সোশ্যাল মিডিয়ায় যতকথা

6

তেলবাজ আর তোষামোদী লোক সমাজের শত্রু

মোহাম্মদ শাহজাহান

আজকাল সমাজে ভালো মানুষের বড়ই অভাব। এই পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত মানুষ বাড়ছে। কিন্তু ভালো মানুষের সংখ্যা বাড়ছে না। এখন মানুষ আত্মকেন্দ্রীক বেশি। সারা পৃথিবীতে মানুষ অদ্ভুত প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। তার মধ্যেও কিছু মানুষ আশার আলো দেখায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে এক হাজার ১১১ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর মধ্যে ৯৯১ জন শিক্ষক, চিকিৎসক ৪৯ জন, আইনজীবী ৪২ জন, সাংবাদিক ১৩ জন, সাহিত্যিক-শিল্পী-প্রকৌশলী ১৬ জন। মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস বুদ্ধিজীবীদের নিধন করা হয়। এমনকি মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহিনী বাঙালি জাতির বরেণ্য সন্তানদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে চোখ বেঁধে নির্মম-নিষ্ঠুর নির্যাতন করে, ঘটায় নারকীয় হত্যাকাণ্ড। মুক্তিযুদ্ধে জীবনদানকারী এসব বুদ্ধিজীবীই ছিলেন বাংলাদেশের সুশীল সমাজের শিরোমণি। কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমানে মানুষের এমন কিছু চারিত্রিক স্বভাব রয়েছে, যেগুলো খুবই নিকৃষ্ট ও অপছন্দনীয়। তেলবাজী ও তোষামোদকারী স্বভাবগুলোর কারণে সমাজ, প্রতিষ্ঠান এবং মানুষের অধপতন এখন সুনিশ্চিত।
তেলমারা বা তোষামোদ করা নিয়ে খুবই বিখ্যাত একটা গল্প হলো গ্রিক দার্শনিক ডায়োজেনেসের। রাজা ডেনেসের তোষামোদ করতেন না বলে তাঁকে খুব কষ্ট করে দিন কাটাতে হতো, যখন অ্যারিস্টোপাস নামে আরেকজন দার্শনিক রাজাকে খুশি করে খুবই আরামে-আয়েশে ছিলেন।
তো একদিন অ্যারিস্টোপাস বাড়িতে এসে দেখলেন ডায়োজেনেস শাক দিয়ে ভাত খাচ্ছেন। অ্যারিস্টোপাস ঠাট্টা করে বললেন, ‘একটু তোষামোদী শিখলে তোমাকে শাক দিয়ে ভাত খেতে হতো না।’
ডায়োজেনেস উত্তরে বললেন, আর তুমি যদি কষ্ট করে শাক দিয়ে ভাত খাওয়াটা শিখতে তাহলে তোমাকে অমন তোষামোদী করতে হতো না।
কারো অতিরিক্ত তোষামোদী বা প্রশংসা করাও ইসলামে নিষিদ্ধ। এতে মিথ্যার প্রচার ও প্রসার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। মানুষের অহংকারবোধ তৈরি করে। সে কারণে তোষামোদী করা ইসলামে নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাআলা বলেন-‘তুমি মনে করো না, যারা নিজেদের কৃতকর্মের উপর আনন্দিত হয় এবং না করা বিষয়ের জন্য প্রশংসা কামনা করে, তারা আমার কাছ থেকে অব্যাহতি লাভ করেছে। বস্তুতঃ তাদের জন্যে রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৮৮)
মাত্রারিক্তি প্রশংসা তথা তোষামোদী সম্পর্কে হাদিসে এসেছে— তোমরা যদি কাউকে মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা করতে দেখ তাহলে তাদের মুখে মাটি ছুঁড়ে মারবে।’ (মুসলিম, মিশকাত)- কোনো ফাসিক ব্যক্তির প্রশংসা করা হলে আল্লাহ তাআলা রাগান্বিত হন এবং এতে তার আরশ কেঁপে ওঠে।’ (বায়হাকি, মিশকাত)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তার অধপতন তথা ভয়াবহ আজাব থেকে রক্ষা পেতে উল্লেখিত বদ স্বভাবগুলো থেকে হেফাজত থাকার তাওফিক দান করুন।
বলাবাহুল্য কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে এমন খারাপ লোকের অভাব নেই। তাঁরা কিন্তু সবার কাছে চিহ্নিত। সবাই জানে, কার কাজের ধরন কতটুকু, কে নম্র, কে ভদ্র, কে মিত্যাবাদী, কে কাজ ফাকি দেয়, কে অন্যের বিরুদ্ধে অবান্তর কথা বলে। সুতরাং তেলবাজ আর তোষামোদকারীর সাথে কোনো বিষয়ে আপোস নয়। এরা সমাজ, প্রতিষ্ঠান তথা প্রকৃত মানুষের শত্রæ। এদেরকে এড়িয়ে গেলেই চলবে না, এদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।

বিজ্ঞান শিক্ষা

বাবুল কান্তি দাশ

আমি যখন বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালাই তখনই টমাস আলভা এডিসনকে দেখতে পাই। বীজগণিতের পাতায় পাতায় আল-খোওয়ারিজমিকে খুঁজে পাই। বিমানের উড্ডয়ন দেখলেই আব্বাস ইবনে ফিরনাস আর রাইট ব্রাদার্স দের কথা মনে পড়ে যায়। যখন কম্পিউটারে বসি তখনই সম্মান জানাই চ্যার্লস ব্যাবেজের প্রতি।আর এসবই হচ্ছে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার ফসল।সভ্যতার উৎকর্ষতার মারকোচ। আমাদের প্রাত্যহিক জীবন চলনার নিত্য সাথীয়া।মিথ্যাচার,অন্ধবিদ্বেষ ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিজ্ঞান হাতিয়ার। Carl Sagan h_v_©B যথার্থই বলেছেন Science is a way of thinking, much more than it is a body of knowledge. বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো সহজ-সরল ভাবে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া একটি বিশেষ শিল্প। আমাদের নাগরিকদের সাক্ষ্যপ্রমাণ নির্ভর সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সাহায্য করার দায়িত্বে বিজ্ঞান আন্দোলনকে গ্রহণ করতে হবে। দেশজুড়ে পরিকল্পিতভাবে চলছে মিথ্যার বেসাতি। ষড়যন্ত্রের নিত্যনতুন তত্ত¡ এবং বিভিন্নভাবে ‘সত্য’ নির্মাণ করা হচ্ছে। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক বিস্ফোরণের সুযোগ নিয়ে প্রতিদিন ছড়ানো হচ্ছে কুসংস্কার, কুযুক্তি অন্ধবিশ্বাসের বিষ।লক্ষ্য একটাই, মানুষকে চিন্তা রহিত করা,মানুষকে নির্বোধ বানাও, মানুষকে অন্ধবিশ্বাসে পরিণত কর, মানুষকে হুজগে মাতানো। তবেই দিনকে রাত বলে বানানো যাবে। হাতিকে গাধা বলে দেখানো যাবে। বিজ্ঞানে অনুসৃত পদ্ধতি ও প্রকরণের দ্বারা নাগরিকদের মধ্যে যুক্তিবাদী মানসিকতার প্রসার ঘটাতে হবে। তাদের দেখানো পথে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির বিরাট ভূমিকা রয়েছে। ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের গোড়ায় আঘাত আনতে হলে আমাদের অবশ্যই বিজ্ঞানকে অবলম্বন করতে হবে।বিজ্ঞান মানসিকতা ও বৈজ্ঞানিক মেজাজ তৈরীর জন্য আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।বস্তুগত সত্যকে স্বীকার না করার অনীহা লুকিয়ে আছে ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের মধ্যে।