শর্তসাপেক্ষে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে মিয়ানমার রাজি

38

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক চীন সফরের সময় অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং এবং চীনের প্রধানমন্ত্রীর সাথে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছিলেন। তাঁরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দৃঢ়ভাবে এ সমস্যা সমাধানে তাঁদের আন্তরিক প্রচেষ্টার আশ্বাস দিয়েছিলেন। সম্ভবত: সে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৮ জুলাই মিয়ানমারের পর-রাষ্ট্র সচিব মিল্ট থোয়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল উখিয়ার কুতুপালং-রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা নেতাদের সাথে বৈঠক করেন। রোহিঙ্গা নেতারা পরিষ্কার ভাষায় মিয়ানমার পর-রাষ্ট্র সচিবকে জানিয়ে দেন যে তারা নাগরিকত্ব ছাড়া মিয়ানমারে কোন অবস্থাতেই ফিরে যাবেনা।
মিয়ানমারের পর-রাষ্ট্র সচিব উক্ত বৈঠকে শর্তসাপেক্ষে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে মিয়ানমারও রাজি বলে জানিয়েছেন। এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিতে মিয়ানমারও রাজি বলে জানিয়েছেন। এই ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য জটিলতা দূর করতে নিয়মিত বৈঠক অব্যাহত রাখার গুরুত্বের কথা মিয়ানমারের পর-রাষ্ট্র সচিব বলেন। মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব এরপর আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা এবং বাংলাদেশের পর-রাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সাথে অনুরূপ বৈঠকে বসেন। সবচাইতে লক্ষণীয় বিষয় ছিল মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের সাথে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক জোট আসিয়ানেরও একটি প্রতিনিধি দল রাখা হয়েছে। এতে বুঝা যায় এবার মিয়ানমারের ডেলিগেশন যেভাবেই হোক, গুরুত্ব সহকারে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করতে হবে বলে বুঝতে পেরেছেন বলে মনে হয়।
১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে মিয়ানমার স্বাধীনতা লাভের পর ঘোষণা করা হয়েছিল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমারের নাগরিক হিসাবেই বসবাস করবে। কিন্তু স্বাধীনতার পর দেখা গেল মিয়ানমার সরকার এবং সেনাবাহিনী একটির পর একটি মৌলিক নাগরিক অধিকার থেকে রোহিঙ্গাদের বঞ্চিত করা শুরু করে। শেষ পর্যন্ত ১৯৮২ সালে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করে যে আইন পাশ করা হয়েছিল তার মিয়ানমারের সেনা-শাসকেরা বাতিল করে দেয়। এরপর থেকে দফায় দফায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে চিরতরে তাড়াতে আরম্ভ করে। রোহিঙ্গাদের চিরতরে মিয়ানমার থেকে তাড়ানোর জন্য যেসব গর্হিত এবং মানবতাবিরোধী পন্থা অবলম্বন করে তার মধ্যে ছিল ১. হত্যা ২. গণহত্যা ৩. গণধর্ষণ ৪. রোহিঙ্গাদের বসতবাড়িতে আগুন দেয়া ছিল অন্যতম। এমন কোন বর্বর, অসভ্য, অমানবিক আচরণ তারা বাকী রাখে নাই যা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয় নাই। এই বর্বর অত্যাচারের ফলে বর্তমানে রাখাইনে মাত্র ৪ থেকে ৫ লাখ রোহিঙ্গা বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়ে আছে। অথচ ২০১২ সালেও রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখের মত ছিল।
মিয়ানমারে জাতিসংঘের বিশেষ সংযোগকারী ইয়াংগি লি মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচারের এক লোমহর্ষক বর্ণনা তুলে ধরেন। যার ফলে ২০১৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত পায় ৮ লক্ষের মত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের এ কাজের জন্য নিন্দা করে নাই এমন কোন দেশ নেই। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বেশ কয়েকবার বৈঠক হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্য দেশের প্রতিনিধিরা এক সাথে বাংলাদেশে এসে রোহিঙ্গা শিবিরও পরিদর্শন করেছেন। সাধারণ পরিষদেও এই নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই পর্যন্ত বাংলাদেশ একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে পাঠাতে সক্ষম হয় নাই। এই দন্তহীন জাতিসংঘ দিয়ে বিশ্বে শান্তি কায়েম করা কি সম্ভব হবে?
যুক্তরাষ্ট্র কিছুদিন আগে মিয়ানমার সেনাবাহিনী প্রধান সহ বেশ কয়েকজন মিলিটারী অফিসারের উপর যুক্তরাষ্ট্রের ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্র এদের কোন সম্পদ থাকলে তাও বাজেয়াপ্ত করার আদেশ জারি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পর-রাষ্ট্র সেক্রেটারী মাইক পম্পিও নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন।
মিয়ানমারের দশকের পর দশক ধরে সেনা শাসন চলছে। গত নির্বাচনে সুচির দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্তে¡ও প্রশাসনের মূল দফতরগুলি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রেখে সুচিকেও তাঁর দলকে গুরুত্বহীন সরকারি দফতরগুলি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিপুল ভোটে সুচির দল নির্বাচনে জয় লাভ করলেও তাঁকে প্রকৃত ক্ষমতার বাইরের রাখার জন্য শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করা হয়েছে। পরিবর্তিত শাসনতন্ত্রে বলা হয়েছে কারও স্বামী বা স্ত্রী যদি বিদেশি হয় এবং তাঁর সন্তান যদি বিদেশে জন্মগ্রহণ করে তাহলে উনি মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। এই সব কূটকৌশল প্রয়োগ করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সুচিসহ সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিগণকে যৎসামান্য ক্ষমতার ভাগ দিলেও মূল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে রেখেছে।
বর্তমানে সুচির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রসি (এন.এল.ডি) সেনা বাহিনীর ক্ষমতা হ্রাস করে সত্যিকারের গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য এক গণআন্দোলন শুরু করেছে। বর্তমানে মিয়ানমারে ২০০৮ সালের শাসনতন্ত্র সংশোধন করে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা হ্রাস করার দাবিতে তুমুল গণআন্দোলন চলছে। দেশি বিদেশি প্রচন্ড চাপের মুখে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে অস্বীকার করে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা আঁকড়িয়ে থাকার সময় শেষ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক সভায় আমেরিকার পর-রাষ্ট্র সেক্রেটারী মাইক পম্পিও তাঁর পূর্বসূরি রেক্স টিলারসন মিয়ানমারের উপর ২০১৭ সালে দেওয়া তাঁর একটি রিপোর্ট পড়ে শুনান। যে রিপোর্টে টিলারসন বলেছেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনে যে হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে তা জাতিগত হত্যা এবং গণহত্যা যার শাস্তি অবশ্যই মিয়ানমারের সেনাবাহিনীতে পেতেই হবে। এর থেকে তাদের বাঁচার কোন উপায় নেই। সেই রিপোর্ট আমেরিকার ষ্টেট ডিপার্টমেন্ট লিখেছে-ঝঃধঃব ফবঢ়ধৎঃসবহঃ ফবংপৎরনবফ ঃযব ারড়ষবহপব ধমধরহংঃ জড়যরহমুধ ধং “বীঃৎবসব” ষধৎমব ংপধষব রিফব-ংঢ়ৎবধফ ধহফ ংববসরহমষু মবধৎবফ ঃড়ধিৎফ নড়ঃয ঃবৎৎড়ৎরুরহম ঃযব ঢ়ড়ঢ়ঁষধঃরড়হ ধহফ ফৎরারহম ড়ঁঃ ঃযব জড়যরহমুধ ৎবংরফবহঃং.” অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ষ্টেট ডির্পাটমেন্টের বর্ণনানুযায়ী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এই ভয়াবহ আক্রমণ ছিল ভিত সন্ত্রস্ত করে রোহিঙ্গা অধিবাসীদেরকে বের করে দেওয়া।
সম্প্রতি বাংলাদেশ চীনের রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বিদায়ী সাক্ষাতে বলেছেন, “ডব ধিহঃ বীবপঁঃরড়হ ড়ভ ঃযব ফবধষ ংরমহবফ নবঃবিবহ ইধহমষধফবংয ধহফ গুধহসধৎ ড়হ ঃযব ৎবঢ়ধঃৎরধঃরড়হ ড়ভ ঃযব জড়যরহমুধং.” অর্থাৎ আমরা বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা প্রত্যার্বনের ব্যাপারে যে চুক্তি হয়েছে তার বাস্তবায়ন চাই।
সম্প্রতি চীন সফরের সময় বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া চীনের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর রোহিঙ্গা সমস্যা সামাধানের জোর প্রচেষ্টার আশ্বাস এবং চীনা রাষ্ট্রদূতের বিদায়ী বার্তায় এই ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট আশ্বাস, যুক্তরাষ্ট্রের রোহিঙ্গা ইস্যুতে সুর্নিদিষ্ট আগ্রহ। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে মহান স্রষ্টা রোহিঙ্গাদের উপর রহমত নাজেল করতেও পারেন।

লেখক : কলামিস্ট