৫ বছর মেয়াদ শেষ করতে পারেননি পাকিস্তানের কোন প্রধানমন্ত্রী

13

পূর্বদেশ ডেস্ক

সেই লিয়াকত আলী খান থেকে শুরু করে আজকের ইমরান খান, পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রীই এখন পর্যন্ত নিজের ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। বিশ্বের আর কোনো দেশের এই রেকর্ড নেই।
নামকরা ক্রিকেটার থেকে রাজনীতির মাঠের পাকা খেলোয়াড় বনে যাওয়া ইমরান খান ছিলেন পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী। যদি তার বিরুদ্ধে উঠা অনাস্থা প্রস্তাব পার্লামেন্টে বাতিল না হতো এবং যদি ভোটে তিনি হেরে যেতেন তবে তিনিই হতেন অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতা হারানো পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু অসম্মানের এই রেকর্ড গড়া থেকে ইমরানকে বাঁচিয়ে দেন ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরি।
ইমরান খানের বিরুদ্ধে বিরোধীরা অনাস্থা ভোটের দাবি তুলেছিলেন। কিন্তু সেই অনাস্থা-প্রস্তাব বাতিল করেন ডেপুটি স্পিকার। এর পরেই প্রেসিডেন্টের কাছে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ভেঙে ভোট করানোর আহŸান জানা ইমরান। তাঁর প্রস্তাবমতো অ্যাসেম্বলি ভেঙে দিলেন প্রেসিডেন্ট। ফলে মেয়াদ শেষ করতে পারছেন না তিনিও।
পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে কোনো প্রধানমন্ত্রীই নিজেদের পাঁচ বছরের পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। কখনও খুন হয়ে, আবার কখনও বিরোধী দলের অনাস্থার মুখে পড়ে গদি ছাড়তে হয়েছে পাক প্রধানমন্ত্রীদের।
স্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন লিয়াকত আলী খান। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট অর্থাৎ পাকিস্তানের স্বাধীনতার দিন তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার নেন। কিন্তু ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর এক জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান তিনি। মোট চার বছর ৬৩ দিন তিনি ক্ষমতায় ছিলেন।লিয়াকতের পর পাক মসনদে বসেন খওয়াজা নাজিমুদ্দিন। তিনি ১৯৫১ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে ১৯৫৩ সালের ১৭ আগস্ট পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর পদে বহাল ছিলেন। তাঁর সময়কালে বাংলা ভাষা আন্দোলন নিয়ে লাহৌরে একাধিক সহিংস ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ হওয়ার কারণ দেখিয়ে তাঁকে গদি ছাড়ার নির্দেশ দেন পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল মালিক গোলাম। কিন্তু তিনি এই নির্দেশ না মানায় নিজের বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহার করে নাজিমুদ্দিনকে ক্ষমতাচ্যূত করেন মালিক। নাজিমুদ্দিন মোট এক বছর ১৮২ দিন ক্ষমতায় ছিলেন।
এর পর প্রধানমন্ত্রী হন মহম্মদ আলী বোগরা। তিনি ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে মোট দু’বছর ১১৭ দিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ শাসন করেন। নিয়োগের পরপরই, আঞ্চলিক বৈষম্য নিয়ে তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল ইসকান্দার মির্জার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বোগরার সমস্যা শুরু হয়। এর পরই বোগরাকে একপ্রকার ইস্তফা দিতে বাধ্য করেন ইসকান্দার।
পাকিস্তানের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হন চৌধুরী মহম্মদ আলী। ১৯৫৫ সাল থেকে শুরু করে মোট এক বছরের কিছু বেশি সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বহাল ছিলেন তিনি। দলবিরোধী কাজকর্মের জন্য তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরানো হয়।
পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হন হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর। তিনি ১৯৫৬ থেকে শুরু করে এক বছর ৩৫ দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে গভর্নর জেনারেল ইসকান্দারের চাপের মুখে পড়ে সোহ্রাওয়ার্দীও গদি ছাড়তে বাধ্য হন।
পাকিস্তানের ষষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হন ইব্রাহিম ইসমাইল চুন্দিরগার। মাত্র দু’মাস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার কথা বলার পর তাঁকেও অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে সরানো হয়।
এর পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানের দায়িত্ব সামলানোর ভার নেন ফিরোজ খান নুন। তাঁর শাসনকাল ছিল ২৯৫ দিন। খুব কম সময়ে ফিরোজের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে পৌঁছায়। কিন্তু তাঁকেও গদিচ্যূত করা হয়।
পাকিস্তানের অষ্টম প্রধানমন্ত্রী হন নুরুল আমিন। তিনিই পাকিস্তানের ইতিহাসে সব থেকে স্বল্পমেয়াদী প্রধানমন্ত্রী। মাত্র ১৩ দিনের জন্য ক্ষমতায় ছিলেন। তবে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি আয়ুব খানের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় তিনি নিজের পদ ছাড়েন। তিনিই পাকিস্তানের প্রথম এবং শেষ ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি পাকিস্তানের শেষ বাঙালি নেতা হিসেবেও পরিচিত।
