রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ও সমাজতত্ত্ব

56

[This is the social being which determines the social consciousness. – Karl Marx. সামাজিক কাঠামোই সামাজিক চেতনা নির্ধারণ করে।এই প্রেমিসকে ভিত্তি ধরে, সামাজিক ঘটনা সমূহের ব্যাখ্যায় সামাজিক কনটেক্সট ধর্তব্যে নেয়া হয়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতির উৎস সন্ধানে সমাজতত্তে¡র এই দৃষ্টিভঙ্গী যথার্থ বলেই বিবেচিত হয়।]
অতীত বর্তমানকে তৈরি করে আর বর্তমান ভবিষ্যতকে। বর্তমান সমাজ, অর্থনীতি আর রাজনীতিকে বোঝার জন্য অতীতের সমাজ ব্যবস্থা জানা দরকার,আর ভবিষ্যত নির্মাণের জন্য বর্তমানকে বোঝা দরকার মনে রাখা ভালো যে, সামাজিক ঘটনাবলী যা অতীতে ঘটেছে তা অনেকটা ইচ্ছা নিরপেক্ষ বিষয়। তবে তা মানুষের কর্মকান্ডের ফল আবার এর ফলে পরিবর্তিত সমাজ আর অর্থনীতিও মানুষের কর্মকান্ডকে নির্ধারণ করে। সমাজের সমস্ত ঘটনা, মানুষের কাজ-কর্মের ফল। মানুষে-মানুষে সম্পর্কই হলো সমাজ। সম্পর্কটা কি? ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক, সামাজিকভাবে স্তরায়িত মানুষের সম্পর্ক, শ্রেণী সম্পর্ক, বর্ণে বিভক্ত মানুষের সম্পর্ক, ধর্মে, বিশ্বাসে বিভক্ত মানুষের সম্পর্ক। এই সম্পর্কগুলো গড়ে ওঠে মানুষ ,উৎপাদক বলে। মানুষ উৎপাদক বলেই গড়ে তুলেছে পরিবার,রাষ্ট্র এবং নর্ম, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, ধর্ম ইত্যাদি যা মানুষের আচরণ নির্ধারণের মাধ্যমে একটি শৃঙ্খলার সমাজ গড়ে তোলে। সুতরাং আমরা যখন সামাজিক পরিবর্তনের কথা বলি, বলি সংস্কৃতি ও অর্থনীতি পরিবর্তনের কথা, তখন মূলত সামাজিক পরিবর্তনের সাথে, মানব আচরণ নিয়ন্ত্রণের অন্যান্য উপায়গুলো পরিবর্তনের কথাই বলি।সব ব্যক্তিই সামাজিক ঘটনা প্রবাহের অংশ, কেননা সামাজিক ঘটনা, শুধুমাত্র ব্যক্তি নয়, সামষ্টিক আচরণ ও মিথস্ক্রিয়ার ফল। প্রতি ব্যক্তিই পরিবারের সদস্য হিসেবে, পিতা, ভাই, চাচা ইত্যাদি পরিচিতি পেয়ে থাকেন। সামাজিক সদস্য হিসেবে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, উকিল ইত্যাদি পরিচিতি পেয়ে থাকেন। কিন্তু এই পরিচিতির সাথে, সমাজের প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি পরিচয়ের সাথে, কিছু দায়িত্ব পালনের কথাও বলে। যেমন শিক্ষক যিনি, তাঁকে ছাত্রদের পড়াতে হবে, তাঁদের করতে হবে মূল্যায়ন। পিতা হলে, সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে হবে। যিনি রাষ্ট্রনায়ক তাঁকে সমাজের স্থিতির জন্য, ভেদনীতি নয়, নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ করবার উদ্যোগ নিতে হবে। এতে সমাজের থাকে শৃঙ্খলা ও শান্তিপূর্ণ অবস্থা,যা সামাজিক অগ্রগতি অর্জনের প্রধানতম শর্ত। তো সমাজ টিকে থাকবার কারণ,মানুষের সংঘবদ্ধ প্রয়াস।
মানুষের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় সমাজের সমস্ত ঘটনা ঘটে। কিন্তু সমস্ত ঘটনায়, মানুষের মধ্যে কিছু মানুষ আছেন যাঁদের প্রকৃতি তা প্রাকৃতিক বা সামাজিক যাই হোকনা কেনো, ঘটনা ঘটাবার সামর্থ্য অন্যদের চেয়ে বেশি। গাছ থেকে মাটিতে ফল পড়া সবাই দেখতে পায় কিন্তু এই ঘটনা যে মাধ্যাকর্ষণ এর জন্য ঘটে তা জানাতে পারে একজনই। ঐ একজনের প্রকৃতিকে জানবার ও পরিবর্তন করবার সামর্থ্য অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি। সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবর্তনগুলো প্রযুক্তি পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত। সুতরাং বিজ্ঞান ও উদ্ভাবন ও পরিবর্তন ছাড়া, সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব নয়। বিজ্ঞান প্রকৃতি জগতের নিয়ম উদঘাটন করে ও উদ্ঘাটিত নিয়মের প্রয়োগ করে, প্রকৃতি ও সামাজিক জগতকে পরিবর্তন করে। আর একাজ সংঘবদ্ধ ব্যক্তিদের মাঝে এগিয়ে থাকা ব্যক্তির ক্রিয়াই মুখ্য। সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক ঘটনাবলীর নিয়ন্ত্রণ বা সম্পর্ক বদলানোর কাজে কোন এগিয়ে থাকা ব্যক্তির ভূমিকা ছাড়া ইতিহাসের কোন আলোড়ন কখনোই হয়নি। সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় হাজারো বা লক্ষ লোকের অংশগ্রহণ থাকলেও, গোষ্ঠী আচরণ নিয়ন্ত্রণে এক বা একাধিক ব্যক্তির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ইতিহাস মানেই, শুধুমাত্র অতীত ঘটনা সমূহের কালপঞ্জি নয়, বরং পরিবর্তনের প্রকৃতি, সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণ সমূহ খুঁজে দেখা ও তা চিত্রিত করা। পঞ্চাশ বছর আগে, একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতির আবির্ভাব হয়েছে বিশ্ব মানচিত্রে, এটি কোন দৈব ঘটনা নয়। সামাজিক পরিবর্তনের গতিবিদ্যা, জনগণের মিথস্ক্রিয়া ও নেতৃত্তে¡র নেতৃত্ত¡ ও পরিশ্রম, এর পেছনের নিয়ন্ত্রক। ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধানে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যবহার ছাড়া প্রকৃত কারণ বোধে আসবেনা। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গী কি? একটু ব্যাখ্যা দেয়া যাক। আমাদের চারপাশের সমস্ত সামাজিক ঘটনার পেছনেই আছে, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কারণ। এমনকি আছে ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক কারণও। তো কোন ঘটনার পেছনে যখন আমরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং এমনকি ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক কারণ খুঁজে বের করি ও ঘটনা ঘটাবার কারণ হিসেবে শনাক্ত করি, তখন এই ব্যাখ্যা হয়, সমাজতাত্তি¡ক। বলা হয়, এই দৃষ্টিভঙ্গী ৩৬০ ডিগ্রির দৃষ্টিকোণ বা ঐড়ষরংঃরপ বা সামগ্রীক। অতীতে আজকের বাংলাদেশ ছিলো ভারতবর্ষের অংশ। রাজা,বাদশাহ ছিলেন। ছিলো জনগোষ্ঠী। এঁদের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় ছিলো বিশেষ অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্যের ভারতবর্ষ। অর্থব্যবস্থার প্রধান নিয়ামক জমি।এতে ব্যক্তি মালিকানা ছিলো, অনুপস্থিত। জমি উৎপাদনের উপায়, এর মালিকানার অনুপস্থিতি এক বিশেষ সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার জন্ম দেয়। এই জমির মালিকানাকে কেন্দ্র করে সামাজিক বিভাজন হয়নি, যা ছিলো তা জমির খাজনা আদায়কে কেন্দ্র করে পেশাজীবীদের অস্তিত্ব। ফলে শ্রেণী বিভক্তিকে কেন্দ্র করে শ্রেণী সংগ্রাম ছিলো অনুপস্থিত, হয়নি বিকাশ আধুনিক অর্থে মধ্যবিত্তের। এর কারণ ছিলো স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমাজ। এই গ্রাম সমাজে পেশাগত স্তরায়ন ছিলো, ছিল কারিগরী পেশার মানুষদের অস্তিত্ব। উৎপাদন হতো ভোগের জন্য, বিনিময়ের জন্য নয়। ফলে, বাণিজ্য ও উৎপাদন ও মুনাফা কেন্দ্রিক কোন অর্থব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। রাষ্ট্র ছিলো, শ্রেণীর করায়ত্ত মুক্ত। ফলে পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি।
