যুবলীগ নেতা খালেদ সাত দিনের রিমান্ডে

26

ঢাকার যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে অস্ত্র ও মাদক আইনের দুই মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের পুলিশ হেফাজতে পাঠিয়েছে আদালত। ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবে ক্যাসিনো চালানোর ঘটনায় গ্রেপ্তার খালেদকে গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে দুই মামলায় সাত দিন করে রিমান্ড চায় গুলশান থানা পুলিশ।
মহানগর হাকিম মাহমুদা আক্তার অস্ত্র মামলার শুনানি নিয়ে খালেদের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পরে মহানগর হাকিম শাহীনুল ইসলামের আদালতে মাদক মামলায় রিমান্ডের শুনানি হয়। এই মামলায় তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন বিচারক।
পর্যায়ক্রমে তার এই রিমান্ড কার্যকর করা হবে বলে আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আজাদ রহমান জানিয়েছেন। অর্থাৎ সাত দিন এই দুই মামলায় খালেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ। খবর বার্তা সংস্থার
ঢাকা মহানগর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে বুধবার সন্ধ্যায় গুলশানের বাসা থেকে গ্রেপ্তারের পর গতকাল বিকালে তাকে গুলশান থানায় হস্তান্তর করে র‌্যাব। এরপর তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও মুদ্রাপাচার আইনে তিনটি মামলা দায়ের করা হয় র‌্যাবের পক্ষ থেকে। এছাড়া মতিঝিল থানায়ও তার বিরুদ্ধে মাদকের একটি মামলা করেছে র‌্যাব।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী জানান, খালেদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক মামলার তদন্ত করবেন তারা। আর মানি লন্ডারিং মামলা তদন্ত ও দেখভাল করবে সিআইডি।
দুই মামলায় রিমান্ডে পেতে সন্ধ্যার দিকে খালেদকে নিয়ে আদালতের উদ্দেশে যাত্রা করেন গুলশান থানার পুলিশ সদস্যরা। বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট এবং মাথায় হেলমেট পরানো খালেদকে রাত ৮টা ২৫ মিনিটের দিকে ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে তোলা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শনিবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় যুবলীগ নেতাদের নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশের পর আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনটির প্রভাবশালী নেতা খালেদকে ধরতে অভিযান নামে র‌্যাব।
বুধবার বিকাল থেকে গুলশান ২ নম্বরের ৫৯ নম্বর সড়কে খালেদের বাসা এবং ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবে একযোগে অভিযান শুরু করেন র‌্যাব সদস্যরা। শাহজাহানপুরের রেলওয়ে কলোনিতে বেড়ে ওঠা খালেদ ফকিরাপুলের ওই ক্লাবের সভাপতি।
কয়েক ঘণ্টার অভিযানে ওই ক্লাবে মদ আর জুয়ার বিপুল আয়োজন পাওয়া যায়। সেখান থেকে ২৪ লাখ টাকাও উদ্ধার করা হয়।
আর গুলশানের বাসা থেকে খালেদকে গ্রেপ্তারের পর তার বাসায় ৫৮৫টি ইয়াবা, বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা এবং অবৈধ অস্ত্র পাওয়ার কথা জানায় র‌্যাব।
ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবের পাশাপাশি ওই এলাকার ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, বঙ্গবন্ধু এভিনিউর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র এবং বনানীর আহমেদ টাওয়ারে গড়ে তোলা একটি ক্যাসিনোতে র‌্যাবের অভিযান চলে।
এসব অভিযানে মোট ১৮২ জনকে গ্রেপ্তার করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বলে র‌্যাবের নির্বাহী হাকিম সারোয়ার আলম জানান।
মতিঝিল থানার ওসি ওমর ফারুক জানান, আগের দিনের অভিযান নিয়ে বৃহস্পতিবার র‌্যাবের পক্ষ থেকে দুটি মাদক মামলা দায়ের করা হয়েছে। একটি মামলায় খালেদকে আসামি করা হয়েছে। অন্যটি ওয়ান্ডারার্সের তিন কর্মচারীসহ অজ্ঞাত পরিচয় ২০ থেকে ২৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।
‘আন্ডারওয়ার্ল্ডে দাপট’, পালাতে চেয়েছিলেন সিঙ্গাপুরে :
একাধিক পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডে’ দাপট তৈরি করে চলা ফকিরাপুলে অবৈধ ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের (র‌্যাব) হাতে আটক ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া খালেদ দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। সিঙ্গাপুরে গিয়ে গা ঢাকা দেওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত আটক হয়ে যাওয়ার ভয়ে তিনি বিমানবন্দর থেকে ফিরে এসেছিলেন।
বুধবার সন্ধ্যায় র‌্যাবের হাতে আটক হন খালেদ। জানা গেছে ওইদিন সকালেই সিঙ্গাপুরে যাওয়ার কথা ছিল তার।
গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী স¤্রাটসহ পাঁচ জন সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের সকালের একটি ফ্লাইটে দেশ ছাড়তে চেয়েছিলেন। ভোরে তারা সে উদ্দেশ্যে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও যান। তবে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য থেকে তাদের সন্দেহ হয়, তারা বিমানবন্দরেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়তে পারেন। এ আতঙ্ক থেকে তারা বিমানবন্দর থেকে ফিরে আসেন।
ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা আরও জানান, বিমানবন্দর থেকে ফেরার পথে সম্রাট-খালেদসহ পাঁচ জন একসঙ্গেই ছিলেন। পরে দুপুরের দিকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় গিয়ে যে যার মতো আলাদা হয়ে যান। সেখান থেকে খালেদ বিকেল ৩টা ৩১ মিনিটে ফিরে যান তার বাসায়। সেখান থেকে দ্রুতই তার বের হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু র‌্যাব তার বাসায় ঢুকে পড়ায় তিনি আর বাসা থেকে বের হতে পারেননি।
‘আন্ডারওয়ার্ল্ডে’র সঙ্গে সম্পর্ক খালেদের
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ভারতে পলাতক বিএনপিপন্থী পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার। সেই সম্পর্কে ভাঙন ধরার পর তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে দুবাইয়ে পলাতক আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে। তার সহযোগিতা নিয়ে টেন্ডারবাজিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেন খালেদ। সেই টাকার ভাগ নিয়মিত পৌঁছে যেত জিসানের কাছে। ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডে’ খালেদের অবস্থান প্রমাণে সিঙ্গাপুরের অভিজাত হোটেল মেরিনা বে’র সুইমিংপুলে জিসান ও খালেদের সাঁতার কাটার ছবি দিয়ে ছাপানো পোস্টারে ছেয়ে যায় নগরী।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, একসময় টেন্ডারবাজির টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে জিসানের সঙ্গেও সম্পর্কের অবনতি হয় তার। এসময় সম্রাটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার শুরু খালেদের। জিসানের কাছ থেকেও তিনি দূরে সরে আসেন। একপর্যায়ে বড় অঙ্কের টাকা খরচ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে জিসানের বেশকিছু ক্যাডার ধরিয়ে দেন তিনি, বেশ কয়েকজন ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়। এরপর মুখোমুখি হয়ে পড়েন জিসান ও খালেদ। তখন থেকেই ‘নিরাপত্তা’র খাতিরে অস্ত্র উঁচিয়ে চলতে থাকেন খালেদ ও তার ক্যাডাররা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসীর সঙ্গে খালেদের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে। গত সপ্তাহে দু’জনের মধ্যে বৈঠকও হয়েছে। থাইল্যান্ডে পলাতক আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী নবী উল্লাহ নবীর সঙ্গেও রয়েছে খালেদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
আন্ডারওয়ার্ল্ড ও খালেদের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, থাইল্যান্ডে পলাতক মোহাম্মদপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী নবী উল্লাহ নবী খালেদের ব্যবসায়িক অংশীদার। ব্যাংককে একটি টু-স্টার মানের হোটেল ও পাতায়াতে ফ্ল্যাট ব্যবসায় বিনিয়োগ আছে খালেদের। এসব দেখভাল করেন নবী। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অভিজাত সুপারমল প্যাভেলিয়নের উপরে ১১ কোটি টাকায় সম্পতি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন খালেদ। সেখানে গড়েছেন সেকেন্ড হোম। স্কটল্যান্ডেও কিনেছেন বাড়ি। সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য পরিবার নিয়ে ঘনঘন যাতায়াত করেন। সেখানে বিনিয়োগ ভিসায় স্থায়ীভাবে পরিবার নিয়ে থাকার প্রস্তুতিও চলছে তার।
যোগাযোগের চেষ্টা করেও এসব বিষয়ে খালেদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, চাঁদাবাজিসহ যুবলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে যেসব অনৈতিক কাজের অভিযোগ উঠেছে, তাদের বিচার হবে যুবলীগের নিজস্ব ট্রাইব্যুনালে। বিচার প্রক্রিয়া শুরুর জন্য এরই মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
অন্যদিকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি সম্রাটের দাবি, তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, সেগুলার প্রশাসনিক তদন্ত হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। আর খালিদ মাহমুদ ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অস্ত্র উঁচিয়ে চলার অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। ক্যাসিনো ও মাদক ব্যবসার অভিযোগ প্রসঙ্গে সম্রাট বলেন, এগুলো কারা করে, তা তার জানা নেই।