১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধ অনিবার্য ছিল না। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান পারভেজ মোশাররফের বারাবাড়ি রকমের পদক্ষেপ যুদ্ধের সুত্রপাত ঘটায়। প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফের অনুমতি ব্যতিরেকে আক্রমণ শুরু করে দিলে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা রক্ষায় তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্রোতে গা ভাসিয়ে দেন। যুদ্ধ চরম আকার ধারণ করলে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন। তিনি পাকিস্তান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ওয়াশিংটনে আমন্ত্রণ জানান। সেই আমন্ত্রণে নেওয়াজ শরীফ ছুটে গেলেও ওয়াশিংটনে যাননি ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী। পরে বিল ক্লিন্টনের দেওয়া প্রস্তাব মেনে নিয়ে কোণঠাসা পাকিস্তান ভারতের অভ্যন্তর থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করলে যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘটে। (নেওয়াজ শরীফ তাঁর লেখা স্মৃতিকথায় এর উল্লেখ করেছেন।)
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের মধ্যে এই মতদ্বৈততার চুড়ান্ত পরিণতি দেখা যায় একই সালের ১২ই অক্টোবর,নেওয়াজ শরীফকে সরিয়ে সেনাপ্রধান পারভেজ মোশাররফের ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে। ইতোমধ্যে নেওয়াজ শরীফ ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। সেনাবাহিনী সেটা আর আগাতে দিল না। সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতির আরেক অদ্ভুত-বেয়ারা ক্ষেমতা-পাকিস্তানে, চাইলেই তিনি একটা অজুহাত দাঁড় করিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্থ করতে পারেন! রাষ্ট্রপতির সেই অদ্ভুত তলোয়ারের বেপরোয়া আঘাতে ধরাশায়ী হয়ে ক্ষমতা হারান বেনজির ভুট্টোসহ আরও কজন। এ নিয়ে হট্টগোল বেঁধে যায় দেশ-বিদেশে। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, সেনাবাহিনী আর যুক্তরাষ্ট্রের সবুজ সংকেত ছাড়া রাষ্ট্রপতির পক্ষে দেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্থের মতো দুঃসাহস দেখানো অসম্ভব ছিল। রাষ্ট্রপতির সেই ক্ষমতা পরে ছেঁটে ফেলা হয় বটে। তারপরও পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় সে দেশের সেনাবাহিনী, সুপ্রিম কোর্ট আর যুক্তরাষ্ট্র বরাবরের মতোই মূল অনুঘটক। সেুপ্রিম কোর্টের সে ক্ষমতার চর্চা সম্প্রতি দেখাও গেছে। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের আহবানে পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেওয়া হলে সুপ্রিম কোর্ট এক আদেশে তা পুনর্বহাল করার পাশাপাশি ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনিত অনাস্থা ভোটের আয়োজনেরও নির্দেশ দেন। সুপ্রিম কোর্ট এই আদেশ দেওয়া থেকে বিরত থাকলে ইমরান খানের রাজনৈতিক পথপরিক্রমা আজ অন্যরকমও হতে পারতো।
আপাতত সুপ্রিম কোর্ট, সেনাবাহিনী এবং যুক্তরাষ্ট্রেও ভূমিকা ইমরান খানের বিপরীতে। অতীতের ইতিহাস ঘেঁটে ইমরান খানও বুঝে নিয়েছেন- না, এভাবে একসাথে তিন শক্তির সাথে তিনি পেরে উঠবেন না। সর্বোপরি স্বাধীনচেতা, আত্মমর্যাদায় বিশ্বাসী, প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী কাওকে সে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতে দেওয়া হয় না। বিশেষকরে যে দেশে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজনীতিবিদদের রাষ্ট্রের বেতনভুক্ত সেনাবাহিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় সেই দেশে গনতন্ত্র কখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে পারে না। আর এই ভঙ্গুর যায়গায় যুক্তরাষ্ট্র তার কৌশলী হাত ঢুকিয়ে দিয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের সুবিধা নিয়ে নিচ্ছে বছরের পর বছর। সরকার, সেনাবাহিনীও মুখিয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের অনুকম্পার আশায়। এই সমর্থন যে পক্ষের ভাগ্যে জোটে তাদের ‘কুচ পরওয়া নেহি’ ভাব এসে যায়। এটাই পাকিস্তান। এই চিত্রটি ভারতে বিপরীত। স্বাধীনতার ৭৫ বছরের ইতিহাসে পাকিস্তানে যেখানে একদিনের জন্যেও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দেওয়া যায়নি, দমানো যায়নি সেনাবাহিনীর ক্ষমতালীপ্সাকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব-বলয় থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারেনি-ভারত সেখানে সবদিক দিয়ে সফল। সেখানে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে, সেনাবাহিনী একদিনের জন্যেও রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেনি, যুক্তরাষ্ট্রের অযাচিত হস্তক্ষেপের ব্যাপারে তারা বেশ সোচ্চার। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ভারতবাসীর এতো বিরোধিতা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রই বরং উপযাচক হয়ে ভারতের সাথে পরমাণু চুক্তির মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল চুক্তিটি সম্পাদন করেছে। অন্যদিকে ঠিক একই চুক্তির জন্য শত লবিং-তদবিরেও যুক্তরাষ্ট্রকে রাজি করাতে পারছে না পাকিস্তান। অতএব বুঝতে হবে এই যুক্তরাষ্ট্র ২০২২ সালের, ১৯৭১ সালের যুক্তরাষ্ট্র নয়।
সর্বশেষ ইমরান খানকে ফেলে দিয়ে পাকিস্তান সেই পুরোনো খোলসেই ফিরে গেলো আবার। অস্থির-মেরুদন্ডহীন পাকিস্তানিরা আবার সেনাবাহিনী আর যুক্তরাষ্ট্রের পাতানো খেলার গুটি হয়ে সেই পুরোনো রাজনৈতিক মঞ্চটিই মাতাবেন ভুল মুদ্রার বেঢপ নৃত্য দিয়ে। এভাবেই চলছে দ্বিজাতিতত্তে¡র প্রবক্তাদের দেশটি।
লেখক: প্রাবন্ধিক