রমজানের শিক্ষায় ভাস্বর হোক বছরের বাকি সময়

3

আনোয়ার শাহাদাত হোসাইন

রহমত, মাগফেরাত আর নাজাতের মাস মাহে রমজান আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে। আমাদের কারো জানা নেই আগামী রমজান পর্যন্ত কারা বেঁচে থাকব এই পৃথিবীতে। কাজেই আমরা যারা মাহে রমজান মাস পেয়েছি তারা সত্যিই ভাগ্যবান এবং এ জন্য মহান রবের দরবারে বেশি বেশি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা উচিত। রমজানের মহান শিক্ষাকে কীভাবে সারা বছর ব্যাপী নিজেদের জীবনে লালন করতে পারি সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত। দীর্ঘ একমাসের সিয়াম সাধনায় লব্ধ শিক্ষা যদি বছরের বাকি এগার মাস নিজেদের জীবনে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারি তাহলে বুঝা যাবে মাহে রমজানের মৌলিক দাবী আমরা কিছুটা হলেও পারঙ্গম করতে পেরেছি।
মাহে রমজানের মৌলিক বিষয় হলো তাকওয়া বা আল্লাহভীতি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র রমজানকে অবশ্য পালনীয় করেছেন এবং এর উদ্দেশ্য উল্লেখ করে সূরা বাকারায় বলেছেন- ”লাআল্লাকুম তাত্তাকুন” অর্থাৎ ”তোমরা যেন তাকওয়াবান হতে পার”। এই তাকওয়াবান হওয়া বা আল্লাহভীতি মনোজগতে ধারণ করা প্রত্যেক ঈমানদারের জন্য অপরিহার্য। এখানেই মানবজাতির একমাত্র মুক্তি। যার অন্তরে আল্লাহর ভয় থাকবে সে সহজে কোন পাপ কাজে জড়িত হতে পারে না। আল্লাহভীতিতে পূর্ণ হৃদয় পৃথিবীর কোন তাগুতি শক্তিকে ভয় করে না। দ্বীনের পথে যে কোন বাঁধা ডিঙাতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠা বোধ করে না। তাকওয়াবান ব্যক্তির আচার-আচরণ, ব্যবসা বাণিজ্য, লেনদেন, সবকিছু হয় ইসলামি শরীয়তের মানদন্ডে উত্তীর্ণ তাই তাকওয়াবান ব্যক্তিদের সমাজ হয় অত্যন্ত সুন্দর সাবলীল। সেখানে থাকে না কোন হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, সুদ-ঘুষের ছড়াছড়ি, বেহায়পনা, অনৈতিকতা । সকল ধরনের পঙ্কিলতা মুক্ত থাকে তাকওয়াবানদের অন্তর। আত্মশুদ্ধি ও আত্মজাগৃতির জন্য রোজার যে প্রভাব রয়েছে তা অন্য কোন ইবাদতে সেভাবে প্রকৃষ্ট নয়। মানুষের কুপ্রবৃত্তি ও আবেগের উপর বিবেককে জয়ী করার যে অনুশীলন মাহে রমজানে আমরা পেয়েছি তা যেন জীবনে চলমান থাকে সেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে সর্বাত্মক ভাবে। পবিত্র রমজান মাস আমাদের আল্লাহভীতির প্রশিক্ষণ দিয়েছে। জানি না আমরা কতটুকু প্রশিক্ষিত হয়েছি, রমজানের মহা মূল্যবান শিক্ষাকে আমরা কতটুকু ধারণ করেছি। সমগ্র বিশ্বের মুসলমানগণ রমজান পালন করেছে। সারাদিন পানাহার ও জৈবিক চাহিদা থেকে বিরত থেকে মানুষ ইবাদতমুখী হয়েছে। পাঁচওয়াক্ত ফরজ নামাজের সাথে সাথে নফল ইবাদতের এক বিশাল সুযোগ সমৃদ্ধ এই মাসকে যারা যেভাবে কাজে লাগিয়েছে তারা সেভাবে তাদের জীবনকে ধন্য করেছে। তারাবিহর সালাত, তাহাজ্জুদ, কোরান তেলাওয়াত, দান সদকা, যাকাত-ফিতরা, অহেতুক কথা ও কাজ থেকে দূরে থাকা, ঝগড়া বিবাদ থেকে বিরত থাকা সহ বিভিন্ন পুণ্যময় ইবাদত ও কাজের যে একটি সার্বিক চর্চা আমরা একমাস করেছি তা ফলপ্রসু হবে যদি রমজান পরবর্তী সময়ে এসব অর্জিত গুনাবলী নিজেদের জীবনে প্রতিফলন ঘটাতে পারি। পাপ-পঙ্কিলতায় ভরা জীবনের ট্র্যাডিশন ভেঙ্গে মাহে রমজানে যেসব সদাচারণ আমরা চর্চা করেছি তা বছরের বাকি সময় ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। একটি মাসের সিয়াম সাধনার কঠোর অনুশীলনে মুসলিম হৃদয় এখন নব স্পৃহায় উজ্জীবিত। নিজেদের অন্তরাত্মাকে আল্লাহভীতির তরলে এমনভাবে ধৌত করে পরিশুদ্ধ করেছে সেখানে আর পঙ্কিল কোন জীবানু থাকার কথা নয়। যে অন্তরে এতদিন শয়তান নামত শত্রুর অবাধ বিচরণ ছিল, যে অন্তর ছিল হিংসা-বিদ্বেষ আর লোভ-লালসায় ভরপুর তা এখন আল্লাহভীতিতে পরিশীলিত ও পরিশোধিত। এখন আমাদের এই পরিশুদ্ধ অন্তঃকরণে শপথ নিতে হবে মাহে রমজানে যে গর্হিত কাজ আমরা ত্যাগ করেছি এবং সৎ কাজের চর্চা করেছি তা যেন পুরোটা বছর অব্যাহত থাকে। আমাদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক জীবন, ব্যবসায়িক জীবন, সামাজিক জীবন বা জীবনের অন্যান্য প্রতিটি ক্ষেত্রে যদি আল্লাহভীতিকে লালন করি তাহলে ধীরে ধীরে আমাদের জীবনে বিশাল পরিবর্তন আসবে এবং জীবন হয়ে উঠবে আল্লাহর রঙে রঙিন। আমরা যদি প্রত্যেকের স্ব- স্ব অবস্থান থেকে চেষ্টা করি তাহলে কিন্ত জীবন আরো অনেক সহজতর ও সুশীল হয়ে উঠতে পারে। রমজান মাস শেষ হওয়ার সাথে সাথে যদি আমাদের অন্তর থেকে আল্লাহভীতি চলে যায়, প্রাত্যহিক জীবন থেকে রমজানের শিক্ষা বা রমজানের যে প্রশিক্ষণ তা চলে যায় তাহলে বুঝতে হবে রমজান থেকে আমরা কিছুই অর্জন করতে পারিনি বা আমাদের প্রচেষ্টায় কোন ত্রæটি ছিল যার কারণে আল্লাহর কাছে আমাদের ইবাদত হয়তো কবুল হয়নি অর্থ্যাৎ পুরো রমজানের যে প্রশিক্ষণ তা ভেস্তে গেছে। কেননা একটি সাধারণ নিয়ম হলো, যে কোন কাজের বেলায় পূর্বের কাজের বিশুদ্ধতার উপর পরবর্তী কাজের সফলতা নির্ভর করে। ইবাদত বন্দেগীর ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। একটি ভালো বা পুণ্য কাজ কবুল হওয়ার লক্ষণ হলো, পুণ্য কাজের পর আরেকটি পূণ্য কাজ করা সামর্থ লাভ করা বা স্পৃহা জাগা। কল্যাণকর কাজে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের কর্তব্য এবং এটি মহান আল্লাহর কাছে অতি প্রিয়। যেমন সহীহ বুখারি শরীফের একটি হাদিছে হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা’লা আনহা থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেন- ”যে কাজ (সৎ কাজ) কেউ নিয়মিত করে, সেটি আল্লাহ তা’লার নিকট অতীব প্রিয় আমল।” কিন্তু পরিতাপেরর বিষয় হলো রমজান মাস আসে আর যায় কিন্তু আমরা রয়ে যায় আগের অবস্থানে। আমাদের জীবনে মৌলিক কোন পরিবর্তন আসে না। রমজান মাস শেষ হওয়ার সাথে সাথে আমাদের পুরনো চেহারা আবারো ভেসে উঠে। আমরা ফিরে যায় আমাদের সেই পঙ্কিল অন্ধকার গলিপথে যা সত্যিই পরিতাপের বিষয়।
একজন মুমিন মুসলমানের জন্য আল্লাহভীতি, ইবাদত-বন্দেগী, সৎ কাজের চর্চা, হারাম-হালাল মেনে চলা, সুদ-ঘুষ বর্জন করে চলা সহ যাবতীয় সদগুনাবলীর চর্চা কেবল কোন মৌসুম ভিত্তিক হবে না বরং তা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হবে নিরলস ভাবে। এই প্রসঙ্গে পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফে আল্লাহ পাকের ঘোষণা ”তুমি মৃত্যু অবদি তোমার রবের ইবাদত করতে থাক”-সূরা হিজর। তাই আমাদের উচিত ’মৌসুমি মুসলমান’ না হয়ে প্রকৃত মুসলিম-মুমিন হওয়ার কঠোর সাধনায় জীবনকে পরিচালিত করা, তাহলে আমরা উভয় জিন্দেগীতে সফলকাম হতে পারব ইনশাহআল্লাহ।

লেখক : প্রবাসী, কলামিস্ট