রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়া

21

ঢাকা প্রতিনিধি

দেশে হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় জনজীবনে নানান সংকট সৃষ্টি হবে উল্লেখ করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। এক লাফে জ্বালানি তেলের দাম যে পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে, তাতে সাধারণ জনগণের ওপর চাপ বিপুলভাবে বাড়বে বলে মনে করছেন তারা নেতৃবৃন্দ বলেছেন, এর আগে এক দফায় জ্বালানি তেলের দাম এতটা বাড়ানোর নজির নেই। জ্বালানির দাম বাড়ানোর এই হারকে অস্বাভাবিক আখ্যায়িত করে দ্রব্যমূল্যের ওপরও এর প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করেন তারা।
নেতৃবৃন্দ বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণে নতুন করে বাস, লঞ্চ ও ট্রাকভাড়া বাড়বে। প্রাইভেট কারের মালিক ও মোটরসাইকেলের চালকদের খরচও বাড়বে। ব্যয় বাড়বে কৃষি খাতে, যা বাড়িয়ে দেবে পণ্যের দাম।
উল্লেখ্য, শুক্রবার রাতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, পেট্রোলের দাম ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা এবং অকটেনের দাম ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা করা হয়েছে। ওইদিন রাত ১২টার পর থেকেই নতুন এই দাম কার্যকর হয়েছে।
সরকার এর আগে গত বছরের নভেম্বরে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়েছিল। তখন দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল লিটারপ্রতি ৮০ টাকা। ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর বাসভাড়া বাড়ানো হয় প্রায় ২৭ শতাংশ, যা তেলের দাম বাড়ানোর হারের চেয়ে অনেক বেশি। একইভাবে তখন লঞ্চভাড়া বাড়ানো হয় ৩৫ শতাংশ। সবমিলে বছরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) বিক্রি করা মোট জ্বালানি তেলের ৬৫ শতাংশ ব্যবহার করে পরিবহন খাত। প্রায় ১৬ শতাংশ ব্যবহৃত হয় কৃষি খাতে। শিল্প খাতে ৭ ও বিদ্যুৎ খাতে ১০ শতাংশ তেল ব্যবহৃত হয়।

আইএমএফের ঋণ পেতে দাম বৃদ্ধি
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল শনিবার ঢাকার নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশে বলেছেন, সঙ্কটে পড়ে এখন আইএমএফের ঋণ পেতে সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে জনগণকে বিপদে ফেলেছে।
ফখরুল বলেন, সরকার আইএমমএফের কাছে ঋণ চেয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি ডলার। কারণ তারা এত মিথ্যাচার করে এসেছে যে, রিজার্ভে এত এত ডলার জমা আছে, চিন্তার কারণ নেই। আজকে রিজার্ভ কমে যাওয়ার কারণে আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এডিবির কাছে ঋণ চেয়েছে।
আইএমএফের ঋণের শর্ত খুব শক্ত। তারা বলেছে যে, কোথাও কোনো অধিক ব্যয় করা যাবে না, তারা বলেছে, আজকে যেসব খাতে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে, সেই ভর্তুকিগুলো প্রত্যাহার করা হোক। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের জীবনযাত্রা যখন সঙ্কটে, তখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়াকে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির একটা ভয়ঙ্ককর প্রভাব ফেলবে সমগ্র দেশের অর্থনীতির উপরে। এটা বাংলাদেশের মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
তিনি বলেন, এই জ্বালানি তেলে মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যাবে পরিবহন ভাড়া। একই সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য চাল-ডাল-আটা-তেলের দাম আবার দ্বিগুণ হয়ে যাবে। মাঝখান থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কে? ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের সাধারণ মানুষ, যারা দিন আনে দিন খায়।

জনগণের প্রতি নির্দয় আচরণ
সঙ্কটের সময়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সমালোচনা করে সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পাটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের এক বিবৃতিতে বলেছেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর মধ্যে দিয়ে সরকারের ‘নির্দয়’ আচরণ প্রকাশ পেয়েছে।
বিবৃতিতে কাদের বলেন, জ্বালানি তেলের এমন মূল্যবৃদ্ধিতে জনজীবনে মহাবিপর্যয় সৃষ্টি হবে। ৫১ শতাংশেরও বেশি পর্যন্ত জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নির্দয় ও নজীরবিহীন। প্রমাণ হল, দেশের মানুষের প্রতি সরকারের কোনো দরদ নেই।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব অন্য ক্ষেত্রে পড়ে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, বেড়ে যাবে পরিবহন ব্যয়। নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। পাশাপাশি দেশীয় পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে, বাড়বে দামও। এতে রপ্তানি শিল্পেও বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। ভয়াবহ পরিণতির দিকে অগ্রসর হবে দেশের অর্থনীতি।

