‘রহস্যঘেরা’ বিস্ফোরণ

44

সকালে সন্তানকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছিলেন কয়েকজন অভিভাবক। কেউবা রাস্তার পাশে থাকা দোকানে সারছিলেন সকালের নাস্তা। প্রতিদিনের মতে রিকশায় চড়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যে ঘর ছেড়ে বের হয়েছিলেন এক শিক্ষিকা। নিজের জীবিকার চাকা ঘুরাতে শহুরে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলেন রিকশা ও ভ্যান চালকও। সূর্যের সাথে তালমিলিয়ে সবে শুরু হচ্ছিল দৈনন্দিন ব্যস্ততা। ঠিক এই সময়ে একটি ভবনের নিচতলায় বিষ্ফোরণে দেয়াল ধসে পড়ে চ‚র্ণ-বিচ‚র্ণ হয়ে যায় সাতটি জীবন। এমনই ভয়াবহ ঘটনা ঘটে নগরীর পাথরঘাটা এলাকার ব্রিক ফিল্ড রোডে।
গতকাল সকালে ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনাটি কী কারণে ঘটেছে তা এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি কোনও পক্ষই। উদ্ধার কাজে নেমে ফায়ার
সার্ভিসের কর্মকর্তারা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন, গ্যাস পাইপে ছিদ্র (লিকেজ) থাকার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এমন মন্তব্যের সাথে তাল মিলিয়েছে নগর পুলিশ ও অন্যান্য সেবা সংস্থা। তবে এই মন্তব্যকে নাকচ করে দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। তাদের দাবি, গ্যাস লাইন নয়, সেপটিক ট্যাংকে আবদ্ধ গ্যাস থেকে বিস্ফোরিত হয়ে ঘটনাটি ঘটেছে।
বড়ুয়া ভবনটির নিচতলায় পূজার ঘরটি ছিল রান্নাঘরের লাগোয়া। আর বাইরের দিকে সীমানা দেয়াল ঘেঁষে ছিল গ্যাস রাইজার। ওই মোমবাতি জ্বালানোর জন্য ম্যাচের কাঠি জ্বালাতেই সাথে সাথে বিস্ফোরণ হয়। কীভাবে কী হয়েছে বুঝতেও পারেননি সন্ধ্যা নাথ। সকাল থেকে এমনটা বলে আসছিলেন তিনি। এই ঘটনায় তার বড় বোনের মেয়ে অর্পিতা নাথসহ অন্তত ১০ জন আহত হন। তাদের মধ্যে দগ্ধ অর্পিতা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন ছিল। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় প্রেরণ করা হয়েছে। আর সন্ধ্যা নিজেও আহত হয়ে ভর্তি আছেন ক্যাজুয়ালটি বিভাগে। অর্পিতার বাবা কাজল দেবনাথ, মা মনিবালা নাথ এবং ভাই অর্নব নাথও ওই বাসায় থাকেন। তবে তারা কেউ আহত হননি। ফলে অনেকটা রহস্যাবৃত্তে ঘুরছে বিস্ফোরণের কারণ!
গতকাল সন্ধ্যায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশান কোম্পানি লিমিটেড। এই তদন্ত কমিটির প্রধান সারোয়ার পূর্বদেশকে জানান, আমরা সন্ধ্যায় তদন্ত প্রতিদেবন জমা দিয়েছে। তাতে আমরা বলেছি, গ্যাস সংযোগ বা রাইজার থেকে কোনো ধরণের বিষ্ফোরণ ঘটেনি। কেননা সকালেই আমরা পরিদর্শন করে যায়। যে কক্ষ থেকে বিষ্ফোরণ হয়েছে, সে কক্ষের সবকিছু অক্ষত রয়েছে। এমনটি প্লাস্টিকের জিনিসপত্রও কিছু হয়নি। চুলাটাও অবস্থাও কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাছাড়া রাইজার ও গ্যাস সংযোগ পুরোটা ‘চেক’ করা হয়েছে, যেখানে কোনো ধরণের লিকেজ পাওয়া যায়নি। তাছাড়া রান্না ঘরের পাশের রুমটায় সামান্য অগ্নিকান্ড ঘটেছে, তাতে একজন শিশু আহত হয়েছে। গ্যাস থেকে যদি বিষ্ফোরণ হত, তাহলে আরও ব্যাপক অগ্নিকান্ড ঘটত। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, বারুদের মত দেয়ালগুলো উড়ে গেছে। তাতেই মূলত মানুষ মারা যায়। গ্যাস থেকে বিষ্ফোরণ হলে এত শক্তিশালী বিষ্ফোরণ হতে পারে না। সেক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্নিকান্ড ঘটতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তাহলে কিভাবে বিষ্ফোরণ ঘটতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রান্না ঘরটির নিচে একটি সেফটি ট্যাংক রয়েছে। যেখানে পাঁচ তলা ভবনের প্রতিটি ঘরের মানববর্জ্য জমে। সাধারণত এমন সেফটি ট্যাংকে গ্যাস বের হয়ে যাওয়ার জন্য একটি পাইপ থাকে। এখানে সেটি ছিল না। মুখটাও বন্ধ ছিল। তাহলে সেফটি ট্যাংকে বর্জ্য থেকে উৎপাদিত হওয়ায় মিথেন ও হসফিন গ্যাস আবদ্ধ হয়েছিল। যার কারনে এমন শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটে।
এই সম্পর্কে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের আগ্রাবাদ স্টেশনের উপ-পরিচালক জসিম উদ্দিন বলেন, আমরা তিনটি বিষয় ‘অবজারভেশনে’ নিয়েছি। যেহেতু সকালে ঘুম থেকে ওঠে অনেকে নাস্তা তৈরি করার জন্য বাসায় গ্যাসের চুলা জ্বালান, ওই সময় যদি গ্যাসের লাইনে লিকেজ থাকে অথবা চুলার লাইন লুজ কানেকশন থাকায় বাসার ভেতর গ্যাস জমে থাকে অথবা গ্যাসের বেশি চাপ থাকে তাহলে বিস্ফোরণের সম্ভাবনা থাকে। এসব কারণ মাথায় নিয়ে আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। আসলে কোন কারণে এই ঘটনা ঘটেছে তদন্তের পর জানা যাবে। তবে প্রাথমিকভাবে আমরা ধারণা করছি, গ্যাস লাইনের লিকেজ অথবা লুজ কানেকশন থেকে এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে।
এই নিয়ে বিষ্ফোরক অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ভবনের রাইজার ও পাইপ লাইন খুব পুরনো। পাইপ লাইন রবার দিয়ে মোড়ানোর কথা ছিল। যেহেতু পাইপ লাইন রবার দিয়ে মোড়ানো ছিল না, আমরা ধারণা করছি, পাইপ লাইনের কোনো ফুটো দিয়ে গ্যাসটা বের হয়েছে। যেহেতু পাশে দেয়াল ছিল তাই গ্যাস রুমের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে। প্রবাহিত গ্যাস ঘরের ইলেকট্রনিক্স সুইচ বোর্ডেও প্রবেশ করতে পারে এবং সেখানে স্পার্কিংয়ের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। আমরা জানতে পেরেছি, আহত একজন ঘরে দেয়াশলাই জ্বালিয়েছে। এতে আগুনের উৎস পেয়ে বিস্ফোরণ ঘটেছে।