২৪ ঘণ্টার প্রতিযোগিতায় কতটা সক্ষম বিটিভি চট্টগ্রাম

60

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তীতে এসে বিটিভির চট্টগ্রাম কেন্দ্র আনুষ্ঠানিকভাবে ২৪ ঘণ্টা স্যাটেলাইট ও টেরিস্ট্রিয়াল সম্প্রচারে যাত্রা শুরু করেছে। পঁচিশ বছর আগে মাত্র দেড় ঘণ্টা সম্প্রচার থেকে ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২৪ ঘণ্টায় উন্নীত হলেও বিটিভির চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার মান নিয়ে চট্টগ্রামের শিল্পী-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবী এবং সাধারণ দর্শকদের মনে প্রশ্নের ঘোর কাটেনি। তারা বলছেন, সম্প্রচার সময় তো বেড়েছে। কিন্তু সম্প্রচারিতব্য অনুষ্ঠানমালার মান বাড়বে তো?
২৪ ঘণ্টা সম্প্রচারের যাত্রা শুরুর প্রাক্কালে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে চট্টগ্রামের একুশে পদকপ্রাপ্ত নাট্যজন ও টিআইসির পরিচালক আহমেদ ইকবাল হায়দার গতকাল রবিবার সন্ধ্যায় পূর্বদেশকে বলেন, যাত্রা শুরুর প্রথম দিকে, মানে প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে বিটিভির চট্টগ্রাম কেন্দ্র চলেছে অনেকটাই দায়সারাভাবে। ক্রমান্বয়ে যখন ১৮ ঘণ্টার সম্প্রচারে উন্নীত হল, তখন অবশ্য লজিস্টিক সাপোর্টসহ অনুষ্ঠানের মানও বেড়েছে বটে। তবে তা প্রত্যাশার শতভাগ পূরণ করার মত হয়নি। কারণ অন্যান্য প্রতিযোগী টিভি চ্যানেলের মত প্রযোজক ও অনুষ্ঠান নির্মাতাসহ পর্যাপ্ত জনবলের অভাব ছিল। এখন আমি যতটুকু জেনেছি, ২৪ ঘণ্টার সম্প্রচারে যাওয়ার পর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে তাদেরকে যথাযথ মানসম্পন্ন অনুষ্ঠানমালা নির্মাণ ও সম্প্রচার করতেই হবে। আশা করি, সে পথেই তারা হাঁটার চেষ্টা করবে। যদিও আমি এ বিষয়ে একেবারে শঙ্কামুক্ত নই।
একই বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বেতার ও টেলিভিশন শিল্পী কল্যাণ সংস্থার সাধারণ সম্পাদক কণ্ঠশিল্পী আলাউদ্দিন তাহের পূর্বদেশকে বলেন, প্রতিষ্ঠার ২৫ বছরে এসে বিটিভির চট্টগ্রাম কেন্দ্র ২৪ ঘণ্টা সম্প্রচারের পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আমি প্রথমে প্রধানমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। শুরু থেকেই চট্টগ্রামের শিল্পী ও সংস্কৃতিসেবীরা বিটিভির চট্টগ্রাম কেন্দ্রের জন্য আন্তরিক ছিল। এরপরও টিভি স্টেশনটি এতদিন ধরে যে ধরনের অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করে এসেছে, তা মানের দিক থেকে এতদঞ্চলের সংস্কৃতিসেবী ও দর্শকদের প্রত্যাশার জায়গা পূরণ করতে পারেনি। এমনকি আমি নিজেই এ কেন্দ্র থেকে একই অনুষ্ঠান কমপক্ষে ২০ থেকে ৩০ বার পুনঃপ্রচার করতে দেখেছি। সক্ষমতা থাকার পরও অনুষ্ঠানমালার মান প্রত্যাশিত পর্যায়ে উন্নীত করতে না পারার পেছনে প্রধান কারণ হল, যাকে দিয়ে যে ধরনের অনুষ্ঠান নির্মাণ ও সম্প্রচার করতে হয়, তাকে সেই দায়িত্ব না দেয়া। বর্তমানে বেতারের লোকজন দিয়ে টিভি কেন্দ্র পরিচালনা করা হচ্ছে। তার মানে, কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার ঘাটতি এখানে বিদ্যমান রয়েছে। তারপরও আমরা আশায় বুক বেঁধে আগামীর পানে তাকাতে চাই। বাকিটা সময়ই বলবে।
বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, ২৫ বছর আগে ১৯৯৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর মাত্র দেড় ঘণ্টার সম্প্রচার সময় নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল এই কেন্দ্র। রজতজয়ন্তীতে এসে একই তারিখ বেছে নেয়া হয় ২৪ ঘণ্টার পূর্ণাঙ্গ সম্প্রচার শুরুর জন্য। যাত্রা শুরুর ২০ বছর পর ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর সম্প্রচার সময়সীমা বাড়িয়ে ছয় ঘণ্টায় উন্নীত করা হয়।
এরপর ২০১৯ সালের ১৩ এপ্রিল শুরু হয় নয় ঘণ্টার সম্প্রচার। পরের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি সম্প্রচার সময় বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টা করা হয়। আর চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারিতে তা উন্নীত করা হয় ১৮ ঘণ্টায়। যাত্রা শুরুর পর বর্তমান পর্যায়ে আসতে বিটিভির চট্টগ্রাম কেন্দ্রকে অনেক প্রতিক‚লতা ও সঙ্কট অতিক্রম করতে হয়েছে।
পর্বতদূহিতা ও গিরিকুন্তলা বীর প্রসবিনী চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষের কথা এবং এতদঞ্চলের শিল্প ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরার লক্ষ্যেই কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শাহ আমানত সেতু উদ্বোধন করতে এসে এটিকে পূর্ণাঙ্গ টিভি কেন্দ্রে রূপ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ২৪ ঘণ্টা সম্প্রচারের আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে সরকার চট্টগ্রামের গণমাধ্যমকর্মী, শিল্পী ও সংস্কৃতিসেবীসহ সাধারণ দর্শকদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ করেছে।
টিভি কেন্দ্রের কলাকুশলীরা জানান, বিটিভির চট্টগ্রাম কেন্দ্র এখন প্রযুক্তি ও কারিগরি সুযোগ-সুবিধার দিক দিয়েও অত্যাধুনিক এবং সক্ষমতা অর্জন করেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সম্পন্ন হয়েছে চারশ’ ৩৮ ফুট উচ্চতার টাওয়ার স্থাপনের কাজ। যাতে ব্যয় হয় প্রায় ৩০ কোটি টাকা। এই টাওয়ার ব্যবহার করে ১২টি ক্যাবল চ্যানেল এবং দুটি টেরিস্ট্রিয়াল চ্যানেল সম্প্রচার করা সম্ভব। টাওয়ারের পাশেই নির্মাণ করা হয়েছে উন্নত ট্রান্সমিশন ব্যবস্থা। গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর এই ট্রান্সমিশন ব্যবস্থার মাধ্যমেই সম্প্রচারিত হচ্ছে বিটিভি, বিটিভি ওয়ার্ল্ড, সংসদ টিভি এবং চট্টগ্রাম কেন্দ্রের স¤প্রচার। শুরুতে চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানমালা সারাদেশের দর্শকদের দেখার সুযোগ না থাকলেও বর্তমানে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ব্যবহার করেই তা দেশজুড়ে সম্প্রচারিত হচ্ছে।
চট্টগ্রামের শিল্পী-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীরা বলছেন, জাতীয় সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বারখ্যাত চট্টগ্রামের রয়েছে ভাষা ও সংস্কৃতির বহুমাত্রিক বৈচিত্র্য। বিটিভির এই কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নিজেও এতদঞ্চলের আঞ্চলিক গান, সাংস্কৃতিক নানা ঐতিহ্য এবং পার্বত্য অঞ্চলের সংস্কৃতির উপস্থাপন দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। ২৪ ঘণ্টা সম্প্রচার শুরু হলে বিটিভির চট্টগ্রাম কেন্দ্র বৃহত্তর চট্টগ্রামের সংস্কৃতির পাশাপাশি কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়িসহ বিশাল এলাকার দর্শনীয় ও আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রগুলোকেও দেশে-বিদেশের দর্শক এবং ভ্রমণপিয়াসীদের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হবে। একই সাথে তা চট্টগ্রাম অঞ্চলের শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রেও নতুন মাত্রা যোগ করবে।