সিআরবি নয় বিকল্প ভেন্যুতে হাসপাতাল নির্মাণ হউক

41

 

ফুসফুস মেরুদন্ডী প্রাণির একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ,যা শ্বাস প্রশ্বাসের কাজে ব্যবহৃত হয় এবং এর প্রধান কাজ হলো বাতাস থেকে অক্সিজেনকে রক্ত প্রবাহে নেয়া এবং রক্তপ্রবাহ থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইডকে বাতাসে নিস্কাশন করা। ঠিক তেমনিভাবে গাছপালা হলো প্রকৃতির ফুসফুস যেটি বায়ুমন্ডল থেকে কার্বনডাই-অক্সাইডকে গ্রহণ করে অক্সিজেন ত্যাগ করে। আর অন্যদিকে বায়ুমÐলের এই অক্সিজেন গ্রহণ করে প্রাণিকুল তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। ফুসফুস ছাড়া যেমন মানবজীবন কল্পনা করা যায় না ঠিক তেমনি গাছপালা ছাড়া প্রকৃতির অস্তিত্ব আশা করা যায় না। নদী বেষ্টিত পাহাড় পর্বতে ঘেরা বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তর বন্দরনগরী হলো চট্টগ্রাম। আর এই চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত বিচিত্র বৃক্ষরাজি যেমন শতবর্ষী রেইনট্রি, জারুল, নিম, সেগুন, কড়ই ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ স্থান হলো সিআরবি, যা ২০০ বছর আগের ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া সৌন্দর্যের নিদর্শন। সেই ব্রিটিশ থেকে আসাম-বাংলা রেলওয়ের ‘সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং’ সংক্ষেপে সিআরবি এক সময় বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান দপ্তরের মর্যাদায় অধিষ্টিত ছিলো।কালের বিবর্তনে সেই প্রধান দপ্তর বাণিজ্যিক রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করা হলেও কালজয়ী ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী এখনো সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত আছে সিআরবি চট্টগ্রামে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের স্মৃতিধন্য এই জায়গায় রয়েছে ’৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত অনেক শহীদের সমাধিস্থল সহ বহু স্মৃতিচিহ্ন। এই জায়গার সৌন্দর্য বৃদ্ধিকল্পে সাত রাস্তার মোড় ঘিরে তৈরি করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন হাঁটার পথ এবং পাহাড় ঘেরা মনোরম পরিবেশে নির্মাণ করা হয়েছে শিরীষ তলা সহ বেশ কিছু নান্দনিক স্থাপনা। নাগরিক জীবনে ক্লান্ত নগরবাসী একটু পার্থিব জগতের সকল ব্যস্ততার ফাঁকে বুক ভরে শ্বাস নেয়ার জন্য ছুটে আসে শতবর্ষী রেইনট্রি গাছের নিচে যেখানে গাছের শীতলতার পরশে নির্মল বায়ু গ্রহণ করে নগরবাসী প্রশান্তির ছোঁয়ায় মেতে ওঠে। এখানে একেকটা গাছের দিকে তাকালে দর্শনার্থী যেন নিজের অজান্তেই হারিয়ে যায় কোনো অজানা অতীতে এবং সাথে সাথে শেকড়ের সন্ধানে মন আনন্দে হিল্লোলিত হয়ে ওঠে। পুরো এলাকায় দৃষ্টিনন্দন আঁকা-বাঁকা সর্পিল রাস্তা, উচুঁ নিচু সবুজ পাহাড় টিলা, বন-বনানী ছায়া সুনিবিড় এই বিরাট এলাকাটি ভ্রমণের জায়গা হিসেবেও যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণকে দিয়ে আসছে বিনোদনের আস্বাদন। যদি গভীর দৃষ্টিতে বৈজ্ঞানিক ভাষায় চিন্তা করি তবে এটিকে কার্বন শোষণের প্রাকৃতিক কারখানা বললেও ভ‚ল হবে না। আসলেই সত্যিকার অর্থে এই প্রাকৃতিক পরিবেশ কিন্তু রাতারাতি সৃষ্টি হয় নি। অথচ এই দৃষ্টিনন্দন জায়গাটি বর্তমানে হাসপাতাল নির্মাণের নিমিত্তে ধ্বংস করার পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। এক সময় চট্টগ্রামে বাঙালির প্রাণের মিলন উৎসব বাংলা নববর্ষ উদ্যাপিত হতো ডিসি হিলে। ক্রমেই এই উৎসবের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় আয়তন অবয়বে জনসমাগমের ধারণ ক্ষমতা ডিসি হিলে বৃদ্ধি সম্ভব না হওয়ায় সাথে বিকল্প ভেন্যু সিআরবির শিরীষ তলায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সমাজ কর্মী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে শুরু হয় প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ উদযাপন। এক কথায় বলতে গেলে বাংলা নববর্ষ ও বৈশাখী মেলাতে লোকজ সংস্কৃতির অন্যতম পাদপীঠে রূপান্তরিত হয়েছে এই সিআরবি’র শিরীষ তলা।