স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কওমি আলেমদের বৈঠক স্থগিত

36

হাটহাজারী প্রতিনিধি

কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর দেওনার পীর মাদ্রাসা দাওয়াতুল হক দেওনা কাপাসিয়া গাজীপুর মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মিজানুর রহমান চৌধুরী দেশের কওমীপস্থি মাদ্রাসার মানোন্নয়নকল্পে ৮টি দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রেরিত চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে মাদ্রাসার শিক্ষা বোর্ডগুলোর নেতাদের বৈঠক হওয়ার কথা ছিলো। যদিও গতকাল সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষে উপ-সচিব শামীম হাসান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে অনিবার্য কারণবশত সেই প্রোগ্রাম স্থগিত করার বিষয় জানানো হয়। এর আগে গত শনিবার সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অপারগতা জানিয়ে আসে কওমী মাদ্রাসার শিক্ষা বোর্ডগুলোর সমন্বিত কর্তৃপক্ষ আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআ’তিল কওমিয়া’র একটি প্রতিনিধি দল।
জানা গেছে, হেফাজত আমীর আল্লামা মহিবুল্লাহ বাবুনগরীর একটি বিবৃতি ও কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা বোর্ডগুলোর সমন্বিত কর্তৃপক্ষের অপারগতার কারণে ওই বৈঠকে যেতে অনীহা কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের শীর্ষ নেতাদের। ফলে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এই বৈঠক স্থগিত করা হয়েছে। তবে, হেফাজতের ওই নায়েব আমীরের ধারণা বৈঠকটি স্থগিত না হলে দেশের কওমীপস্থি মাদ্রাসার মানোন্নয়নে অনেক যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত আসত। যাদের কারণে এই বৈঠকটি স্থগিত হলো তাঁর মতে তারা কওমীপন্থি মাদ্রাসার উন্নতি সহ্য করতে পারে না।
বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, গত ২৫ জুন হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর ‘কওমি ধারার দ্বীনি শিক্ষা ও শিক্ষকের মানোন্নয়নকল্পে সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ’ শিরোনামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে তিনি কওমি মাদ্রাসার মানোন্নয়নে ৮টি দাবি জানান। এ চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত ৪ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কওমি মাদ্রাসার বোর্ড প্রধানদের একটি বৈঠকের আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠি আসার দুই দিন পর গত শনিবার এক যৌথ বিবৃতিতে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী সেই চিঠির প্রতিবাদ জানিয়ে একটা বিবৃতি দেন। চিঠিতে অধ্যক্ষ মাওলানা মিজানুর রহমান চৌধুরীর সেই চিঠির সঙ্গে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানানো হয়।
হেফাজত আমীর মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, সিনিয়র নায়েবে আমীর আল্লামা মুহাম্মাদ ইয়াহ্ইয়া এবং মহাসচিব আল্লামা সাজিদুর রহমানের এই যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, কওমী ধারার দ্বীনি শিক্ষা ও শিক্ষকদের মান উন্নয়নকল্পে সদয় দৃষ্টি কামনা’ শিরোনামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরে লিখিত হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নায়েবে আমীর অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরীর একটি চিঠি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এটি হেফাজতের পক্ষ থেকে লিখিত কোনো চিঠি নয়। অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরী সেই চিঠির বিষয়টি হেফাজতের কোনো ফোরামে আলোচনা করে তিনি প্রেরণ করেননি। এটি একান্তই তার ব্যক্তিগত। গণমাধ্যমের বরাতে বিষয়টি জানতে পেরেছে হেফাজত নেতৃবৃন্দ।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে নায়েবে আমীর অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরীর চিঠি ও তার বিপরীতে দলের আমীরসহ ৩ শীর্ষ নেতার বিবৃতি নিয়ে কওমী অঙ্গনে সৃষ্টি হয় তোলপাড়। একপর্যায়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে অংশগ্রহণ করতে অপারগতা জানায় কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডগুলোর সমন্বিত কর্তৃপক্ষ আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআ’তিল কওমিয়া বাংলাদেশ। এর প্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিয়ে আগামি ১০ আগস্টের বৈঠকটি স্থগিত করে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মীর ইদরিস বলেন, কওমী বোর্ডগুলো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে যাবেন না শুনেছি। তবে সেই বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে কি সিদ্ধান্ত এসেছে তা আমি ঠিক জানি না। আর সেটা কওমী মাদ্রাসা বোর্ডের বিষয়, সরাসরি হেফাজতের না।
