রাতে পুলিশ সার্জেন্ট, সকালে শিক্ষিকার প্রাণ গেল সড়কে

20

নিজস্ব প্রতিবেদক

ডিউটি শেষ করে আপন নীড়ে ফিরছিলেন ট্রাফিক সার্জেন্ট মোজাহিদুল ইসলাম। নিজ বাসায় ফেরার আগেই ঘাতক কার তার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছেন। গত সোমবার রাতে মোজাহিদে বাড়ি ফিরতে না পারার কষ্ট যখন স্বজনেরা চোখের পানি ফেলছে তখন বাড়ি থেকে মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে বাস ধাক্কায় প্রাণ গেল স্কুলশিক্ষিকা সাকিয়াতুল কাউচারের। একজনের ঘরে ফিরতে গিয়ে এবং আরেকজনের ঘর ছেড়ে বাইরে গিয়ে প্রাণ গেছে সড়কে। ১০ঘন্টার ব্যবধানে এই দুই সরকারি চাকুরীজীবির মৃত্যুতে চোখের পানি ফেলছে স্বজনরা। জানা যায়, হালিশহর টোল রোড এলাকায় প্রাইভেটকারের ধাক্কায় মোজাহিদুল ইসলাম (৩২) নামে এক ট্রাফিক সার্জেন্টের মৃত্যু হয়। গত সোমবার (১৩ মার্চ) দিনগত রাত সাড়ে ১০টার দিকে টোল রোড এলাকার ওয়াই জংশনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত সার্জেন্ট মোজাহিদুল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদর থানার বাসিন্দা। তিনি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) ট্রাফিক বন্দর বিভাগে কর্মরত ছিলেন।
হালিশহর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) হারুন রশিদ বলেন, দায়িত্বপালন শেষ করে রাত ১০টার দিকে টোল রোড দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে বাসায় ফিরছিলেন মুজাহিদ। এসময় পেছন থেকে দ্রুত গতিতে আসা একটি প্রাইভেটকার তার মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয়। এতে মোজাহিদুল ইসলামসহ দুইজন আহত হন। এসময় তাদের উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকের কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়। প্রাইভেটকারটি জব্দ করা হলেও চালক পালিয়ে যায়।
চমেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই নুরুল আশেক বলেন, রাত ১১টার দিকে গুরুতর আহত সার্জেন্ট মোজাহিদুলকে সার্জেন্ট নাজমুল হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ারে নিয়ে আসেন। এসময় আহত সার্জেন্ট মোজাহিদুলকে নিউরো সার্জারি ওয়ার্ডে পাঠানো হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা মৃত ঘোষনা করেন।
আমাদের হাটহাজারী প্রতিনিধি আবু তালেব জানান, নিহত সাকিয়াতুল কাউচার (৪৮) পেশায় একজন শিক্ষক। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ছিপাতলী ইউনিয়ের কাজিরখীল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করছেন। গত বছর ওই এলাকা বাসিন্দারা এক অনুষ্ঠানে তাকে ‘মাদারা অব কাজিরখীল’ ঘোষণা করেছিলেন। অথচ ভাগ্যের একি নির্মম পরিহাস, তিনি তাঁর একমাত্র কন্যা চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ফাবিহা আনবার তাহিকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে নিজ কর্মস্থলে ফেরার পথে বাস চাপায় না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার (১৪ মার্চ) সকালে নগরীর অক্সিজেন এলাকার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের মোড়ে অক্সিজেন-নিউমার্কেট রুটের দ্রুতগামী ৮ নম্বর সিটি বাস শিক্ষিকা সাকিয়াতুল কাউচার নামে ওই শিক্ষিকাকে চাপা দেয়। এতে তিনি গুরুতর আহত হয়ে সড়কে ঢলে পড়েন। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে গুরুতর আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
শিক্ষিকা সাকিয়াতুল কাউচারের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন উপজেলা শিক্ষা অফিসার সাঈদা আলম। তিনি জানান, ওই শিক্ষিকা তাঁর কন্যাকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে নিজ কর্মস্থলে (ছিপাতলী কাজিরখীল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়) আসার পথে বাসের ধাক্কায় ঘটনাস্থলে তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়।
নিহত শিক্ষিকা কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া উপজেলার কৈয়ারবিল এলাকার সরোয়ার কামালের স্ত্রী। তাঁর স্বামী চট্টগ্রাম নগরীর একটি স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক। সেই সুবাদে তিনি স্বামী ও একমাত্র কন্যাকে নিয়ে অক্সিজেন এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজ হাটহাজারী উপজেলা শাখা সিনিয়র সহ-সভাপতি (মহিলা) ছিলেন। স্কুল শিক্ষিকা কাউচারের মৃত্যুতে তাঁর দীর্ঘদিনের কর্মস্থল, সহকর্মী, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষার্থীদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
হাটহাজারী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা মাহেরা গাজী বলেন, নিহত সাকিয়াতুল কাউচার ছিপাতলী কাজিরখীল স্কুলে দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে সার্থকতার সাথে শিক্ষকতা করছেন। ওই এলাকার বাসিন্দা ও শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি অত্যন্ত বিনীয় ও পরিশ্রমী শিক্ষিকা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। গতবছর এলাকাবাসী এক অনুষ্ঠানে তাকে ‘মাদারা অব কাজিরখীল’ উপাধি দিয়েছিল।
এদিকে, নিহত শিক্ষিকার প্রথম জানাজার নামাজ বাদ আসর তাঁর দীর্ঘদিনে কর্মস্থল ছিপাতলী কাজিরখীল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। পরে নিজ এলাকা কুতুবদিয়ায় নিয়ে দ্বিতীয় দফায় জানাজার নামাজ শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে জানান তাঁর সহকর্মীরা। অন্যদিকে, দুঘর্টনার খবর পেয়ে বায়েজিদ থানা পুলিশ নিহত ওই শিক্ষিকাকে ধাক্কা দেয়া ঘাতক বাসটির চালককে আটক এবং বাসটি জব্দ করেছে বলে জানিয়েছে।