কিন্তু বর্তমানে দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে বহুমাত্রিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এই সিআরবি এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও কৃষ্টিগত সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে বাংলাদেশ রেলওয়ে ৬ একর জায়গা জুড়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনার শিপের ভিত্তিতে ঐ এলাকায় বাণিজ্যিক ভাবে একটি হাসপাতাল, একটি মেডিকেল কলেজ ও একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট স্থাপনের জন্য সম্পাদিত চুক্তির আলোকে যখন ঐ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ কাজ শুরু করে তখন চট্টলবাসীর হৃদয়ে রক্ত ক্ষরনের সঙ্গে সঙ্গে সিআরবি এলাকায় বর্তমান প্রজন্ম থেকে শুরু করে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন সহ সর্বস্তরের জনতা একসাথে মেতে ওঠে ঐ এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সামিল হওয়া মানববন্ধনে।হাতে প্ল্যাকার্ড, কন্ঠে উদ্দীপনার মন্ত্র, কখনো প্রতিবাদী গান কিংবা কবিতার শাণিত পংক্তিমালা নিয়ে বর্তমান প্রজন্ম আজ এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক কাতারে নিয়ে এসেছে সমগ্র চট্টগ্রামবাসীকে জনতার জনস্রোতে। স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল জনস্রোত হৃদয়ে, মননে ও চিন্তায় একাকার হয়ে সিআরবি এলাকায় মেতে উঠেছে এই প্রতিবাদী মানববন্ধনে। প্রাণ প্রকৃতিতে ভরা এমন জায়গায় কংক্রিটের ভারী স্থাপনা নির্মাণ করে এখানে হাসপাতাল তৈরি করলে বিতাড়িত হবে প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর উৎপন্ন হবে পরিবেশ বিপন্নকারী মেডিকেল বর্জ্য,সাথে গড়ে উঠবে অসংখ্য দোকানপাট।
আর এতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ পরিবর্তিত হয়ে সৃষ্টি হবে অশান্তিতে পরিপূর্ণ এক যান্ত্রিক পরিবেশ। আসলেই সার্বিক দৃষ্টিতে চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার। আর জনগণের এই মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকল্পে উন্নত চিকিৎসা সেবা প্রাপ্তির লক্ষ্যে দরকার উন্নত হাসপাতাল। চট্টগ্রামে উন্নত একটি হাসপাতাল হোক এটি সবাই চাই।কিন্তু প্রকৃতিকে ধ্বংস করে এটি নির্মাণ করা কারো কাম্য নয়। এ প্রসঙ্গে আমি বলতে চাই যেমন চট্টগ্রামের আমবাগান এলাকার দিকে এখনো বাংলাদেশ রেলওয়ের অনেক খালি জায়গা পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে,যেখানে এরকম আরো হাসপাতাল নির্মাণ সম্ভব।আসলেই সত্যিকার অর্থে চট্টগ্রামে আধুনিক -বিশেষায়িত বিশ্বমানের হাসপাতাল নেই বললে চলে। এখনো চট্টগ্রাম থেকে অনেক জটিল রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যখন লাইফসাপোর্টে ঢাকা নেয়া হয় তখন অনেকে অসুস্থ অবস্থায় দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার কারনে পথেই মৃত্যুবরণ করছে, যা কোন অবস্থায় একজন লোকের পক্ষে তাঁর প্রিয়জনের মৃত্যু মেনে নেয়া সম্ভবপর হয়ে উঠে না।এ কারণে আমি বলব চট্টলবাসীর বিশ্বমানের স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তির লক্ষ্যে সিআরবিতে জীব বৈচিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ ইকোসিস্টেমের অঙ্গহানি না করে যদি রেলওেয়ের পরিত্যক্ত কোন জায়গায় এই হাসপাতাল নির্মাণ করা হয় তবে চট্টগ্রামের ফুসফুস সিআরবিও রক্ষা পাবে এবং সাথে সাথে মানুষের মৌলিক চাহিদা স্বাস্থ্যসেবাও নিশ্চিত হবে বলে আমি বিশ্বাস রাখি।আশা করি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ ও মানবতাবাদী এবং নন্দিত জননেত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বাসীর সাথে একাত্বতা হয়ে বিকল্প কোন ভেন্যুতে এই হাসপাতাল নির্মাণে তিনি উদ্যোগটুকু গ্রহণ করবেন এই আশাটুকু ব্যক্ত করছি।