মাওলানা মিজানুর রহমান ইস্যুতে হেফাজতের কোনো সিদ্ধান্ত আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনও এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তের কথা আমি জানি না। তবে অধ্যক্ষ মাওলানা মিজানুর রহমান হেফাজতের পদবী ব্যবহার করেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। হেফাজত আমীর ও মহাসচিব তাই বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন সেটা একান্ত তাঁর (মিজানুর রহমান) বিষয়। এই চিঠির সাথে হেফাজতের কোনো সম্পর্ক নেই।
অন্যদিকে, কওমী মাদ্রাসার একাধিক দায়িত্বশীল সিনিয়র আলেম জানিয়েছেন, হেফাজতে ইসলাম একটি ধর্মীয় সংগঠন। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার বিষয়টি দেখভালের জন্য কওমী বোর্ড আছে। সেক্ষেত্রে হেফাজতের নায়েবে আমীর অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরী গত ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে চিঠি দিয়েছেন তা তার এখতিয়ার বহির্ভূত। আর এ কারণেই আলেমদের মধ্যে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া কোনো কোনো দায়িত্বশীল আলেম মনে করছেন, সরকারের অভ্যন্তরের কারও পরামর্শেই অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরী এই প্রস্তাব দিয়েছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে মাদ্রাসার শিক্ষা বোর্ডগুলোর নেতাদের বৈঠক যাদের কারণে স্থগিত হলো তারা কওমীপন্থি মাদ্রাসার উন্নতি চায় না এমনটা বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে অধ্যক্ষ মাওলানা মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, বৈঠকটি স্থগিত না হলে দেশের কওমীপন্থি মাদ্রাসার মানোন্নয়নে অনেক যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত আসত। যেসব আলেমরা তথা যারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেয়া চিঠিকে এখতিয়ার বহির্ভূত বলছে তারাই মূলত দেশের কওমী মাদ্রাসায় শিক্ষার উন্নয়ন চায় না। যাদের কারণে এই বৈঠকটি স্থগিত হলো তারা কওমীপন্থি মাদ্রাসার উন্নতি সহ্য করতে পারে না। তবে আমি কওমি ধারার দ্বীনি শিক্ষা ও শিক্ষকের মান উন্নয়নকল্পে আমি কাজ করছি।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রেরিত চিঠি পাঠানো আগে হেফাজতের র্শীষ নেতাদের সাথে কথা বলেছেন কিনা জানতে চাইলে মাওলানা মিজানুর রহমান চৌধুরী আরও বলেন, আমি জানি, এসব অনেকেই বিরোধিতা করবে, বিশেষ করে আমার অঙ্গনের (কওমী) মানুষরাই আগে করবে। তবে তাদের কাছে আমার প্রশ্ন এত দিন তারা কোথায় ছিল? হেফাজতের অনুষ্ঠিত সকল বৈঠকে এসব বিষয়তো আলোচনা হয়েছে। তবে আমি বেফাক কিংবা হাইআতুল উলয়া’র কোনো কমিটিতে নাই। যে কারণে তাদের কাছে উপস্থাপনের সুযোগ পাইনি। কিন্তু আমার কাছে তথ্য আছে বেফাক এবং হাইআতুল উলয়ারও বিভিন্ন সময় অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীকে পেশ করা আমার ৮টি দাবি সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছিল।
এছাড়া, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিদের উদ্যোগে ‘মৌলবাদী ও সা¤প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে গঠিত গণকমিশন’ দেশের এক হাজার মাদ্রাসার ১১৬ আলেম ও ইসলামী বক্তার একটি তালিকা গত ১১ মে দুর্নীতি দমন কমিশনে জমা দিয়েছেল। শুধু তাই নয়, তালিকায় স্থান পাওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে জঙ্গি অর্থায়ন এবং ওয়াজের মাধ্যমে ধর্মীয় স¤প্রীতি নষ্ট করা ও ধর্মের নামে ব্যবসার অভিযোগ এনেছিল গণকমিশন। তারা ‘বাংলাদেশে মৌলবাদী সা¤প্রদায়িক সন্ত্রাসের ২০০০ দিন’ শীর্ষক শ্বেতপত্রও প্রকাশ করেছিল। ওই সময় আমাদের হেফাজত-কওমীপন্থি আলেকমরা কি করেছিল। বরং দেশের কওমীপন্থি মাদ্রাসার মানোন্নয়নকল্পে ৮টি দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি প্রেরণ করেছি বলে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক) কর্তৃপক্ষ আমার মাদ্রাসার (মাদ্রাসা দাওয়াতুল হক দেওনা কাপাসিয়া গাজীপুর মাদ্রাসার) নিবন্ধন সাময়িক স্থগিত করে দিয়েছে বলে তিনি জানান।
মাদ্রাসার নিবন্ধন সাময়িক স্থগিত করার ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সহ-সভাপতি ও আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআ’তিল কওমিয়ার সদস্য মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন রাজু গহরপুরী বলেন, বেফাকের সংবিধান অনুয়ায়ী শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে গত ৭ আগস্ট খাস কমিটির মিটিংয়ে মাদ্রাসা দাওয়াতুল হক দেওনা কাপাসিয়া গাজীপুর মাদ্রাসার নিবন্ধন সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে।