উপেক্ষিত প্রবীণ সমাজ

12

 

প্রায় পঁচিশ বছর আগে একজন রোগীকে নিয়ে ভারতের তামিলনাডোর ভেলোর ক্রিশিয়ান হাসপাতালে (সিএমসি) গিয়েছিলাম। ফেরার পথে কাটপট্টি স্টেশনে গিয়েছি রেলের টিকেট ক্রয়ের উদ্দেশ্যে। টিকেট কাউন্টারের কিউতে তিনটি সারি। একটি ভড়ি কম দেখে দাঁড়িয়ে যাই। খটকা লাগলেও দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় রেলপুলিশ জানালো, এটা প্রবীণদের কিউ। তোমার সাথে কোন প্রবীণ আছে ? না বলার পর সে বললো, এটা প্রবীণদের জন্য ৬০ শতাংশ ছাড়ের কিউ। সরি বলে সরে দাঁড়ালাম আর অবাক হলাম প্রবীণদের প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা ও মমতা দেখে। যতদূর জানি শুধু ভারত নয় বিশ্বের অনেক দেশে প্রবীণদের জন্য আছে রাষ্ট্রীয়ভাবে নানাবিধ সুযোগ সুবিধা ও কল্যাণমূলক কার্যক্রম।
আমরা কোথায় ! নৈতিকভাবে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। বাসে ট্রেনে পথে ঘাটে বাজারে এমন কী চিকিৎসালয়ে সর্বত্র আমাদের প্রবীণরা অবহেলিত ও অশ্রদ্ধার। এদেশে ৮০ শতাংশ মুসলিম। ইসলাম ধর্মের পবিত্র কোরান এবং হাদিসে পিতামাতাসহ প্রবীণদের বিষয়ে বারবার বলা হয়েছে তাদের সম্মান ও পরিচর্যা করার কথা বলা হয়েছে। তারপরও এদেশে প্রবীণরা বরাবরই উপেক্ষিত। ৫০/৬০ বছর আগেও পাড়া মহল্লায় তরুণ সমাজ শ্রদ্ধার চোখে দেখতো প্রবীণদের। বলা যায় স্বাধীনতার পরবর্তী সময় সমাজে অবক্ষয়ের কারণে প্রবীণদের প্রতি সদাচরণ করার প্রবণতা কমে আসছে। অথচ ২০১৩ সালে দেশের জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের ‘সিনিয়ার সিটিজেন নীতিমালা’ প্রণয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আহŸান করেন।
প্রতিবেশি দেশ ভারতে ২০০৭ সালে প্রবীণ নীতিমালা প্রণয়ন করে। দেশের সকল শ্রেণীর প্রবীণগণ যাতে করে মর্যাদার সাথে জীবনযাপন করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে প্রত্যেক প্রবীণ চান সচ্ছল, স্বাস্থ্য এবং সমাজহিতৈষী জীবন। সে কারণে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে (ক) প্রত্যেক প্রবীণ যেন আমৃত্যু সুস্থ ও সবল জীবন যাপন নির্ভয়ে করতে পারেন। (ক) কোন প্রবীণ যেন আর্থিক অনটনে না ভোগেন (গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রবীণ বয়সে মানুষ বেশি বেশি জরা জীর্ণ ও অসুস্থতায় ভোগেন। এসময় তাদের চিকিৎসা ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যায়। অথচ তারা তখন রোজগারজীন অবস্থায় থাকেন। (গ) সকল শ্রেণীর প্রবীণরা যেন তাদের সময় সামর্থ্য এবং অভিজ্ঞতা দেশ ও সমাজের জন্য ব্যয় করতে সক্ষম হন। প্রবীণদের মর্যাদা পূর্ণজীবন যাপনের জন্য বিশ্বের মানব সমাজকে উৎসাহিত করার জন্য পহেলা অক্টোবর ‘বিশ্ব প্রবীণ দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের সরকার প্রবীণদের যথাযথ মর্যাদায় জীবন যাপনের জন্য প্রবীণ ভাতা প্রদান এবং পিতা মাতা ভরণ পোষণের জন্য আইন প্রণয়ন করেছে।
আমরা মনেকরি সরকারের উচিত হবে প্রবীণদের জন্য একটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা এবং তদউদ্দেশ্যে একটি তহবিল গঠন করা আবশ্যক। এই ফাউন্ডেশন, আপাতত তিনটি শাখায় বিনস্ত করা যেতে পারে। প্রথমত: স্বাস্থ্য শাখা, দ্বিতীয়ত: অর্থ উপার্জন সহায়তা শাখা, তৃতীয়ত: প্রশিক্ষণ ও নিরোগ শাখা। দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতি সংকটে প্রবীণদের ভূমিকা অতিগুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণত বলা যেতে পারে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসু জিম্বাবুইয়ের প্রেসিডেন্ট বরাট মুগাবে, গ্যারনের প্রেসিডেন্ট ওমর বঙ্গো যারা দুই তিন দশক পর্যন্ত বৃদ্ধ বয়সেও দেশের সেবা করে যেতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলাদেশে ২০১৩ সালে ‘মাতা-পিতার ভরণ-পোষণ আইন-২০১৩ প্রণীত হয়। দুঃখজনক হলেও দেশের বেশির ভাগ পিতা মাতা তার সন্তান কর্তৃক অবহেলিত ও উপেক্ষিত। তাই দেশে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগও বাস্তবায়ন আজ সময়ের দাবি।
আমাদের উপেক্ষিত জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের সম্মান জনক জীবন যাপনে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সচেতন হওয়ার পাশাপশি প্রশাসনও সরকারের নীতি নির্ধারকদের আরও আন্তরিক ও সংবেদনশীল হতে হবে। এই প্রবীণ সমন তাঁদের যৌবনে মেধা, শ্রম দিয়ে দেশ ও জাতির সেবা করে গেছেন। তাঁদের জীবন সায়াহ্নে তাঁদের প্রতি সংবেদনশীল হলে জাতি ও দেশ উপকৃত হবে। প্রবীণদের জন্য নীতিমালা ও আইন এবং প্রবীণভাতা যথাযথ হতে পারে না, যতক্ষণ না তার পরিবার পরিজন ও জাতি তাঁদের প্রতি সহমর্মিতার হাত না বাড়ায়। একইভাবে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে তাদের রেখে তাদের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালিত হবে না। তাদের প্রতি মমত্ব এবং পরিবারের সাথে রেখে পরিচর্যা ও স্বাভাবিক জীবন যাপনের প্রতি দৃষ্টি দান বাঞ্ছনীয়। আসুন আমাদের উপেক্ষিত প্রবীণ সমাজের প্রতি আরও বেশি বেশি মমত্ব প্রকাশ করি।

লেখক : কবি, নিসর্গী, ব্যাংক নির্বাহী (অব.)