মতে জীবন অতিবাহিত করার তওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক