সালেহ আহমদের মৃত্যুর দায় সিডিএ’র

34

সবুর শুভ
মুরাদপুরে খোলা নালায় তলিয়ে যাওয়া ব্যবসায়ী সালেহ আহমদের (৫০) মৃত্যুর ঘটনায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (সিডিএ) দায়ী করল তদন্তকমিটি। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত এ কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রীপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার পাঠানো এ প্রতিবেদনে সিডিএকে প্রধানতম দায়ী হিসেবে উল্লেখ করা হলেও নগরবাসীর অভিভাবক হিসেবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) দায় এড়াতে পারে না বলে তথ্য উঠে আসে তদন্তে। এ কারণে নগর উন্নয়নে প্রধান সেবা সংস্থা হিসেবে সিটি করপোরেশনও কাঠগড়ায়। সালেহ আহমদ নিখোঁজের দু’মাস ৮দিনে আলোচিত এ ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন এসেছে।
এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, খোলা নালায় পড়ে ব্যবসায়ী সালেহ আহমদের মৃত্যুর ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি মঙ্গলবার মন্ত্রীপরিষদ বিভাগে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এ মৃত্যুর জন্য যাদের দায় ও অবহেলা আছে আমরা তাদের বিষয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছি।
প্রসঙ্গত, গত ২৫ আগস্ট মুরাদপুর এলাকায় জলাবদ্ধতার তীব্র স্রোতে পা পিছলে নালায় পড়ে নিখোঁজ হন সালেহ আহমদ। তার বাড়ি পটিয়ার মনসার টেক এলাকায়। তিনি ওই এলাকার আব্দুল হাকিমের ছেলে। ফায়ার সার্ভিসের ৫ সদস্যের ডুবুরি দল ও উদ্ধারকারী টিমের ৬ সদস্য তাকে উদ্ধারে সপ্তাহের বেশি সময় ধরে অভিযান চালিয়েও লাশ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়নি। শেষতক নালাতেই সালেহ আহমদের সমাধি রচিত হয়। পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয় উদ্ধার অভিযান। এ ঘটনায় দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠে।এরপর গত ২ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশে এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন, স্থানীয় ব্যবসায়ী, দোকানদার, নিখোঁজ ব্যবসায়ীর সন্তান এবং একজন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদনটি তৈরি করে।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে গঠিত কমিটিতে রাখা হয় সিএমপি কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি, সিডিএ’র সচিব, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী এবং চট্টগ্রাম শহরে জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের দুই পরিচালক। তাদের মধ্যে একজন সিডিএ’র প্রকৌশলী ও আরেক সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা। কমিটি গত সোমবার বৈঠক করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করে। সেটি গতকাল মঙ্গলবার পাঠিয়ে দেয়া হয় মন্ত্রীপরিষদ বিভাগে।
এ বিষয়ে বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, তিনটি বিষয়কে ভিত্তি হিসেবে ধরে আমরা তদন্ত কাজ করেছি। ঘটনাস্থলে কোনো প্রকল্প চলমান আছে কিনা? থাকলে সেটি কোন সংস্থার? প্রকল্প এলাকায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা? আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই দিনের একজন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলেছি। নালা সংলগ্ন রাস্তার দুই পাশের দোকানদারসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা হয়েছে। দোকানদারদের জিজ্ঞেস করলাম- এখানকার নালার ওপর অতীতে কোনো স্ল্যাব ছিল কিনা। তারা বলল, ছিল। তবে কে বা কারা স্ল্যাবগুলো তুলে নিয়ে যায়। কখন তুলেছে সেটা জিজ্ঞাসা করেও আমরা সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছি।
অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার আরো জানান, সেখানে বর্তমানে সিডিএ’র জলাবদ্ধতা নিরসনে নেয়া মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে বলে আমরা জানি। কাজ চলাকালীন সড়ক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব প্রকল্প কর্তৃপক্ষের। এজন্য নির্দিষ্ট বরাদ্দও থাকে প্রকল্পের বাজেটের মধ্যে। তাই ব্যবসায়ী নিখোঁজের মূল দায় কিন্তু সিডিএ’র। এ বিষয়ে আমরা সিডিএ’র প্রকল্প পরিচালক ও সেনাবাহিনীর তরফ থেকে নিয়োজিত প্রকল্প পরিচালকের লিখিত বক্তব্য চেয়েছিলাম। সিডিএ বক্তব্য দিলেও সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক বক্তব্য দিয়েছেন সিডিএ’র মাধ্যমে। একই সঙ্গে চসিক নগরীর প্রধান উন্নয়ন সেবা সংস্থা। যেকোন অবস্থাতেই নাগরিকদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব চসিকের। কারন চসিকের মাননীয় মেয়রকে ‘নগর পিতা’ বলা হয়। এ কারণে সন্তানদের দেখভালের বিষয়ে পিতার অবশ্যই দায় আছে। কিন্তু চসিক ফুটপাত ও সড়কে নির্বিঘ্নে চলাচলে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করায় তারাও দায় এড়াতে পারে না বলে জানালেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বার্থে ৩৬ নালা সিডিএকে দেয়া হলেও এক্ষেত্রে গাফেলতি ও অবহেলার নজরদারি করা সিটি করপোরেশনেরও দায়িত্ব।
মুরাদপুর এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা এডভোকেট মোহাম্মদ ইদ্রিস জানান, পানি-ময়লা আবর্জনা নিষ্কাশনে নালা ড্রেনগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না সেবা সংস্থার তরফে। এ অবস্থায় বৃষ্টি হলেই নগরীতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠে। একই সঙ্গে নালা-ড্রেনে  না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে চলছে পথচারি। নালায় পড়ে সালেহ আহমদরা প্রাণ হারাচ্ছে। এ নিয়ে দায়িত্বশীলদের দায়িত্বশীলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে বার বার। দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে সেবা সংস্থাগুলো পরস্পরকে দোষারোপে ব্যস্ত থাকছে। এ অবস্থায় নগরবাসী অসহায় অবস্থায় আছে বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন এ আইনজীবী।
তথ্য অনুযায়ী, গত ২৭ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে নগরীর আগ্রাবাদ শেখ মুজিব সড়কে মাজারগেট এলাকায় নালায় পড়ে নিখোঁজ হন চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী সেহেরীন মাহবুব সাদিয়া (১৯)। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা অভিযানের পর ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরী দলের সদস্যরা নালার বর্জ্য থেকে সাদিয়ার মৃতদেহ উদ্ধার করে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর সকালে নগরীর মাঝিরঘাট রোডের ড্রেন থেকে অজ্ঞাত (৩৫) এক পুরুষের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
পুলিশ জানায়, ড্রেনে পড়ে গিয়ে উঠতে না পেরে মারা গেছেন এ অজ্ঞাত পথচারী। গত ৩০ জুন দুপুরে নগরীর ২ নং গেট মেয়র গলিতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অটোরিকশা খালে পড়ে মারা যান খাতিজা বেগম (৬৫) ও চালক মো. সুলতান (৩৮)। এভাবে একেরপর এক অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর ঘটনা রীতিমত আতঙ্ক ছড়িয়েছে নগরবাসীর মধ্যে।
এদিকে ড্রেনে পড়ে সালেহ আহমদ ও সাদিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় প্রতি পরিবারকে ১ কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে। সিসিবি ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠনের পক্ষে আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল হালিম ও ইশরাত হাসান গত ১৯ অক্টোবর এ নোটিশ পাঠান। এ নোটিশটি স্থানীয় সরকার ও স্বরাষ্ট্র সচিব, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট ১৩ জনকে পাঠানো হয়েছে। নোটিশে দুজনের মৃত্যুর ঘটনায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) কী ব্যবস্থা নিয়েছে তাও জানাতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে ব্যারিস্টার আবদুল হালিম জানান, এ আইনি নোটিশের উপর ভিত্তি করেই আমরা হাইকোর্টে রিট করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। খুব শীঘ্রই রিট করা হবে।
নিখোঁজ ব্যবসায়ী সালেহ আহমদের ছেলে সাদেকুল মহিমকে চাকরি দিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। গত ১২ অক্টোবর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কার্যালয়ে মেয়র রেজাউল করিমের সাথে সাক্ষাৎ করে সাদেকুল মহিম। এরপর ১ নভেম্বর থেকে কাজে যোগ দিয়েছেন মহিম।