ইংরেজদের এই দেশকে সম্পূর্ণ ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় নিয়ে আসা ও শোষণ ও ইংল্যান্ডে সম্পদের স্থানান্তরের জন্য প্রয়োজন ছিলো সামাজিক-অর্থনৈতিক সংস্কারের। ইংরেজরা এই সংস্কার ছাড়া ঔপনিবেশিক শোষণেকে নিরঙ্কুশ করতে পারেনা ফলে ১৭৯৩ সালে প্রণয়ন করে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন’। এই আইনের ফলে পুঁজিবাদের বিকৃত চেহারার অর্থব্যবস্থার জন্ম হয়। জমির উপর মালিকানাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়,জমিদার শ্রেণীর সামাজিক ঘটনার পরম্পরায়, জমিদার শ্রেণীর বড় অংশই দেখা যায় হিন্দু সম্প্রদায়ের। মুসলমানদের বড় অংশ হয়, রায়ত। ঐ সময়ের বাংলায়, ভৌগলিক ভাবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, রায়তদের বেশিরভাগই ছিলেন মুসলমান সম্প্রদায়ের যাঁদের সংখ্যাধিক্যের বাস ছিলো অবিভক্ত বাংলার পূর্বাংশে সাম্প্রদায়িক ভেদ সৃষ্টির এই সামাজিক লক্ষণটা, ইংরেজরা ব্যবহার করলো, ঔপনিবেশিক স্বার্থে। এই ভেদের ভিতটাই ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের কারণ হয়, যদিও পরবর্তীকালে ১৯১১ সালে রদ করা হয় ভারত বর্ষের পশ্চিম সীমান্তের প্রদেশগুলো সংখ্যাধিক্যে মুসলমান বেশি হলেও, ধর্মীয় ভেদকে কেন্দ্র করে রাজনীতি ও অর্থনীতি বাংলার মত আকার নেয়নি। এর কারণ সমাজ ও অর্থনীতি। স¤প্রদায় কেন্দ্রিক দ্বিজাতি তত্তে¡র উদ্যোক্তা জিন্নাহ্ ও মুসলিম লীগ হলেও, তা বাংলার তৎকালীন সামাজিক কাঠামো এই বিভেদকে উসকে দেয়। রাজনীতি শুধু ভারতবর্ষকে নয়, বাংলাকে ও বিভক্ত করে। হাজার বছরের সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের বিভাজন এই জনপদের মানুষের মনোজগতে এক দগদগে ঘা এর সৃষ্টি করে, শুধু এজন্যে নয় যে, ভৌগলিক রাষ্ট্রীয় বিভক্তি, বরং এই বিভক্তির প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক সংকট। পাকিস্তানী শাসনকালে তা প্রকট হয়।
১৯৪৭ এর পরে পাকিস্তানের পূর্বাংশে যে নিপীড়ন মূলক শাসন চলতে থাকে তার অভিব্যক্তি ছিলো জাতীয় নিপীড়ন, শোষণ, সাংস্কৃতিক দলন, বৈষম্য ইত্যাদি। অর্থনৈতিক শোষণ বজায় রাখতে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ভাবাদর্শগত আবহ তৈরি করতে হয়। এই আবহ তৈরি করতেই বাংলা ভাষার উপর আঘাত করে পাকিস্তানি শাসকেরা ও পরে সংস্কৃতির উপর। সা¤প্রদায়িক ভেদকে উস্কে দিতে রবীন্দ্র বিরোধী অপপ্রচার চালায়। বাঙালি সংস্কৃতির মহৎ সব অর্জনকে সাম্প্রদায়িক ভেদ দিয়ে বিভক্ত করার চেষ্টা করা হয়। এমনকি কবি নজরুলকে ও বিভক্ত করার চেষ্টা করা হয়। ফলে এই জনপদে ভাষা আর সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে জাতিরাষ্ট্র গঠিত হলে, অতি অবশ্যই অসাম্প্রদায়িক চেতনার অংশ হতে হবে। আর এভাবেই অসাম্প্রদায়িকতা আমাদের জাতীয় চেতনার অংশ হয়। তবে তা আমাদের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সাথে সম্পর্কিত। আওয়ামী মুসলিম লীগকে, আওয়ামী লীগ নামকরণের মাধ্যমে ও পরে ধর্মনিরপেক্ষতাকে আদর্শ হিসেবে বিবেচনায় তা গতি পায়।
গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকে প্রাধান্য দিলেও, সংখ্যালঘুর চিন্তাকে অগ্রাহ্য করেনা। এই ধারণার উদ্ভব পুঁজিবাদের উত্থান ও পরিবর্তনের সহগামী। পুঁজিবাদের উত্থানের জন্য প্রয়োজন বাজার অর্থনীতির। এর অর্থ হলো, বাজারের শক্তিগুলোকে মুক্ত করা। উদ্যোক্তা ও ভোক্তা, এই দুই পক্ষের যদি বিনিয়োগে ও ভোগের স্বাধীনতা না থাকে তাহলে, বাজার অর্থনীতি বা পুঁজিবাদের প্রতিষ্ঠান হয়না। তবে অর্থনীতিতে গণতন্ত্র চাইলে, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানেও গণতন্ত্র দরকার। ফলে, পুঁজিবাদের উত্থানে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্র প্রয়োজন হলো। শিল্পায়ন, অথনৈতিক উন্নয়নের জন্য, রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের প্রয়োজন ছিলো। আর তাই পুঁজিবাদের সাথে গনতন্ত্র সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জন্ম নিলো।
ইংরেজরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে, ভারতবর্ষে পুঁজিবাদের ছিটেফোঁটা প্রতিষ্ঠা করলো। ভোগের অর্থনীতিকে বিনিময়ের অর্থনীতিক ব্যবস্থায় রূপান্তর করলো। তো রাজনৈতিক সংস্কারও করলো। ব্রিটিশ ধাঁচের পার্লামেন্টারী ব্যবস্থা করলো চালু। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সৃষ্টির মাধ্যমে দলপ্রথা চালু করলো। গণতন্ত্রের অনুষঙ্গী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও দেখা দিলো, ভারতীয় সমাজে। মনে রাখা দরকার, এসব কিছুই সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত বিষয়।
সাম্প্রদায়িক ভেদ ব্যবস্থা যা গণতন্ত্রের প্রতিপক্ষ, তা পাকিস্তানি শাসনে চললো হাত ধরাধরি করে। পাকিস্তানি শাসনে যেমন থাকলোনা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, চর্চাও হলোনা গণতন্ত্রের। দেখা গেলো সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর শাসন ও শোষণ। কোন জাতীর চেতনা ও বোধের প্রকাশের জায়গা হলো তার ভাষা ও সংস্কৃতি। হামলাটা প্রথমেই এখানে হলো। সংখ্যাগুরুর মতের প্রতি তোয়াক্কার অভাববোধ গণতন্ত্রহীনতার আবহ তৈরি করে। পাকিস্তানী শাসকেরা এই কারণে নয় বছরের আগে একটি সংবিধান ও রচনা করতে পারেনি। অভ‚্যত্থান, পাল্টা অভূ্যত্থান ও সামরিক শাসন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীদের উপর সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক নিপীড়ন তীব্র করে তুলে। শুধু পূর্বাংশে নয়, গণতন্ত্রহীনতা এক ইউনিট প্রবর্তনের নামে এমনকি বালুচ জাতিসত্ত্বার উপরে ও নিপীড়ন নেমে আসে। গণতন্ত্রহীনতা এমনকি ২৩ বছরের আগে একটি সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন ও করতে পারেনি। ১৯৭০ এর সার্বজনীন ভোটাধিকার, বাঙালি জাতির আবেগ ও অনুভূতির প্রকাশ ঘটালো, যা একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাসে মাইলস্টোন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রইলো। একটি নির্বাচন,একটি জাতীর আশা- আকাঙ্খার মূর্ত প্রতীক হিসেবে দেখা দিয়েছে একটি নির্বাচনের ভিত্তিতে। জনমত প্রতিফলনের এই উপায় না থাকলে থাকে নিপীড়ন, শোষণ, বঞ্চনা, সাম্প্রদায়িকতা সহ সমস্ত ভেদনীতি। পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসনে, বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও পেশা, ব্যবসা- বাণিজ্যে, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের কোথাও সংখ্যার অনুপাতের প্রভাব দেখা যায়নি। এসব কিছুই গণতন্ত্রহীনতার ফল। একমাত্র গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ যখন পেলো, তখনই নির্বাচনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্খা বাস্তবায়নের রায় দেয়। পাকিস্তানী শাসনের ২৩ বছরের আন্দোলন যেমন ছিলো জাতীয়তাবাদী চরিত্রের ঠিক তেমনি,গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠারর। পাকিস্তানী আমলে সমস্ত আন্দোলনের চরিত্রই ছিলো, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খা থেকে উৎসারীত। গণতন্ত্র তাই আমাদের জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রাণ হয়ে রইলো।
শুধু ভাষাকে কেন্দ্র করে জাতিরাষ্ট্র গঠিত হয়না তা সত্য তবে ভাষা সাংস্কৃতিক মন্ডল গঠনে এবং সমবৈশিষ্ট্য সম্পন্ন লোকসমাজ গঠনে ভূমিকা রাখে। মানুষের সাথে অন্যান্য প্রাণীদের পার্থক্য হলো, মানুষের ভাষা আছে। সে অর্থবহ শব্দ তৈরি করতে পারে। সমাজের মানুষের সম্পর্কের উপায় ও নিয়ন্ত্রক, নর্ম, মূল্যবোধ, আইন-কানুন, রীতি-নীতি, ধর্ম কিছুই থাকতোনা ভাষা না থাকলে। সৃষ্টি হতনা, পরিবার, প্রতিষ্ঠান, সংঘ ইত্যাদি। ভাষা হচ্ছে সমাজের শেকড়, মানুষের সামাজিক সম্পর্কের শেকল।
আর এর অবদমন থেকেই শুরু হয়, শোষণ, বঞ্চনা। পাকিস্তানিরা তাই করতে চাইলো। আমাদের স্বকীয়তা, স্বাজাত্যবোধ ওদের শোষণের প্রতিবন্ধক। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষার বিরুদ্ধাচরণ, গণতন্ত্রের বিরোধীতা, কোন সাংস্কৃতিক অস্তিত্বকে ধ্বংস করা বোঝায়। কোন জনসমাজ যেন, নিজ সাংস্কৃতিক বোধে দাঁড়াতে না পারে, সে জন্য ভাষাকে নির্মূল করে দিতে হয়। ইংরেজরা প্রথমে ভারতবর্ষে শোষণকে নিরঙ্কুশ করতে ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে কিন্তু ভারত থেকে ইংল্যান্ডে সম্পদ স্থানান্তরে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের প্রয়োজন আর এ কারণে ১৮৩৫ সালে ইংলিশ এডুকেশন এ্যাক্ট ১৮৩৫ প্রণয়ন করে। বাদামী বা কালো বর্ণের ভারতীয়দের মনোজগতে উপনিবেশ তথা মানসিকভাবে ইংরেজ করবার জন্য ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন প্রয়োজন ছিলো। স্বাধীন সত্ত্বার জন্য নিজ ভাষার চর্চার প্রয়োজনও নিজ ভাষার চর্চা না থাকলে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেনা। ভাষা আন্দোলন, সার্থক হওয়ায়,আমাদের ভাষাকে কেন্দ্র করে বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা হতে থাকে। পাকিস্তান সৃষ্ট হওয়ার পরে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে সৃষ্ট হিন্দু জমিদারদের একটা ভারতে স্থানান্তরের ফলে, বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তের বিকাশ হতে থাকে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, চিত্রশিল্প ইত্যাদি চর্চার বিকাশ ঘটতে থাকে। বাঙালি সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে, গড়ে উঠতে থাকে স্বাজাত্যবোধ মধ্যবিত্তের বিকাশে গড়ে উঠতে থাকে জাতীয়বোধ এবং পরে জাতীয়তাবাদ। এই আবহে জাতীয়বোধকে আরো শানিত করেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার ৬ দফা বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ হিসেবে বিবেচিত হয়। একে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতি ১৯৭০ এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এতে এই জনপদের জনগণের জাতীয়তাবোধের প্রকাশ পায়। ১৯৪৭ এর পরে ২৩ বছরে বিভিন্ন আন্দেলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ আমাদের স্বাধীনতার এক উৎস হয়ে দাঁড়ায়। মহান মুক্তিযুদ্ধের পরে তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদ হয়ে দাঁড়ায় আমাদের অস্তিত্বের উৎস।
আজ পর্যন্ত ইতিহাসে বর্ণিত সমাজগুলো ভেদ ও বঞ্চনার উপর প্রতিষ্ঠিত। এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন কালে বিভিন্ন আন্দোলন, সংগ্রামের অস্তিত্ব দেখা গেছে। শোষণ আর বঞ্চনার ধরন পাল্টেছে কিন্তু এর তিরোধান হয়নি। ইউরোপে সামন্ত ব্যবস্থার প্রায় সম্পূর্ণ কালই ছিলো-অন্ধকার যুগ। অন্ধবিশ্বাস আর কুপমন্ডুকতা নিয়ে ছিলো সামন্ত ব্যবস্থার শোষণ ও শাসন। পুঁজিবাদ ‘সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা’র কথা বললেও তার প্রয়োগ ঘটাতে পারেনি। শোষণের এক ভিন্ন মাত্রা নিয়ে আসে মাত্র। প্রাথমিক সময়ে পুঁজিবাদের শোষণের মাত্রার ভয়ংকর অবস্থার ফলে সাম্যবাদের র‍্যাডিকেল চিন্তাধারার বিকাশ ঘটে। সমান্তরালে থাকে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। শোষনের উপায় ও উৎপাদিকা শক্তির সামাজিকীকরণ, সমাজতন্ত্রের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় যাতে শোষণ কররার উপায়কে নিঃশেষ করা যায়। যদিও এর অনেক রকমফের ছিলো। তো যাই হোক, শোষণহীন সমাজের আকাঙ্খাই-সমাজতন্ত্র, এই বোধ জন্মায়।
ইংল্যান্ডের পুঁজিবাদের উত্থানের জন্য প্রয়োজন ছিলো, পুঁজির সঞ্চয় ও বিনিয়োগ। এই সঞ্চয় সে করে বাণিজ্য জাহাজ লুটতরাজ ও ঔপনিবেশিকীকরণের মাধ্যমে। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করার জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন প্রণয়ন করে। শোষণের এক নয়া মাত্রা যোগ হয়ও শোষণের সাথে যুক্ত হয়, সাম্প্রদায়িকতা। এই দুই ভেদনীতি পাকিস্তানীরা আরো বিস্তৃত করে। ফলে শোষণ ও বঞ্চনা হয় ভয়ংকর। ভারতবর্ষের ব্রিটিশ পূর্ব কাল ছিলো স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ অর্থনীতির সমাজ। ব্রিটিশ শক্তি সামাজিক সংস্কারের মাধ্যমে এক বিকৃত পুঁজিবাদের জন্ম দেয়, যা শোষণ ও বঞ্চনার কারণে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর এর জন্ম দেয়। পাকিস্তানীরা এর বিস্তৃতি ঘটায় এবং একে জাতিগত নিপীড়নের পর্যায়ে নিয়ে যায়। পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসন ও শোষণ, মানুষের সমস্ত আন্দোলন, এই শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাওয়ার আকাক্সক্ষা থেকে উৎসারিত। শিল্প বিপ্লব বা পুঁজিবাদের উত্থানের পরে যে সামাজিক প্রেক্ষাপট সমাজতান্ত্রিক আদর্শের স্ফ‚রণ ঘটিয়েছিল ঠিক তেমন প্রেক্ষাপট আমাদের সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনে উৎসাহ যুগিয়েছে। সমাজতন্ত্র ও তাই আমাদের মাতৃভূমির মুক্তির এক অন্যতম নীতি হলো। সামাজিক চেতনা মানুষের গোষ্ঠীবদ্ধ মিথস্ক্রিয়ার ফল। তাই আমাদের বিশ্বাস ও আদর্শের ভিত প্রোথিত থাকে সামাজিক কাঠামোতে। সামাজিক কাঠামোর প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের অনুসন্ধান কোন সমাজের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচনার মূল উপাদান।
আমাদের পবিত্র সংবিধানে যে মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে তার ভিত্তি হচ্ছে, দীর্ঘকালের সামাজিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনাবলী যা আমাদের সামষ্টিক মনোজগতে এক চেতনার আবহ তৈরি করে, তারই প্রকাশ হয় সংবিধানে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ- চবি