মানবপাচার শুধু অপরাধ নয় এটি মানবাধিকার লঙ্ঘন

163

মানবপাচার আইন ২০১২ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির প্রতি জবরদস্তিমূলক শ্রম আদায়, দাসত্বমূলক আচরণ, পতিতাবৃত্তি বা যৌন শোষণ বা নিপীড়ন করা হলে তা মানবপাচার হিসেবে গণ্য হবে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ওয়ার্ক ফ্রি ফাউন্ডেশনের গত বছর (২০১৭) প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা যায়, বিশ্বে ২৪.৯ মিলিয়ন মানুষ দাস প্রথার শিকার। রিপোর্টে আরও বলা হয়, পাচারের শিকার ভিকটিমদের মধ্যে নারী ও মেয়ে শিশু ৭১ শতাংশ এবং পুরুষও ছেলে শিশু ২৯ শতাংশ। বর্তমান বিশ্বে মানব পাচারকে অত্যাধিক লাভজনক ব্যবসা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।আইএলও এর ২০১৪ সালে প্রকাশিত অন্য একটি রিপোর্টে বলা হচ্ছে, মানব পাচারের মাধ্যমে পাচারকারীরা বছরে ১৫০বিলিয়ন ডলার আয় করে। যার মধ্যে ৯৯ বিলিয়ন ডলার আয় হয় যৌন পেশায় বাধ্য করার মাধ্যমে। স¤প্রতি গত বছর রাশিয়ায় ফুটবল বিশ্বকাপ কে ঘিরে বাংলাদেশি দালালেরা ইউরোপে পাঠানোর কথা বলে মানব পাচারের ফাঁদ পেতেছে। মিথ্যা আশ্বাস ও ভুল তথ্য দিয়ে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশিদের রাশিয়া হয়ে ইউরোপের ইতালি, পোল্যান্ড ও লিথুনিয়া নিয়ে যাওয়ার জন্য চুক্তি করে। বিশ্বকাপ চলাকালীন রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশ সীমান্ত পাড়ি দেয়ার সময় সেসব দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে আটক হন বাংলাদেশিরা.২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের হিসাব মতে ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষকে বঙ্গোপসাগর দিয়ে পাচার করা হয়েছে।যাদের মধ্যে অধিকাংশ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। স¤প্রতি জানুয়ারি থেকে জুলাই ২০১৯ অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমকালে উদ্ধারকৃত পুরুষ সংখ্যা ২৩৬জন নারী ৮৪ শিশু ২১ তাছাড়া সীমান্ত অতিক্রমের সময় বিজিবি কর্তৃক আটক ৩৪৭জন। দীর্ঘদিন ধরে দÐবিধি ফৌজদারি কার্যবিধি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মানবপাচার অপরাধের বিচার করা হতো।২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রথম মানবপাচার প্রতিরোধ এবং এ সংক্রান্ত অপরাধের বিচারের জন্য একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের ৬ ধারা অনুসারে মানবপাচার নিষিদ্ধ এবং যাবজ্জীবন কারাদÐ ও কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদÐ এবং কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদÐের বিধান আছে। ৭ ধারা অনুসারে, সংঘবদ্ধ মানবপাচার অপরাধের দÐ মৃত্যুদÐ বা যাবজ্জীবন কারাদÐ বা কমপক্ষে সাত বছরের সশ্রম কারাদÐ এবং কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা অর্থদÐ। ৮ধারা অনুসারে, অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা, ষড়যন্ত্র বা চেষ্টা চালানোর দÐ হিসেবে অনধিক সাত বছর এবং কমপক্ষে তিনবছর সশ্রম কারাদÐ ও কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা অর্থদÐ রাখা হয়েছে।মানবপাচার আইন ২০১২-এর ৯ ধারা অনুসারে, জবরদস্তি বা দাসত্বমূলক শ্রম বা সেবা প্রদান করতে বাধ্য করার দÐ অনধিক ১২ বছর এবং কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদÐ এবং কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদÐ রাখা হয়েছে।
এই আইনের ১০ ধারা অনুসারে, মানবপাচার অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্যে অপহরণ, চুরি ও আটক করার দÐ এবং মানবপাচারের অপরাধ সংঘটনের অভিপ্রায়ে বা যৌন শোষণ ও নিপীড়নের শাস্তি অনধিক ১০ বছর এবং কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদÐ ও কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা অর্থদÐ রাখা হয়েছে। নবজাতক শিশু অপহরণ বা চুরির দÐ অনধিক যাবজ্জীবন কারাদÐ এবং কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদÐ ও কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদÐ রাখা হয়েছে।এ আইনের ১১ ধারা অনুসারে, পতিতাবৃত্তি বা অন্য কোনো ধরনের যৌন শোষণ বা নিপীড়নের জন্য আমদানি বা স্থানান্তরের দÐ অনধিক সাত বছর এবং কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদÐ ও কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদÐ রাখা হয়েছে। দÐবিধি ১৮৬০ ধারা ৩৬৩ অনুযায়ী কোন ব্যক্তি যদি কাউকে বাংলাদেশ হতে অপহরণ করে নিয়ে যায়, তবে সে ব্যক্তি সাত বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের বিনাশ্রম কারাদÐে দÐিত হবে এবং অর্থ দÐেও দÐিত হবে।৩৬৪ মতে কোন ব্যক্তি যদি কাউকে খুন করার জন্য অপহরণ করে তবে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদÐে, অথবা দশ বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদÐে দÐিত হবে এবং অর্থ দÐেও দÐিত হবে।ধারা ৩৬৪ ক মতে কোন ব্যক্তি যদি দশ বৎসরের নিম্ন বয়স্ক কোন ব্যক্তিকে অপহরণ করে উক্ত ব্যক্তিকে খুন করা অথবা গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার বা দাসত্ব বা কোন ব্যক্তির কাম লালসার বশীভূত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তবে সে মৃত্যুদÐে বা যাবজ্জীবন কারাদÐে, বা চৌদ্দ বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদÐে, যা সাত বৎসরের কম হবে না, দÐিত হবে এবং অর্থ দÐেও দÐিত হবে।আইন বিশেষজ্ঞর মতে মানব পাচাররোধে মানবপাচার আইন ২০১২-এর সঠিক প্রয়োগ এবং সরকারিভাবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে মানবপাচারের সংখ্যা কমে আসতে পারে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে পাচার সংক্রান্ত মামলাগুলো পৃথকভাবে পরিচালনার জন্য পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা বলা হলেও আইন প্রণয়নের অর্ধযুগ পর এখন পর্যন্ত কোন ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়নি। প্রত্যেক জেলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মানব পাচার সংক্রান্ত মামলার বিচার পরিচালিত হচ্ছে। এ সকল ট্রাইব্যুনালে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলার এত চাপ যে মানব পাচার মামলার বিচার দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
লেখক : শিক্ষার্থী
আইন বিভাগ, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম