কক্সবাজার ছাত্রলীগের সম্মেলন ঘিরে সংঘাতের আশঙ্কা

118

সম্মেলন ঘিরে সংঘাতের দিকে এগোচ্ছে কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের রাজনীতি। পদ প্রত্যাশীদের মধ্যে শুরু হয়েছে শক্তি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা। নিজেদের প্রভাব জাহির করতে প্রতিনিয়ত গ্রুপ ভারী করে শক্তির জানান দিচ্ছেন সভাপতি-সম্পাদক পদ প্রত্যাশী নেতা ও তাদের অনুসারীরা। এছাড়া হুমকি-পাল্টা হুমকি দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। আর তা চলছে ফেসবুকের বিভিন্ন ফেক আইডির মাধ্যমে। এছাড়া অনেকে সম্মেলনের দিন একে অপরকে কীভাবে ‘সাইজ’ করবেন সে পরিকল্পনাও করছেন বলে জানা গেছে।
এ নিয়ে রীতিমত উদ্বিগ্ন জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে সাবেক ছাত্রনেতারা। তারা বলছেন, নেতৃত্বে প্রতিযোগিতা থাকবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তা যদি প্রতিহিংসায় রূপ নেয়, তা খুবই দুঃখজনক। যেকোন বিশৃঙ্খলা এড়াতে পদ প্রত্যাশীদের সংযমী হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, আগামী ২০ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় কমিটি। প্রায় পাঁচ বছর পর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। তারিখ ঘোষণার পর থেকে পদ প্রত্যাশীরা দৌড়ঝাঁপ করছেন। প্রতিদিনই প্রার্থীদের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। তালিকায় অতীতে ছাত্রলীগ করেনি এমন প্রার্থী যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে মাদকসেবী, অছাত্র, বিতর্কিত ও চাঁদাবাজে জড়িত অনেকে। এর বাইরে রয়েছে গোষ্ঠী ও পরিবারকেন্দ্রিক প্রার্থী। তাদের ভিড়ে কোনঠাসা হচ্ছে ত্যাগী ও পরিশ্রমী নেতাকর্মীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্মেলনে সভাপতি ও সাধারণ স¤পাদক পদের জন্য দেড় ডজন ছাত্রনেতা দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছেন। এদের মধ্যে কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজাওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন, সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী, সাবেক ছাত্রনেতা প্রশন্ত ভূষণ বড়য়া এবং বর্তমান জেলা সভাপতি ইতিয়াক আহম্মেদ জয় ও সাধারণ সম্পাদক মোর্শেদ হোসেন তানিমের অনুসারীরাও রয়েছেন।
শোভনের অনুসারীদের মধ্যে আলোচনায় রয়েছেন বর্তমান জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন, উপ-দপ্তর সম্পাদক মঈন উদ্দিন, এসএম সাদ্দাম হোসেন, সরওয়ার আজম ও নারিমা জাহান।
সাখাওয়াত হোসেন জেলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি এডভোকেট একে আহম্মদ হোসাইনের পুত্র। এছাড়া সাখাওয়াত হোসাইন ও এসএম সাদ্দাম হোসেন সাবেক ছাত্রনেতা প্রশন্ত ভূষণ বড়ুয়ার আর্শিবাদপুষ্ট হিসাবেও পরিচিত। সরওয়ার আজম চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন ‘গ্রুপের’ লোক হিসাবে পরিচিত।
গোলাম রব্বানীর অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে জেলা ছাত্রলীগের বর্তমান আপ্যায়ন সম্পাদক কায়সার চৌধুরী রুবেল, শিক্ষা ও পাঠচক্র উপ-সম্পাদক মারুফ আদনান ও এহেছানুল হক মিলন। রুবেল জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক পরিবারের বলে পরিচিত, সাবেক জেলা সভাপতি একেএম মোজাম্মেল হক পরিবারের ঘনিষ্ট আত্মীয়। মারুফ আদনান জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হক মুকুলের পুত্র। এর বাইরে বর্তমান সভাপতি ইসতিয়াক আহম্মদ জয়ের অনুসারীরাও বসে নেই। ইসতিয়াক আহম্মদ জয় যার জন্য মুখ খুলবেন তাকেও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
আপাতত জেলা সভাপতির অনুসারীদের মধে মাঠে রয়েছেন মারুফ ইবনে হোসেন, ইব্রাহিম আযাদ বাবু, নাজমুল হোসেন শাকিল ও সাখাওয়াত হোসেন তুর্য।
অপরদিকে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মোর্শেদ হোসেন তানিম নিজে সভাপতি প্রার্থী বলে জানান। তবে তানিম কেমন কৌশলে আগাচ্ছেন, তা পরিষ্কার নয়। কোন কারণে তানিমের প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিলে বিকল্প প্রার্থীও রয়েছে। সেক্ষেত্রে জেলা ছাত্রলীগ নেতা ও আপন সহোদর সাজ্জাদ হোসেন শুভ কিংবা শহর ছাত্রলীগ সভাপতি হাসান ইকবাল রিপন হবেন তার প্রার্থী।
এছাড়া দপ্তর সম্পাদক শাহ নিয়াজ, প্রচার স¤পাদক আলিফ উজ্জামান শুভ, যুগ্ম সাধারণ স¤পাদক বোরহান উদ্দিন খোকন, সাবেক জেলা সভাপতি আলী আহম্মদের ছোট ভাই আনোয়ার হোসেনও প্রার্থী হিসাবে প্রচারণা চালাচ্ছেন। জেলায় প্রচারণার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় পর্যায়ে জোর লবিং চালাচ্ছেন সভাপতি ও সাধারণ পদ প্রত্যাশীরা।
কেন্দ্রীয় নেতাদের আর্শিবাদ পেতে ঢাকা-কক্সবাজার যাতায়াতে ব্যস্ত রয়েছেন অধিকাংশ প্রার্থী। সাবেক ছাত্র নেতাদের কাছেও ধর্ণা দিচ্ছেন অনেকে। আবার অনেক প্রার্থী ধর্ণা দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কাছে। যাদের ঢাকায় গিয়ে লবিং করার সামর্থ্য নেই, তারা তৃণমূল নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রাখছেন এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।
তৃণমূলের নেতাকর্মীরা জানান, অবৈধ টাকার মালিক, অছাত্র, মাদকাসক্ত ও মাস্তান টাইপের কেউ যেন নেতৃত্বে না আসে। জেলা ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে স¤পৃক্ত পরিচ্ছন্ন, ত্যাগী, পরিশ্রমী ও যোগ্য অনেক নেতা রয়েছে দাবি করে তারা বলেন, গোপন ব্যালটে ভোট হলে তারা যোগ্য নেতৃত্ব বাছাই করার সুযোগ পাবেন।
তবে সবকিছুকে ছাড়িয়ে এখন চলছে এক প্রার্থীর বিরুদ্ধে অপর প্রার্থীর কুৎসা রটনা, অপপ্রচার ও চরিত্রহননের প্রতিযোগিতা। এতে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা রূপ নিয়েছে প্রতিহিংসায়। এ অবস্থা চলমান থাকলে সম্মেলনের দিন সংঘাত, সংঘর্ষ ও রক্তপাতের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা অনেকের।
এ ব্যাপারে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ স¤পাদক মোর্শেদ হোসেন তানিম বলেন, সম্মেলন করার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নিদের্শনা পেয়েছি। নির্ধারিত তারিখে সম্মেলন করার জন্য কাজ করছে জেলা ছাত্রলীগ। শোকের মাস শেষ হলে পুরোদমে সম্মেলন অনুষ্ঠানের কাজ শুরু হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত, মাদকাসক্ত, অছাত্র ও অর্ধশিক্ষিত, বয়স্কদের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ কোন প্রকার ছাড় দেবে না।
জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইসতিয়াক আহম্মদ জয় বলেন, শতভাগ গঠনতন্ত্র মেনে শিক্ষা, বয়স ও চরিত্র মূল্যায়ন করেই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনয়ন দেওয়া হবে। বিএনপি-জামায়াতপুষ্ট এবং গোষ্ঠীগত কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হবে না। কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশনা মোতাবেক আগামী ২০ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার ছাত্রলীগের সম্মেলন ও কাউন্সিল উপহার দিতে জেলা ছাত্রলীগ প্রস্তুত।
জেলা ছাত্রলীগের সর্বশেষ দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর। তবে কমিটি ঘোষিত হয় ২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারি। এতে ইশতিয়াক আহমেদ জয়কে সভাপতি এবং ইমরুল রাশেদকে সাধারণ স¤পাদক করা হয়। পরবর্তীতে ইমরুল রাশেদ ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে সাধারণ সম্পাদক পদ ছেড়ে দেন। সেই থেকে মোর্শেদ হোসেন তানিম ভারপ্রাপ্ত সাধারণ স¤পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারি গঠনতন্ত্র মোতাবেক বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। পরে কয়েকদফা সম্মেলনের তারিখ দেয়া হলেও রোহিঙ্গা সংকট এবং জাতীয় নির্বাচনসহ নানা কারণে সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি। সবশেষ কেন্দ্রীয় কমিটি জেলা কমিটির সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠানের জন্য ৬০ কার্যদিবস নির্ধারণ করে দিয়ে নির্দেশনা দিয়েছিল। সে সময়ও পার হয়ে গেলে গত ৩০ জুলাই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের এক সভায় আগামী ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠানের জন্য কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়।