দাতা গোষ্ঠীর শর্ত বাস্তবায়নে মূল্যবৃদ্ধি
গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে দাতা গোষ্ঠীর শর্ত বাস্তবায়নের স্বার্থেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।
জ্বালানি তেলের মূল্য সহনীয় মাত্রায় বাড়ানোর কথা বলে রাতের বেলায় পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন ও অকটেনের দাম প্রায় ৪৫ শতাংশ বাড়ানোকে অযৌক্তিক ও জনগণের প্রতি সংবেদনহীনতার চরম বহিঃপ্রকাশ বলে অভিমত প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরো।
বিবৃতিতে বলা হয়, এমনিতেই মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি জনজীবনে ত্রাহী অবস্থা, তার ওপর এ মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনে কঠিন সংকট তৈরি করবে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির অভিঘাত পড়বে কৃষি, পরিবহন ও দৈনিন্দন জীবনে। পলিটব্যুরোর বিবৃতিতে সমন্বয়ের নামে জ্বালানি তেলের অচিন্তনীয় ও অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি প্রত্যাহারের আহবান জানানো হয়।

লুটপাটের বোঝা জনগণের কাঁধে চাপানো হচ্ছে
জ্বালানি তেল ও সারের অস্বাভাবিক দাম প্রত্যাহারের দাবি এবং ভোলায় গুলি করে দুই জন আন্দোলনকারীকে হত্যার নিন্দা জানিয়েছেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক কমরেড বজলুর রশীদ ফিরোজ।
গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে যখন তেলের দাম নিম্নমুখী প্রবণতায় রয়েছে তখন তেলের অস্বাভাবিক মূল্য কৃষি, শিল্প, পরিবহনসহ সব ক্ষেত্রে ব্যয় বাড়িয়ে দেবে আর সাধারণ নাগরিকের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলবে। দুর্নীতি ও লুটপাটের বোঝা জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দুর্বৃত্ত তোষণের রাজনীতি চলছে।
বিরোধী দল মতের প্রতি দমন পীড়ন আর জনগণের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে অতীতে কোনো শাসক রেহাই পায়নি উল্লেখ করে বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, দমন পীড়ন ও লুণ্ঠনের পথ পরিহার করুন।
জনগণের ওপর চরম জুলুম
খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক বলেছেন, সরকারের জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। জ্বালানি তেলের দাম একলাফে প্রতি লিটারে ৩৪-৪৬ টাকা বৃদ্ধি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
গতকাল রাজধানীর পুরানো পল্টনে দলীয় মিলনায়তনে খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সভাপতির বক্তব্যে তিনি আরো বলেন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বর্তমানে গত পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এ অবস্থায় এভাবে তেলের মূল্যবৃদ্ধি জনগণের ওপর চরম জুলুম। দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় উচ্চমূল্যের মধ্যে নতুন করে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে সবকিছুর দাম আরও বাড়বে। অবিলম্বে জ্বালানি তেলের বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহার করতে হবে।

ক্ষমতায় থাকার অযোগ্য আ. লীগ
বিনা কারণে ডিজেল, কেরোসিন, অকটেন, পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) একাংশের সভাপতি আবদুল করিম আব্বাসী ও মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার এক মুহূর্ত ক্ষমতায় থাকার অযোগ্য বলেও মন্তব্য করেছে দলটি।
গতকাল এক বিবৃতিতে এ মন্তব্য করার পাশাপাশি সরকারকে অবিলম্বে জন বিরোধী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহŸান জানান তারা।
যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করে আওয়ামী লীগ সরকার প্রমাণ করেছে তারা আর এক মুহূর্তও ক্ষমতায় থাকার যোগ্য নয়। বিশ্ববাজারে যখন জ্বালানির মূল্য কমছে, তখন সরকার কাকে খুশি করতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে? নিঃসন্দেহে এই সিদ্ধান্ত দেশের মানুষের জীবন যাপনকে কঠিন থেকে কঠিনতরো করে তুলবে।

লুটপাট করতেই মূল্যবৃদ্ধি
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার শুধু জনগণের টাকা লুট করতেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ২০ দলীয় জোটের শরিক ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ ও মহাসচিব মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক যৌথ বিবৃতিতে এ মন্তব্য করেন তারা।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির নিন্দা জানিয়ে এনপিপি নেতৃবৃন্দ বলেন, দফায় দফায় নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের জীবন যখন অতিষ্ঠ, ঠিক সেই মুহূর্তে নতুন করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। অথচ বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কমেছে। এর মাধ্যমে সরকার আবারও প্রমাণ করলো, তারা জনগণের সরকার নয়। দুর্নীতি ও লুটপাট করাই তাদের মূল লক্ষ্য।