কোথায় গেল কালবৈশাখী

15

তুষার দেব

বর্ষপঞ্জির পাতায় বৈশাখের অর্ধেকটা সময় পেরিয়ে যেতে চলেছে। আবহাওয়ার চিরায়ত গতিপ্রকৃতিতে এরইমধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কালবৈশাখীর দাপট চলার কথা থাকলেও এবার ভিন্নচিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। যেন কালবৈশাখী ঝড় উধাও হয়ে গেছে এবারের বৈশাখ মাসে। কোথায় গেল কালবৈশাখী? চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত দেশের দক্ষিণাঞ্চলে একটিমাত্র ঝড়ের দেখা মিলেছে। আবহাওয়াবিদরা ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে সেটাকেও ‘অস্বাভাবিক’ হিসেবে দেখছেন।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এমনিতে এপ্রিল হচ্ছে দেশের উষ্ণতম মাস। এ মাসে স্বাভাবিকভাবেই কখনও কখনও দাবদাহ চলে। এক পর্যায়ে বজ্রঝড় হয়ে সেই দাবদাহ প্রশমিত হয়। আবার যখন আবহাওয়া গরমে চরম আকার ধারণ করে তখন বৃষ্টি বা বজ্রঝড়ের মাধ্যমে তা প্রশমিত হয়। তবে গত কয়েক বছর ধরে প্রকৃতির এই স্বাভাবিক আচরণ বদলে গেছে। কমছে কালবৈশাখী, বাড়ছে টানা তাপপ্রবাহ। নামে বৈশাখ যুক্ত থাকলেও শীতের বিদায়ের পর ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, সমগ্র পূর্ব এবং উত্তরপূর্ব ভারতে যে ঝড় বয়ে যায় তাই কালবৈশাখী। বাংলা বর্ষের শুরুতে মানে বৈশাখ মাসে এ ঝড় তুলনামূলকভাবে বেশি হয় বলেই এ ঝড় কালবৈশাখী নামে পরিচিত লাভ করেছে। কালবৈশাখীর আসল নাম ‘নর-ওয়েস্টার’। অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে এই ঝড় ধেয়ে আসে বলে একে বলে ‘নর-ওয়েস্টার’। তাই বলে কালবৈশাখী শুধুমাত্র বৈশাখ মাসেই (মানে ১৫ এপ্রিল থেকে ১৫ মে পর্যন্ত) দেখা যাবে- এমনটি নয়। কালবৈশাখী এবং সাধারণ ঝড়ের মধ্যে পার্থক্য বিচার করার কিছু মাপকাঠি রয়েছে। মোটা দাগে বলা যায়, ঝড়ের গতিবেগ ঘণ্টার ৫০ কিলোমিটারের বেশি এবং স্থায়িত্ব অন্তত একমিনিট হলে সেটাই কালবৈশাখী ঝড়।
অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, বৈশাখ মাস শুরুই হয় সাধারণত কালবৈশাখী বা বজ্রঝড় দিয়ে। গত ১৪ এপ্রিল ছিল বৈশাখের প্রথমদিন। গতকাল শনিবার বৈশাখ মাসের ১৪তম দিন পার হয়েছে। গত ১৪ দিনে দেশে মাত্র একটি কালবৈশাখী হয়েছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে। তবে সে ঝড়ের সঙ্গে কালবৈশাখীর অনেক ফারাক ছিল। মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত যেসব বজ্রঝড় হয় সেগুলো কালবৈশাখী। উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আসা বায়ুর কারণে এই ঝড়বৃষ্টি হয়। এর মধ্যে গত ১৮ এপ্রিল ভোরে জেলার মিরসরাইয়ে এক ঘণ্টার শিলাবৃষ্টিতে ক্ষেতের ফসল ও ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ভোর পাঁচটা থেকে ঘণ্টাখানেক ধরে পড়া শিলাবৃষ্টিতে ঝরে পড়েছে অনেক গাছের আম। ক্ষতি হয়েছে বোরো ধান, মিষ্টিকুমড়া, টমেটোসহ বিভিন্ন ফসলের। ঘরের চালের টিন ফুটো হয়ে গেছে অনেক বাড়িতে। ভোরে থেমে থেমে বড় আকৃতির শিলা ঝরেছে। এসব শিলার কোনো কোনোটির ওজন দুইশ’ থেকে আড়াইশ’ গ্রাম পর্যন্ত। শিলার আঘাতে বসতঘরের চালা ফুটো হয়ে গেছে অনেক পরিবারের।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক ১৯৮১ সাল থেকে চলতি ২০২৪ সাল পর্যন্ত চার দশকের বেশি সময়ের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে পূর্বদেশকে বলেন, গত ৪৩ বছরে এপ্রিল মাসে বড় আকারের বজ্রঝড় হয়েছে তিনশ’ ৬৫টি। সবচেয়ে বেশি হয়েছিল ১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসে, ১৪টি। ১৯৯৯ ও ২০০৯ সালে এপ্রিলে ঝড় হয়েছে চারটি করে। ২০২১ সালে আটটি, পরের বছর নয়টি আর গেল বছরের এপ্রিলে হয়েছে সাতটি। চলতি বছরে সেই সংখ্যা মাত্র একটি। গত ৭ এপ্রিল দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাটের বিভিন্ন স্থানে যে কালবৈশাখী বয়ে যায় তাতে বজ্রপাত ঘটে। এতে বাগেরহাটে একজনের মৃত্যুও হয়। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে দক্ষিণ জনপদের মানুষের কাছে এই কালবৈশাখী ঝড় একেবারেই অস্বাভাবিক ছিল। সেদিক থেকে কালবৈশাখী ঝড়ের আচরণ বদলে গেছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ১৯৪৮ সালের পর থেকে তথ্য উপাত্ত ঘেঁটে নিশ্চিত হয়েছেন, এবারের মতো টানা তাপপ্রবাহ আগে আর কখনও দেখা যায়নি। অন্যদিকে এই সময়ের মধ্যে দেখা মেলেনি কাঙ্খিত কালবৈশাখীর। চলতি এপ্রিল মাসে ৭৬ বছরের রেকর্ড ভেঙে টানা ২৭ দিন ধরে তাপপ্রবাহ চলছে। যা শুরু হয়েছে এপ্রিলের প্রথম দিন থেকে। যা এখনও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অব্যাহত রয়েছে। চলবে আরও কয়েকদিন। এপ্রিলে কালবৈশাখী কমে যাওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞরা দায়ি করছেন অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহকে। টানা ও অতিরিক্ত তাপপ্রবাহের কারণে জলীয় বাষ্পের সঙ্গে আর্দ্রতার মেলবন্ধন ঘটছে না। ফলে বজ্রঝড় ঘটানোর জন্য প্রয়োজনীয় বজ্রমেঘের জোগান হচ্ছে না। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে যে মাত্রাতিরিক্ত তাপপ্রবাহ তার কারণেই প্রকৃতির অস্বাভাবিক আচরণ বাড়ছে।