নুরুল আমিনের পর ক্ষমতায় আসেন পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। ১৯৭৩ সাল থেকে শুরু করে তিনি তিন বছর ৩২৫ দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৭ সালের ৫ জুলাই জেনারেল মহম্মদ জিয়া-উল-হকের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী ভুট্টোকে ক্ষমতাচ‚্যত করে। তাঁকে এক মাসের জন্য আটকও করা হয়।
ভুট্টোকে সরিয়ে ক্ষমতায় আনা হয় মহম্মদ খান জুনেজোকে। তিনি তিন বছরের কিছু বেশি সময় দায়িত্বে ছিলেন। তবে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অযোগ্য এবং পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার জন্য দায়ী করে পদ থেকে সরান রাষ্ট্রপতি পদে বসে থাকা জিয়া।
পাকিস্তানের একাদশ এবং প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন জুলফিকারের মেয়ে বেনজির ভুট্টো। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রায় দু’বছর ক্ষমতায় ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি দাবি করেন, রাষ্ট্রপতি গোলাম ইসহাক খান এবং শক্তিশালী সামরিক বাহিনী-সহ রক্ষণশীল ও ইসলামপন্থী শক্তি তাঁর নতুন চিন্তাভাবনার প্রচেষ্টা রোধ করছে। বেনজিরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের অভিযোগ এনে ১৯৯০ সালে ইসহাক তাঁকে বরখাস্ত করেন।
১৯৯০ সালে দ্বাদশ পাক প্রধানমন্ত্রী হন নওয়াজ শরিফ। ১৯৯৩ সালে রাষ্ট্রপতি ইসহাক পাক সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর তিনি গদিচ‚্যত হন এবং বিরোধী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
ত্রয়োদশ এবং চর্তুদশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবারও পাকিস্তান শাসনের ভার পান বেনজির এবং নওয়াজ। ১৯৯৬ সাল থেকে বেনজির ৩ বছর ১৭ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বারেও তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, হত্যার চক্রান্ত-সহ একাধিক অভিযোগ আনা হয়। রাষ্ট্রপতি ফারুক লেগহারি তাঁর সরকার ভেঙে দেন। নওয়াজের দ্বিতীয় বারের শাসনকাল চলে দু’বছর ২৩৭ দিন। এর পর ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানের ফলে তার শাসনকালের অবসান ঘটে।
বেনজির এবং নওয়াজের পতনের পরে ক্ষমতায় আসেন মির জাফারুল্লাহ খান জামিলি। তবে প্রায় দু’বছরের শাসনকালের পর হঠাৎই নিজের পদ থেকে ইস্তফা দেন তিনি। ইস্তফা দেওয়ার আগে জামিলি প্রায় ৩ ঘণ্টা তৎকালীন সেনাপ্রধান পারভেজ মোশারফের সঙ্গে বৈঠক করেন। তবে পাকিস্তানের বিভিন্ন বিষয়ে মোশারফের মতের সঙ্গে জামিলির মতের মিল না হওয়ায় তাঁকে পদত্যাগের জন্য বাধ্য করা হয় বলেও সংবাদ মাধ্যমগুলি দাবি করে।
ষষ্ঠদশ পাক প্রধানমন্ত্রী হন চৌধুরী সুজাত হোসেন। তাঁর শাসনের সময়কাল ছিল মাত্র ৫৭ দিন। এর পর তিনি নিজেই শওকত আজিজকে নিজের পদ ছেড়ে দেন।
এর পর প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হন শওকত আজিজ। মোশারফের ডান হাত হিসেবে পরিচিত ছিলেন শওকত। তিনি তিন বছর ক্ষমতায় থাকার পর নিজে থেকেই সরে যান। তবে শওকতের আমলে পাকিস্তানের অর্থনীতির ব্যাপক উন্নতি হয় বলে মনে করা হয়।
শওকতের পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন ইউসুফ রাজা গিলানি। ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি মোট চার বছর ৮৬ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রধানমন্ত্রী পদে গিলানিই সব থেকে বেশি দিন বহাল ছিলেন। তবে একাধিক দুর্নীতির মামলায় যুক্ত থাকার অভিযোগে পাক সুপ্রিম কোর্ট তাঁর প্রধানমন্ত্রী পদ খারিজ করে।
পাকিস্তানের উনিশতম প্রধানমন্ত্রী হন রাজা পারভেজ আশরফ। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর শাসনের সময়কালও এক বছর পার করেননি। আশরফ মোট ২৭৫ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। তবে ২০১৩ সালে ২৪ মার্চ তিনি তাঁর পদ ছাড়েন। তাঁকেও একাধিক দুর্নীতির মামলায় যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয় পাক সুপ্রিম কোর্ট।
এর পর ২০১৩ সালে ফের ক্ষমতায় ফেরেন আগে দু’বার প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসা নওয়াজ। তবে তৃতীয় বারে চার বছরের ৫৩ দিনের জন্য ক্ষমতায় ফেরেন তিনি। ২০১৭ সালে পানামা পেপার দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাঁকে ক্ষমতাচ্যূত করে সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্ট ২০১৮ সালে তাঁকে ১০ বছরের জন্য কারাবাসে পাঠানোরও নির্দেশ দেয়।
নওয়াজের পর ৩০৩ দিনের জন্য একুশতম পাক প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন শাহিদ খকন আব্বাসি। তবে ২০১৮ সালে নির্বাচনের মুখে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদ ছাড়তে হয়।
২০১৮ সালের নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসেন ইমরান খান। নির্বাচনে তাঁর জোট সঙ্গী ছিল মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট পাকিস্তান (এমকিউএম)। পাকিস্তানের ধারা বজায় রেখে ইমরানও মেয়াদ শেষ করতে পারলেন না। সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা।