সাম্প্রদায়িকতার শিকড় সন্ধান ও আমাদের ভাবনা

34

অমল বড়ুুয়া

সাম্প্রদায়িকতার অর্থ ব্যক্ত করা খুব একটা সহজ নয়। ঈড়সসঁহধষরংস রহ সড়ফবৎহ ওহফরধ নামক বইয়ে বিপিন চন্দ্র মত দেন সাম্প্রদায়িকতার ধারণা একটি বিশেষ বিশ্বাস বা প্রত্যয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত। সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় পার্থক্য হলো গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক। অর্থাৎ ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলির মধ্যে পারষ্পরিক বিরোধিতাই হল সাম্প্রদায়িকতা। পশ্চিমা পণ্ডিতদের মতে, ‘বহুত্ববাদী সমাজ ব্যবস্থায় একটি জনসম্প্রদায় নিজেদের অভিন্ন পরিচয় অভিব্যক্তির জন্য রাজনীতির ক্ষেত্রে দৃঢ়তার সঙ্গে নিজেদের জাহির করতে উদ্যোগী হয়, এই উদ্যোগই হল সাম্প্রদায়িকতা।’ এক সময় এই ভারত-উপমহাদেশে সর্বধর্মের মানুষ শান্তি সম্প্রীতি সৌহার্দ ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে প্রীতিময় জীবন যাপন করত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে সেই সৌহার্দ ও সম্প্রীতির দেয়ালে ফাটল ধরতে শুরু করে। ব্রিটিশদের চক্রান্তেই ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষের জন্ম হয়। ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম করার জন্য সুকৌশলে ব্রিটিশরা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে দেয়। মূলত ১৯৩৭ সালের পর ফ্যাসিবাদী সাম্প্রদায়িকতা ভারববর্ষে বিকাশ লাভ করতে থাকে। যদিও ভারতবর্ষে প্রথম সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সুত্রপাত ঘটে ১৮৫৯ সালে। কলকাতায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটে ১৯১৮ সালে। উত্তর প্রদেশে ১৯২৩ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত ৯১টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। ১৯২৪ সালে কোহাটে, ১৯২৬ সালে ঢাকা, পাটনা, রাওয়ালপিন্ডি ও দিল্লিতে দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। ১৯৪৬ সালে সংঘটিত হয় কলকাতা ও নোয়াখালী দাঙ্গা। মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালী দাঙ্গায় শান্তি স্থাপনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভারত ও পাকিস্তান নামে বিভক্তি হয়। দুই দেশের মধ্যে বিভক্তি রেখা টানেন ব্রিটিশ আইনজীবি সিরিল রেডক্লিফ। ব্রিটিশ ভারতে তখন ৪০ কোটি মানুষ ছিল। ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ নতুন দেশের খোঁজে রেডক্লিফ রেখা অতিক্রম করে। এ সময় ধর্মীয় সহিংসতায় ৫ থেকে ১০ লাখ মানুষ নিহত হয়। বেদনাদায়ক এই ঘটনার ফলশ্রুতিতে ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্ক আজও তিক্ততায় ভরা। ধর্মের ভিত্তিতে সে বিভক্তির রেশ এ অঞ্চলের মানুষগুলোর মনোজগতে প্রভাব ফেলেছে গভীরভাবে। যার রেশে ১৯৪৯ সালের ২০ ডিসেম্বরে তৎকালীন খুলনা জেলার বাগেরহাট উপজেলার মোল্লাহাটে কালশিরা হত্যাকাÐ ঘটে। ১৯৫০ সালের ৫ জানুয়ারি ঘটে নাচোলের হত্যাকাণ্ড। আবার ১৯৫০-এ ঘটে বরিশাল দাঙ্গা। ১৯৬৪ সালের দাঙ্গায় তৎকালীন প‚র্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) বাঙ্গালী হিন্দুদের উপর চালানো হয় নিষ্ঠুর গণহত্যা। ১৯৭১ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে কয়েক বছরের মধ্যেই ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি ক্রমেই দুর্বল হতে শুরু করে। এক্ষেত্রে প্রথম মৌলিক পরিবর্তন ঘটে সামরিক বাহিনীর প্রধান এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে (১৯৭৭-১৯৮১) বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে। জিয়াউর রহমানের পর সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৮ সালের ৭ জুন চতুর্থ জাতীয় সংসদে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী আনেন। এই সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ সংবিধানের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রকে ক্ষুন্ন করা হয় এবং সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর উপর নিপীড়নের মাত্রা বাড়তে থাকে। ১৯৮৯ ও ১৯৯২ সালের সাম্প্ররদায়িক সহিংসতা সংঘটিত হয় ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙ্গাকে কেন্দ্র করে। ২০০১ সালে আবারও নির্বাচন উত্তর সহিংসতার শিকার হন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামু উপজেলায় হামলা চালিয়ে লুটপাটসহ ১২টি বৌদ্ধ মন্দির ও ৩০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ২০১৩ সালের ফেব্রæয়ারী মাসে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালের রায় ঘোষণার পর সংখ্যালঘু পরিবারের উপর শুরু হয় নির্যাতন। ৫ জানুয়ারি ২০১৪ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরদিন যশোরের অভয়নগর থানার চাপাতলা গ্রামে সংখ্যালঘু পরিবারের উপর হামলা চালানো হয়। ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ঘরবাড়ি ও মন্দিরে হামলা হয়। ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর বোরহানউদ্দিনে সহিংস হামলার ঘটনা ঘটে। ২০২১ সালের শারদীয় দুর্গোৎসবে কুমিল্লার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা। আর ২০২২ সালের ১৫ জুলাই নড়াইলের লোহাগাড়ায় ঘটে সাম্প্রদায়িক হামলার সর্বশেষ ঘটনা।
সা¤প্রতিক বছরগুলোতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা বেড়েই চলেছে। হামলাগুলোর ধরন ও কারণ প্রায় অভিন্ন। শুরুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো একটি পোস্টের কারণে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ তোলা হয় এবং তা ছড়িয়ে দিয়ে সাম্প্ররদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু যে ব্যক্তির সামাজিক মাধ্যমের পোস্ট নিয়ে উত্তেজনা, সে বিষয়ে তার কোনো সংশ্লিষ্টতাই নেই। তাছাড়া এটা ঠিক যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের কোনো সদস্য সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় অনুভ‚তিতে আঘাত দেওয়ার সাহসই পাবে না। তবে এটা সত্য যে, গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এভাবে সংঘবদ্ধ সহিংসতা চালানো হয়ে থাকে। কেউ ধর্ম অবমাননা করলে, তার প্রতিকারে প্রচলিত আইনি ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু প্রতিটি ঘটনায় দেখা যায় উত্তেজনা সৃষ্টিকারী ও হামলাকারীদের বদলে আক্রান্তদের আটক করা হয়। যারা আইন নিজের হাতে তুলে নেয় এবং বে-আইনি কর্মকাণ্ডে উস্কানি দেয় ও অংশগ্রহণ করে, তাদের আটক ও বিচার করা হয় না। এই সব ঘটনায় হামলাকারীদের বদলে আক্রান্তদের আটক ও হেনস্তা করার কারণেই সাম্প্ররদায়িক শক্তিগুলো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। ঘটনায় উস্কানিদাতা ও হামলাকারীদের বিচার নিশ্চিত করা গেলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়ানো সম্ভব হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের জন্মের শুরু থেকেই সংখ্যালঘুরা ছিল অপশক্তির টার্গেট। একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বেছে বেছে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তানিদের হাত থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হলেও স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের ওপর আক্রমণ থামেনি। জাতীয়সহ বিভিন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কিংবা তুচ্ছ কোনো ঘটনাকে পুঁজ্রি করে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। এছাড়া ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন এক নতুন মাত্রা হিসেবে দেখা দিয়েছে। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, কোনো জাতি বা গোষ্ঠীর সদস্যদের বেছে বেছে নির্যাতন বস্তুত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। রাজনৈতিক গোলযোগের সূত্র ধরেও যদি তেমন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে তাদের বিচারের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের সমাজ ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। সা¤প্রদায়িকতার ছোবলে বাংলাদেশ এখন ক্ষতবিক্ষত। সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের কারণ খুবই সরল। প্রথম কারণটি হচ্ছে ভ‚মিদস্যুতা, দ্বিতীয়টি তাদের গায়ে আওয়ামী ভোটব্যাংকের সিল পড়ে যাওয়া এবং তৃতীয় হচ্ছে জঙ্গিবাদপ্রসূত অসহিষ্ণুতা, যা ভিন্ন ধর্মের মানুষ ও তাদের মন্দির-প্যাগোডা-গির্জার ওপর আক্রমণকে ন্যায্যতা দিচ্ছে। এ ধরনের হামলায় জাতীয় সংহতি ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া এই বিষয়টি নিছক সংহতি ও ভাবমূর্তির নয়। এর সঙ্গে নাগরিক অধিকারের প্রশ্ন জড়িত। ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সা¤প্রদায়িক দাঙ্গার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশবাসীকে আহŸান জানিয়েছিলেন রুখে দাঁড়ানোর জন্য। এবারও রুখে দাঁড়াতে হবে। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় শুধু প্রশাসনিক দক্ষতা নয়; সামাজিক শক্তিও গুরুত্বপূর্ণ। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি; তার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্রে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে নাগরিক অধিকার। বিপন্ন হচ্ছে জীবন ও জীবিকা। আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ, ঘর-বাড়ী, উপাসনালয়, নষ্ট হচ্ছে শান্তি-সৌহার্দ ও সম্প্রীতি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর জাতীয় সংসদে বলেন, ‘ভবিষ্যৎ বংশধররা যদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাহলে আমার জীবন সার্থক হবে, শহীদের রক্তদান সার্থক হবে।’ ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় গেলে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন এবং জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করবে। কমিশন নয়, এখন সময়ের দাবি অগণতান্ত্রিক, অন্যায্য ও অবৈধ পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে ৭২-এর সংবিধান ফিরিয়ে আনা। উচ্চ আদালতের নির্দেশেও সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। ৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতির অন্যতম ছিল ১. জাতীয়তাবাদ, ২. গণতন্ত্র, ৩. সমাজতন্ত্র ও ৪. ধর্মনিরপেক্ষতা। পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের এই চার মূলনীতির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রদ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন করা যায় না।’ বর্তমান জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকারে আসীন আছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আওয়ামীলীগ সরকার যারা স্বাধীন বাংলাদেশ ও সংবিধানের প্রবর্তক। আমরা চাই আওয়ামীলীগ সরকারই উচ্চ আদালতের নির্দেশমতে ৭২-এর মূল সংবিধান ফিরে আনুক। আর এই সরকারের শাসনামলেই সকল সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও হামলার বিচার হোক। সাম্প্রদায়িকতা নিপাত যাক, মানবতা মুক্তি পাক।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্টসাম্প্রদায়িকতার শিকড় সন্ধান ও আমাদের ভাবনা