হাজার টাকায় কিনে লাখ টাকায় বিক্রি

41

তুষার দেব

ভিন্ন জেলা থেকে চুরি করে আনার পরপরই প্রথম ধাপে ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকায় একেকটি সিএনজিচালিত ট্যাক্সি কিনে নিয়ে রাখা হয় নগরীর নির্দিষ্ট কয়েকটি গ্যারেজে। এরপর সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যদের কেউ বিআরটিএ’র দালালের মাধ্যমে সংগ্রহ করেন পুড়ে কিংবা নষ্ট হয়ে যাওয়া সিএনজি ট্যাক্সির ভুয়া কাগজপত্র। গ্যারেজের ভেতরেই হাজার টাকায় কেনা চোরাই ট্যাক্সির ইঞ্জিন- চেসিস নম্বর টেম্পারিং করে পাল্টে দেয়া হয়। ভুয়া কাগজপত্র ও নম্বরপ্লেটের সাথে মিলিয়ে বসানো হয় নকল ইঞ্জিন-চেসিস নম্বর। এরপর কৌশলে কাস্টমার বাছাই করে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয় প্রতিটি চোরাই সিএনজিচালিত ট্যাক্সি। প্রভাবশালী কারও সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েই এসব চোরাই ট্যাক্সি বৈধ বেশে সড়কে চলাচল করে।
নগর গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, বৈধ যানবাহনের সাথে কেবল নগরীতেই এ ধরনের পাঁচ হাজারেরও বেশি চোরাই সিএনজিচালিত ট্যাক্সি চলাচল করছে প্রতিদিন। তবে চোরাই ট্যাক্সিগুলো সড়কে নির্বিঘ্নে চলাচল করার জন্য সংঘবদ্ধ চক্রের ‘ছায়া’ লাগে। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তা, পরিবহন শ্রমিক নেতা নামধারী কিছু ব্যক্তি, কয়েকটি গ্যারেজের মালিক এবং বিআরটিএ’র একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীও পর্দার আড়ালে সম্পৃক্ত রয়েছেন সংঘবদ্ধ চক্রের সাথে। তারাই মিলেমিশে চোরাই সিএনজিচালিত ট্যাক্সিগুলো ভুয়া কাগজপত্র ও নম্বরপ্লেটে ‘হালাল’ তকমা দিয়ে বেচাকেনা থেকে শুরু করে সড়কে নির্বিঘেœ চলাচলের ব্যবস্থা করে থাকে। হাজার টাকায় কেনা চোরাই ট্যাক্সি ভুয়া কাগজপত্রে ‘অরিজিনাল’ তকমা দিয়ে লাখ টাকায় বিক্রির পর আবার পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তা এবং পরিবহন শ্রমিক নেতা নামধারী কিছু প্রভাবশালী লোকজনের সাথে অলিখিত চুক্তিবদ্ধ থেকে নির্বিঘ্নে সড়কে চলাচল করে।
সম্প্রতি নগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) পৃথক দু’টি অভিযানে ১৪টি চোরাই সিএনজিচালিত ট্যাক্সিসহ সংঘবদ্ধ চক্রের আট সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে গত ১৮ আগস্ট ডিবির উত্তর বিভাগের আওতাধীন ৩৪ নম্বর টিমের সদস্যরা নগরীর চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ, কোতোয়ালী থানাধীন বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১১টি চোরাই সিএনজিচালিত ট্যাক্সি, বিভিন্ন জাল কাগজপত্র, পাঁচটি নকল নম্বার প্লেট ও স্ট্যাম্পসহ চোর চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। এরা হলেন মো. সবুজ (২৯), সজীব সিকদার ওরফে সজীব বাবু (৫২), মোস্তফা রেজা ওরফে ইয়ার ওরফে পেয়ারু (২৭) এবং সাইফুল ইসলাম (৩০)। একসপ্তাহ পর গত ২৭ আগস্ট নগরীর চান্দগাঁও থানাধীন এফআইডিসি রোড এলাকায় পরিচালিত অভিযানে তিনটি চোরাই সিএনজিচালিত ট্যাক্সিসহ মো. রবিউল ইসলাম (৩১), মো. আব্দুল জলিল ওরফে জাবেদ (৩৩), মো. বাচ্চু মিয়া (৩৫) এবং মো. আলী হোসেনকে (৪১) গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রাথমিক তদন্ত ও আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য উদ্ধৃত করে সিএমপির গোয়েন্দা শাখার (পশ্চিম ও বন্দর) উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ আলী হোসেন পূর্বদেশকে বলেন, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী জেলায় সিএনজিচালিত ট্যাক্সি চুরির কয়েকটি দল সক্রিয় আছে। চোরচক্র ট্যাক্সি চুরি করে প্রথমে মালিকের কাছে টাকা দাবি করে। দাবিকৃত টাকা পেলে তারা ট্যাক্সি ফেরত দিয়ে দেয়। অন্যথায় সেগুলো ৫০/৬০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেয় কতিপয় গ্যারেজ মালিকের কাছে। এই চক্রের সাথে কিছু গ্যারেজ মালিক, মোটর পার্টস ব্যবসায়ী এবং বিআরটিএর দালালও জড়িত আছে। নির্ধারিত গ্যারেজে চোরাই ট্যাক্সি রেখে টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে ইঞ্জিন ও চেসিস নম্বর পরিবর্তন করে ফেলা হয়। এরপর অন্য কোনও ট্যাক্সির নকল ইঞ্জিন ও চেসিস নম্বর বসিয়ে ভুয়া রেজিস্ট্রেশন ও ডিজিটাল নম্বর প্লেটসহ বিভিন্ন কাগজপত্র তৈরি করে ‘আসল’ বলে সেগুলো কয়েক লাখ টাকায় বিক্রি করে দেয়া হয়।
পুলিশ জানায়, নগরীর বাদুরতলা, চান্দগাঁও, কালামিয়া বাজার ও হালিশহর এলাকায় কয়েকটি গ্যারেজে চোরাই সিএনজিচালিত ট্যাক্সির ‘পরিচয় বদলের’ কাজ চলে। এসব গ্যারেজে চোরাই ট্যাক্সির ইঞ্জিন ও চেসিস নম্বর পরিবর্তন করা হয়। এছাড়া বহদ্দারহাটে ভুয়া নম্বর প্লেট তৈরি এবং কালামিয়া বাজারে বিআরটিএ’র নকল ফাইল ও কাগজপত্র তৈরির মূল হোতাদের অবস্থান রয়েছে। গ্যারেজ মালিক হাজার টাকায় কেনা চোরাই সিএনজি ট্যাক্সি গ্যারেজে নিয়েই যন্ত্রাংশ খুলে ফেলে। এরপর গ্যারেজের ভেতরেই ইঞ্জিন-চেসিস নম্বর পাল্টে ভুয়া রেজিস্ট্রেশন নম্বর লাগানো হয়। পরে কাস্টমার বুঝে সুবিধামতো আসল পরিচয়ে ওই চোরাই ট্যাক্সি তিন থেকে চার লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের কতিপয় সার্জেন্ট ও টিআইদের সাথে মাসিক চুক্তিতে বেনামে রেজিস্ট্রেশন করা এ ধরনের বেশকিছু চোরাই সিএনজচালিত ট্যাক্সি নগরীতে চলাচল করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। চলতি পথে এসব চোরাই ট্যাক্সি কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ আটক করলেও ফোন কল পেয়ে ছেড়ে দেয়। চক্রের সকল পর্যায়ের সদস্যদের আইনের আওতায় আনা না গেলে অল্প বিনিয়োগে অধিক লাভের এই কারবার বন্ধ করা সম্ভব নয় বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।