রোযা: তাক্ওয়া ও তায্কিয়াহ’র বাস্তব প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন

33

সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী

তাকওয়া আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো আল্লাহর ভয় বা খোদাভীরুতা। সকল প্রকার ক্ষতিকারক, কষ্টদায়ক ও শঙ্কা থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করা। আর শরীয়তের পরিভাষায় তাকওয়া হলো, আল্লাহর ভয়ে এবং আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্তুষ্টি ও মোহাব্বত লাভের আশায় নিষিদ্ধ কাজ পরিত্যাগ করা এবং নির্দেশিত কাজগুলো পালন করা। তাই হযরত ওমর ইবনু আব্দুল আযীয রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, আল্লাহ তাআলা যা কিছু হারাম করেছেন সেগুলো বর্জন করা এবং যা কিছু ফরয করেছেন সেগুলোকে পালন করার নামই তাকওয়া।
তাই বিশুদ্ধ নিয়ত, নির্মল চরিত্র, পরিশুদ্ধ অন্তর, নির্ভেজাল কর্ম, নৈতিকতা, ন্যায়পরায়ণতা, মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক দায়বদ্ধতার নাম হল তাকওয়া। আর এই তাকওয়া অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হলো রোযা। কেননা রোযা মানুষকে পাপ কাজ থেকে দূরে রাখে এবং সৎ কাজে অনুপ্রেরণা যোগায়।
আর তাযকিয়া শব্দটিও আরবী। এর অর্থ হল, আত্মশুদ্ধি বা অন্তরকে পরিচ্ছন্ন, নির্মল ও পবিত্র করা। তথা অন্তর ও বাহিরকে সকল প্রকার চারিত্রিক ও আত্মিক রোগব্যাধি থেকে পবিত্র করার মাধ্যমে অন্তরকে পরিচ্ছন্ন রাখা এবং বাহিরকে পরিশুদ্ধ আমল দ্বারা সুসজ্জিত ও পরিমার্জিত রাখা। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, সেই ব্যক্তি সফল যে তার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেছে এবং সেই ব্যক্তিই ব্যর্থ যে তার আত্মাকে কলুষিত করেছে। (সূরা শামস: ৯-১০)
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তোমাদের চেহারা ও সম্পদের দিকে দৃষ্টি দেন না বরং তিনি দৃষ্টি দেন তোমাদের অন্তরের প্রতি এবং আমলের প্রতি। (মুসলিম-২৫৬৪)
আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার অর্থ হল, একে সব ধরনের পাপাচার ও কলুষতা থেকে মুক্ত করা। পাপচিন্তা, পাপ-ইচ্ছা ও পাপাচারী মানসিকতা থেকে রক্ষা করা। প্রবৃত্তি ও রিপুশক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। মনের সকল চাহিদা ও ইচ্ছাকে বিবেকের অনুগামী করা। এরপর বিবেককে আল্লাহ তাআলার হুকুম ও বিধানের অনুগত করা।
আর আত্মাকে বিনষ্ট করার অর্থ হল, বিভিন্ন প্রকারের গোনাহ ও মন্দকাজে লিপ্ত হয়ে নিজের চিন্তা, কর্ম ও মন-মানসিকতাকে পাপাচ্ছন্ন করে ফেলা। মনের সকল ইচ্ছা ও চাহিদাকে অনুসরণ করে প্রবৃত্তি-রিপুকে শক্তিশালী করা এবং আকল ও বিবেককে রিপুর অনুগামী করা। এভাবে আল্লাহর হুকুম ও বিধান থেকে সরে গিয়ে নিজের কামনা ও বাসনার অনুগত হওয়া।
মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধা ও কলুষতার উপর নির্ভর করেই সম্পাদিত হয় তার কাজ-কর্ম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘জেনে রাখ, নিশ্চয় দেহে একটি পিÐ আছে। সেটি যখন ঠিক হয়ে যায়, পুরো দেহ ঠিক হয়ে যায়। আর যখন সেটি নষ্ট হয়ে যায়, পুরো দেহই নষ্ট হয়ে যায়। জেনে রাখ, সেই পিÐটি হল ক্বলব। (বুখারী-৫২)
পক্ষান্তরে গুনাহ ও পাপাচারের কারণে আত্মা কলুষিত হয়ে যায়। ফলে মানুষ ভাল-মন্দ পার্থক্য করার শক্তি হারিয়ে ফেলে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘বান্দা যখন কোনো গোনাহ করে তখন তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে যায়। এরপর যখন সে গোনাহ থেকে নিবৃত্ত হয়, ক্ষমা চায় এবং তাওবা করে তখন তার অন্তর পরিষ্কার করে দেওয়া হয়। নতুবা পুনরায় গোনাহ করতে থাকলে সেই কালো দাগ আরও বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে পুরো অন্তরকে (কালো দাগে) ছেয়ে বসে। সেটাকেই আল্লাহ তাআলা মরিচা বলে উল্লেখ করে এরশাদ করেন, ‘ বরং তাদের কৃতকর্ম তাদের অন্তরে মরিচা ধরিয়ে দিয়েছে। [মুতাফফিফীন: ১৪] (তিরমিযী-৩৩৩৪)
আর এই তাক্ওয়া ও তাযকিয়ার অর্জনের জন্য প্রয়োজন যথাযথ প্রশিক্ষণ, অনুশীলন ও চর্চা। কারণ প্রশিক্ষণ হচ্ছে একটি পরিকল্পিত কার্যক্রম। প্রশিক্ষণ গ্রহণের ফলে প্রশিক্ষণার্থীদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন হয়। মানুষের জীবনের সততা, মহানুভবতা, উদারতা, ন্যায় পরায়ণতা, সভ্যতা, সাধুতা, অখÐতা, একত্রতা, পূর্ণতা সর্বোপরি স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, চরিত্র, মহত্ত ও আদর্শিক গুণাবলির সংমিশ্রিত আত্মশুদ্ধির স্বর্ণফসল হলো আখলাক। জীবনচেতনার প্রথম সূর্যসিঁড়ি, যা মানুষের জীবনে স্বচ্ছতার দিগন্তবিস্তারী প্রভাব বিস্তার করে। ফলে মানুষের মধ্যে বিবেক ও মূল্যবোধের জাগরণ সৃষ্টি হয়।
