রেকর্ড ভেঙে বর্ষার বিলম্বিত বিদায়

91

‘রেকর্ডের খেলা’ হিসেবেই সমাদৃত হতে যাওয়া ক্রিকেটের চরিত্রকেই যেন অনুসরণ করছে আবহাওয়া। বছর পরিক্রমায় তো বটেই, এমনকি ঋতুচক্রের প্রতিটি মৌসুমেও ক্রিকেটের মত বিভিন্ন দিক থেকে রেকর্ড ভাঙা-গড়ায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে প্রকৃতি। মধ্যপ্রাচ্যের কুয়েতে পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ডের ক’মাস পার না হতেই দেশে বর্ষা মৌসুমের বিলম্বিত বিদায়ও গত প্রায় ছয় দশকের রেকর্ড ভেঙেছে।
আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি নিজের বৈশিষ্ট্য ও আচরণে বর্ষপঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডারে ছাপানো মাসভিত্তিক ঋতু বা কালের হিসাব মেনে চলাকে শিকেয় তুলে রেখেছে সেই কবে। মৌসুমের হিসাবেও সময়ের চেয়ে অসময়ের চর্চাই বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই বলে দু’মাস বয়সী আস্ত একটা ঋতুই হাওয়া হয়ে যাওয়া নিশ্চয় বড় ধরণের ব্যতিক্রম। ‘তালপাকা’ ভাদ্র পেরিয়ে আশ্বিনেরও বিদায়ঘণ্টা বাজতে চলেছে। অথচ, দেশের ওপর এখনও কি-না সক্রিয় রয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু অর্থাৎ বর্ষা। তার প্রভাবে আশ্বিনের শেষেও সাদা মেঘের ভেলার বদলে কৃষ্ণমেঘে ঢেকে দিচ্ছে শরতের নীলাকাশ। হঠাৎ গগণবিদারী বজ্রপাতকে সঙ্গী করে নেমে আসছে বৃষ্টিধারা। আস্ত শরতই হাওয়া হয়ে গেল রেকর্ড ভাঙা বিলম্বিত বর্ষার পেটে। তবে, আজ শনিবার থেকে মন্থরগতিতে হলেও মৌসুমি বায়ুর পাততাড়ি গোটানোর পালা- এমনটাই জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক গতকাল শুক্রবার পূর্বদেশকে বলেন, ‘মৌসুমি বায়ুর বিদায়বেলার বৃষ্টিপাত রবিবার থেকে অনেকটাই কমে যাবে। শনিবার দিনশেষে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে বিদায়ের প্রক্রিয়া শুরু হবে মৌসুমী বায়ুর। তবে, তার প্রস্থানও হবে প্রবেশের মতই। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু হয়ে মধ্যাঞ্চল পেরিয়ে সবশেষে দক্ষিণাঞ্চল থেকে বিদায় নেবে মৌসুমি বায়ু।’
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান তুলে ধরে কর্মকর্তারা জানান, এবার কিছুটা দেরিতে চেনারূপে ধরা দেয়া বর্ষা মৌসুম পূর্ববর্তী সমস্ত রেকর্ড ভেঙে সবচেয়ে দেরিতে বিদায় নিতে যাচ্ছে। গত ৫৮ বছরে এত দেরিতে মৌসুমি বায়ুর প্রস্থান ঘটেনি। তবে মৌসুমি বায়ুর দেরিতে প্রস্থান এটাই প্রথমবার নয়। গত আট বছরে অন্তত চারবার নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দেরিতে প্রস্থান ঘটেছে মৌসুমি বায়ুর। যার ফলে মৌসুমি বায়ুর স্বাভাবিক গতিবিধি নিয়েও ভাবনার অবকাশ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা। আগে মে মাসের শেষের দিকে বঙ্গোপসাগর থেকে টেকনাফ উপকূল দিয়ে দেশে প্রবেশ করত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু। তাতেই যাত্রা শুরু করত দেশের সবচেয়ে বড় বর্ষা ঋতু। বাদল ধারার এই ঋতু বিদায় ঘটত সেপ্টেম্বরের শেষে এসে। এখন বর্ষা শুরু হতেই জুনের মাঝামাঝি সময় লেগে যাচ্ছে। মৌসুম শেষ হচ্ছে অক্টোবরে এসে। এবার জুনের প্রথম সপ্তাহেই মৌসুমি বায়ু টেকনাফ উপকূল দিয়ে দেশে প্রবেশ করলেও বর্ষার বিরামহীন বৃষ্টি শুরু হয়েছিল একটু দেরিতে। ২০ জুন চট্টগ্রামসহ সারাদেশে বর্ষা সক্রিয় হয়।
এর আগে গত পয়লা অক্টোবর আবহাওয়া অধিদপ্তরের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞ কমিটির বৈঠক শেষে অক্টোবর মাসের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে বলা হয়, অক্টোবর মাসের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেবে। এর মধ্য দিয়েই বিদায় নেবে অসময়ের বর্ষাও। মাসজুড়ে দেশে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হতে পারে। অক্টোবরে বঙ্গোপসাগরে এক থেকে দু’টি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে। যার মধ্যে একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। ওই ঘূর্ণিঝড়ের কাঁধে সওয়ার হয়ে দেশে শীতকালের যাত্রা শুরুর আভাসও দেয়া হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি) গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে পরবর্তী চব্বিশ ঘন্টার প্রচারিত আবহাওয়ার দৃশ্যপটে বলা হয়েছে, লঘুচাপের বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর কম সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে দূর্বল থেকে মাঝারি অবস্থায় বিরাজ করছে। আগামী চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বিদায় নেয়ার অনুকূল পরিবেশ রয়েছে। পরবর্তী ৪৮ ঘন্টার আবহাওয়ার অবস্থায় দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট বিভাগের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরণের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী বর্ষণ হতে পারে। এছাড়া, দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানতঃ শুষ্ক থাকতে পারে। সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে। শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী চব্বিশ ঘন্টায় দেশের সর্বোচ্চ ৯২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে সাগরকন্যা কক্সবাজারে।