শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে মন্ত্রণালয়

19

সবুর শুভ

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে এবারের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে মারাত্মক অসঙ্গতি ও হ-য-ব-র-ল অবস্থার জন্য দায়ীদের খুঁজে বের করতে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। নির্দিষ্ট একটি সময় সিসি ক্যামেরা বন্ধ পাওয়ার মতো তথ্যও আছে প্রতিবেদনে। দীর্ঘ তদন্তের পর জমা পড়া এই প্রতিবেদনে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশের বিষয়টিও উল্লেখ করার মতো।
এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা হওয়া তদন্ত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে বোর্ডের সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট কিবরিয়া মাসুদ খানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রণালয়। গত ১৫ মার্চ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) খালেদা আখতার স¦াক্ষরিত এক চিঠিতে কিবরিয়া মাসুদ খানের বিরুদ্ধে কার্যক্রম গ্রহণের বিষয়টিও মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার জন্য বলা হয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের তরফে বিভাগীয় কার্যক্রম গ্রহণের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে বলে বোর্ড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
অন্যদিকে একই তদন্তে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথের অনিয়মের কথা উঠে আসলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা আবার তার কাছ থেকে ব্যাখ্যা চেয়েছে। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আলমগীর হুছাইন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে ৩১ মার্চ এ ব্যাখ্যা চাওয়া হলেও কতদিনের মধ্যে জবাব দিতে হবে এ ধরনের কোনো সময় নির্ধারিত নেই। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মাঝে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিবরিয়া মাসুদ খানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনার ১৫ দিন পর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথের কাছ থেকে ব্যাখ্যা চাওয়া হল কেন?
প্রসঙ্গত: গত ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল। ওই দিন দুপুরে ফল প্রকাশের পর চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটে পরীক্ষার্থীদের প্রাপ্ত নম্বর প্রদর্শনে নানা অসঙ্গতি দেখা দেয়। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়ে এমন হ-য-ব-র-ল অবস্থায় প্রশ্নের মুখে পড়েছে বোর্ডের ভাবমূর্তিও। ফল প্রকাশের পরদিন (১৪ ফেব্রুয়ারি) থানায় জিডির পাশাপাশি এ ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে শিক্ষা বোর্ড। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথের কাছে ব্যাখ্যা তলব করে শিক্ষা বোর্ড। চেয়ারম্যানের রুটিন দায়িত্বে থাকা শিক্ষা বোর্ডের সচিব প্রফেসর আবদুল আলীমের স্বাক্ষরে গত ১৫ ফেব্রæয়ারি এ সংক্রান্ত চিঠি ইস্যু করা হয়। পত্র প্রাপ্তির তিন কর্মদিবসের মধ্যে এ সংক্রান্ত ব্যাখ্যা দিতে বলা হয় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে।
প্রসঙ্গক্রমে, পরীক্ষা গ্রহণ, পরিচালনা, ফলাফল তৈরি ও প্রকাশের দায়িত্ব শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা শাখার। আর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এ শাখার প্রধান। এইচএসসির ফলাফলে নানা অসঙ্গতি ও হ-য-ব-র-ল অবস্থার কারণে শিক্ষা বোর্ড যে ভাবমূর্তির সংকটে পড়েছে সেটি এই পরীক্ষা শাখার কারণেই। এমনটিই বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এর আগেও ২০২০ সালের অটোপাসের জেএসসিতে বড় ধরনের অনিয়মের খবর বেরিয়ে এসেছিল। ফল প্রকাশের ৯ মাস পর নতুন করে রেজিস্ট্রেশন ও রোল নম্বর জেনারেট করে ৩৪ জন শিক্ষার্থীকে জেএসসি পাসের তালিকায় যুক্ত করা হয়। বোর্ডের পরীক্ষা শাখা ও বিদ্যালয় শাখার সরাসরি সম্পৃক্ততায় ওই অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে বলেও খবর পাওয়া যায়।
জানা গেছে, ২০২১ সালে তিনটি বিষয়ে পরীক্ষায় বসতে হয়েছে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের। গ্রæপভিত্তিক যে তিনটি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয়েছে, এর প্রতিটিতে দুটি করে পত্র রয়েছে। প্রতিপত্রে একশ করে দুটি পত্র মিলে একটি বিষয়ে মোট নম্বর (মার্কস) ২০০। অর্থাৎ একটি বিষয়ে ২০০ নম্বরের মধ্য থেকেই শিক্ষার্থীদের নম্বর দেয়া হয়। কিন্তু মোট নম্বর ২০০ হলেও দুইপত্র মিলে একটি বিষয়ে দুইশ’র বেশি নম্বরও পেয়েছে একাধিক শিক্ষার্থী। এক বিষয়ে ২১৮ নম্বর পাওয়া একাধিক শিক্ষার্থীর নম্বর ফর্দ তদন্ত কমিটির নজরে আসে। এছাড়া দুপুরে ফল প্রকাশের পরপর ওয়েবসাইটে পাওয়া নম্বর ফর্দে প্রাপ্ত নম্বর সন্ধ্যা গড়াতেই পাল্টে গেছে।
এদিকে পটিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, চবির শিক্ষক এ এইচ এম সাজেদুল হক ও শিক্ষা বোর্ডের সহকারী সচিব সম্পাতা তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের শেষ অংশে রয়েছে, ফলাফল প্রকাশের আগে ১১ ফেব্রæয়ারি বিকাল ৫টা থেকে রাত ১০টা ১০ মিনিট পর্যন্ত ফলাফল প্রসেসিং রুমের কম্পিউটার এর টেবুলেশন অনিরাপদ রাখায় ফলাফল তৈরিতে সন্দেহ সৃষ্টি করে। যা অনাকাক্সিক্ষত। ফলাফল সংশোধনের বিষয়টি বোর্ডের নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটিয়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং আইটি টিমের সদস্যরা নিজেরাই সংশোধনের কাজ করতে গিয়ে দু’ধরনের নম্বরফর্দ প্রাপ্ত হয়। এতে বোর্ড সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়। পরীক্ষার ফলাফল সংক্রান্ত সকল দায়-দায়িত্ব পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের উপরই বর্তায় বলে তদন্ত প্রতিবেদনের উপসংহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল আলীম জানান, পুরো বিষয়টির জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ ছিল মন্ত্রণালয়ে জমা পড়া এ সংক্রান্তে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে। তাছাড়া মন্ত্রণালয় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্টের ব্যাপারে পৃথক নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা সেগুলো ফলো করছি।