তাক্ওয়া ও তাযকিয়া অর্জনের অন্যতম মাধ্যম রোযা। আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেনঃ হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে যেমনি ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা তাক্বওয়া লাভ করতে পার। [সূরা আল-বাকারাহ-১৮৩]
রোযা মানুষের মধ্যে শিষ্টাচার, ধীরস্থিরতা, প্রশান্তি, ক্ষমা, মুর্খদের থেকে বিমুখতা ইত্যাদির প্রতিফলন ঘটায়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেনঃ তোমাদের কারো রোযার দিন যদি হয়, তাহলে সে যেন অশ্লীল কথাবার্তা না বলে, হৈ চৈ অস্থিরতা না করে, যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে লড়াই করে সে যেন বলে আমি রোযাদার। (বুখারী-১৯০৪ ও মুসলিম-১১৫১)
তাই শুধুমাত্র পানাহার ত্যাগের নাম রোযা নয়; বরং সকল প্রকার নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকার নাম হলো রোযা। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন: “যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও অনুরূপ কাজ পরিহার করল না, তার খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত থাকার মধ্যে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। [ বুখারী-৫৭১০)
তিনি আরও এরশাদ করেন: “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি রোযা রাখে সে যেন কোনো রকম অশ্লীলতা ও হৈ-হুল্লোড় না করে। কেউ যদি তাকে গালাগাল দেয় বা তার সাথে ঝগড়া করে সে যেন বলে আমি রোযাদার’ (বুখারি-১৮৯৪ ও মুসলিম-১১৫১)
তিনি আরও এরশাদ করেন, (রোযাদারগণের পক্ষে) রোযা হচ্ছে ঢালস্বরূপ। সুতরাং তোমাদের মধ্যে কেউই রোযা অবস্থায় নির্লজ্জ কথা বলবে না এবং বাজে বকবে না। যদি কেউ রোযাদারকে গালি দেয় অথবা তার সাথে লড়াই করতে আসে, তবে সে যেন বলে দেয় যে, আমি রোযাদার। (বুখারি-১৭৬১, মুসলিম-১৯৪৬)
তিনি সাবধান করে এরশাদ করেন, ‘বহু রোযাদার এমনও রয়েছে, যে ক্ষুধায়-পিপাসায় কষ্ট পাওয়া ব্যতীত তাদের রোযা রাখায় আর কোন ফল নেই। এমনিভাবে বহু রাতজাগা নামাযী রয়েছে, যাদের রাত জাগরণ ব্যতীত অন্য কোন লাভ হয় না।’
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন এরশাদ করেন, যে রোযাদারের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আমার নিষিদ্ধ বস্তুসমূহ হতে বিরত থাকল না, তার শুধু পানাহার হতে বিরত থাকায় কোন লাভ নেই।’ (ইবনু মাযা-১৬৯০, নাসায়ী- ৩২৫০, আহমদ-২/৪৪১)
প্রকৃতপক্ষে পবিত্র মাহে রমযান মুসলমানদের জন্য একটি বার্ষিক প্রশিক্ষণ কোর্স, যার মাধ্যমে রোযাদারদের জীবন প্রভাবিত হয়। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি পবিত্র রমযান মাস ভালোভাবে যাপন করবে, তার সমগ্র বৎসর ভালোভাবে যাপিত হবে।”(হিলয়া-৭/১৪০)।
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেনঃ এটা হল ধৈর্যের মাস। আর ধৈর্য অবলম্বনের প্রতিদান হচ্ছে বেহেশ্ত। এটা পরোপকার ও সহানুভূতির মাস এবং এটা এমন একটি মাস যাতে ঈমানদারগণের রুযী বৃদ্ধি করা হয়ে থাকে। এ মাসে যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করায়, তার বিনিময়ে তার সমস্ত গুণাহ মাফ হয়ে যায় এবং সে জাহান্নাম হতে মুক্ত হয়।(বায়হাক্বী-৩৯, ইবনু খোযাইমা-১৮৮৭)
মুমিনের অন্তর যখন পরিশুদ্ধ ও আলোকিত হয় এবং নিজ আখলাক-চরিত্র সংশোধন হয়, তখন তার জন্য আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জন সহজ হয়ে যায়। আর যে মুমিন আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূলের সন্তুষ্টি পায়, সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতর মানুষে রূপান্তরিত হয় তার প্রমাণ সাহাবায়ে কেরাম। তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রেরণের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, তাযকিয়া বা আত্মশদ্ধি। পবিত্র কুরআনে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দায়িত্বের বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তাআলাই নিরক্ষরদের মাঝে তাদেরই স্বগোত্রীয় একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন। তিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তাঁর আয়াতসমূহ, পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করেন তাদের আত্মাকে এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত।’ [জুমুআ: ২]
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাকওয়া ও তাযকিয়ার মাধ্যমে আমাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহ ও তাঁর হাবীবের সন্তুষ্টি অর্জন করে দুনিয়াতে সফলতা ও পরকালে মুক্তির তাওফিক দান করুক, আ-মী-ন।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