এর বিরুদ্ধে বিজ্ঞান আমাদের অস্ত্র। উন্নত দেশ ও জাতি গঠনে বিজ্ঞানের ভূমিকা ও অবদান উল্লেখযোগ্য। মানবিক ও প্রকৃত অর্থে আধুনিক বাংলাদেশ নির্মাণে বিজ্ঞানের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি বা বিজ্ঞান মানসিকতা ছাড়া প্রগতি অসম্ভব। যুগে যুগে দেশে দেশে অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর লড়াইয়ে বিজ্ঞান কর্মী ও বিজ্ঞান সাধকরা পথ দেখিয়েছে সমাজকে। প্রাচীন সংস্কার, অন্ধবিশ্বাস,পশ্চাদগামী মতাদর্শ, ধর্মের নামে বিভিন্ন অমানবিক চিন্তাভাবনা ও তার বীভৎস প্রয়োগকে নস্যাৎ করে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণে বিজ্ঞানের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন আমাদের পূর্বসূরিরা। কোন জাতি বিজ্ঞান শিক্ষায় যত এগিয়ে সে জাতি শিক্ষা-দীক্ষায়, সভ্যতায় ও উন্নয়নে তত এগিয়ে। আমাদের দেশে বিজ্ঞান পড়ুয়া শিক্ষার্থীর হার ০৯℅। পাশের দেশ ভারতে এই হার ৪০%,মালেশিয়ায় এই হার ৪৪℅,সিঙ্গাপুরে এই হার ৫০%। বিজ্ঞান শিক্ষার অগ্রগতিই রূপকল্প’৪১ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পারে। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বিজ্ঞানমনস্কতায় মনোনিবেশ জরুরি এবং তদনুগ শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন আবশ্যক।
জাতির জীবনধারা দুইটি ধারায় প্রবাহিত। এক ধারার নাম আত্মরক্ষা, স্বার্থ – প্রসার, আরেক ধারার নাম বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদী চেতনায় আত্মপ্রকাশ, পরমার্থ বৃদ্ধি। একটি হচ্ছে কদর্য। অন্যটি সৌন্দর্য্যরে পরম অনুভূতি। একদিকে কলহ, বিবাদ, যুদ্ধ, অশান্তির তমসাচ্ছন্নতা, অন্যদিকে শিল্প, সাহিত্য, ধর্ম, শান্তি ও কল্যাণের আলোকময়তা। একটি হচ্ছে করার জন্য করা, অন্যটি পরমানন্দের জন্য। একদিকে সংগ্রহ অন্যদিকে সৃষ্টি। যে জাতির জীবনে প্রথমটির আবশ্যকতা প্রকট হয়ে উঠবে, সে জাতি কখনো উঁচু জীবনের অধিকারী হতে পারে না। হয়ত কোন প্রকারে টিকে থাকতে পারবে। কিন্তু নব নব সৃজন তার দ্বারা সম্ভব হবে না। মানসিক ও আত্মিক জীবনে শ্রী ফোটাতে হলে তা’কে দ্বিতীয় ধারায় খুব বেশি মনোযোগী হতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন সন্তানদের বিজ্ঞানমনস্ক সুশিক্ষা প্রদান। বিজ্ঞানমনস্ক সুশিক্ষায় যত বেশি মনোযোগী হব,যতœবান হব তত বেশি কুসংস্কার ধর্মান্ধতা, অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে প্রচÐ শক্তিতে মানবাত্মা জেগে উঠবে নিঃসন্দেহে। শুভবুদ্ধির জাগরণ ঘটাতে হলে প্রজন্মকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার দায়িত্ব নিতে হবে মনে-প্রাণে।সভ্যতার আদর্শটি অক্ষুন্ন রেখে আমাদের আলোকভিসারী করে তুলতে পারে একমাত্র বিজ্ঞানমনস্ক সুশিক্ষা।