যুদ্ধে ‘হেরে যাচ্ছে’ রাশিয়া ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে পশ্চিমারা

18

পূর্বদেশ ডেস্ক

ইউক্রেনের যুদ্ধ রাশিয়ার সামরিক শক্তির মিথ গুড়িয়ে দিয়েছে, পশ্চিমা জোটকে করেছে শক্তিশালী, বৈশ্বিক অর্থ ও বাণিজ্য ব্যবস্থায় এনেছে বিভাজন এবং ইউক্রেনের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ১০০ দিন আগে, ২৪ ফেব্রæয়ারি রাশিয়ার সর্বাত্মক সামরিক আক্রমণে এই যুদ্ধের সূত্রপাত। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই যুদ্ধ শতাব্দী না হলেও গত কয়েক দশকের সামরিক শিক্ষাকে পুনরায় ভাবতে বাধ্য করছে।
গ্রিসের অ্যাথেন্সভিত্তিক হেলেনিক মিলিটারি একাডেমির ভ‚রাজনীতি ও আধুনিক অস্ত্র ব্যবস্থা বিষয়ক অধ্যাপক কনস্টানটিনোস গ্রিভাস বলেন, আমরা বুঝতে পারছি রণক্ষেত্রের পরিণতি নির্ধারণে ‘ফায়ারপাওয়ার’ মৌলিক উপাদান। আমরা দেখেছি, উভয়পক্ষে কামান কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ৬০ দশকের তুলনায় মাল্টিপল লঞ্চ রকেট সিস্টেম বা রকেটে খুব অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটেনি। কিন্তু দূরপাল্লা ও উচ্চতর নির্ভুলতা ও চরম ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা যুক্ত হয়েছে।
ভালো কৌশলগত পরিকল্পনা না থাকায় রাশিয়া ফায়ারপাওয়ারে শক্তিশালী অবস্থান থেকে ছিটকে পড়েছে। যুদ্ধের প্রথম একমাস রাশিয়া চেষ্টার পর ইউক্রেনকে ‘নক-আউট’ পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে।
হেলেনিক আর্মির আর্র্মড ডিভিশনের সাবেক কমান্ডার ও গ্রিসের ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের প্রভাষক পানায়োতিস গার্টজোনিকাস বলেন, রাশিয়া একটি বিস্তৃত রাজনৈতিক লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে যা সামরিক উপায়ে অর্জন সম্ভব না। যে সেনা তারা মোতায়েন করেছে তাতে এই লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব ছিল।
দ্বিতীয় কৌশলে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে সব ইউক্রেনীয় সেনাদের ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা নেয়। এই পরিকল্পনাও ত্যাগ করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। কারণ রুশ সেনারা সম্প্রতি সেভেরোদনেস্ক দখলে মনোযোগী হয়েছে এবং অন্যত্র ছোট ছোট শহর ঘিরে ফেলার দিকে এগোচ্ছে। মাঝে মধ্যেই রাশিয়ার কৌশলগত দক্ষতার ঘাটতি দেখা গেছে। গত মাসে সিভেরস্কি ডনেট নদী অতিক্রমের সময় ইউক্রেনীয় সেনারা রাশিয়ার ৭৪তম মটোরাইজড রাইফেল ব্রিগেডকে গুড়িয়ে দিয়েছে। এক অঞ্চল থেকে অন্যত্র যাওয়ার সময় রুশ সেনাদের বন্দি করা হয়েছে এবং তারা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। যুদ্ধে ব্যর্থতার মধ্যে রুশ বাহিনীতে বিদ্রোহের কথাও শোনা যাচ্ছে। গ্রিভাস বলেন, ইউরোপে রাশিয়ার প্রচলিত সামরিক হুমকি অতিরঞ্জিত ছিল।
যেসব স্থানে রাশিয়া উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, তা এসেছে ফায়ারপাওয়ারের অত্যাধিক সন্নিবেশের ফলে। প্রতিরোধবাহিনীর ওপর একযোগে মর্টার, কামান ও রকেট বর্ষণের মাধ্যমে সেভেরোদনেস্ককে সুবিধাজনক অবস্থায় পৌঁছেছে রুশ বাহিনী। একই কৌশলের ফলাফল দেখা গেছে মারিউপোলে। যেখানে পুরো শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
সামরিক সম্বলের আরও বিচক্ষণ ব্যবস্থাপনার কারণে কিয়েভ, চেরনিহিভ, সুমি ও খারকিভে তারা রুশ যুদ্ধ মেশিনকে পরাজিত করতে পেরেছে। সেভেরোদনেস্ক থেকে তারা ধীরে ধীরে পূর্ব দিকে পিছু হটছে এবং দক্ষিণে খেরসনের দিকে রুশ সেনাদের ঠেলে দিচ্ছে। দ্য ইনস্টিটিউট অব স্টাডি অব ওয়ার এক পর্যালোচনায় লিখেছে, এটি কৌশলগতভাবে উপযুক্ত।
তারা লিখেছে, খেরসন গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি ইউক্রেনের একমাত্র অঞ্চল যেখানে ডনিপ্রো নদীর পশ্চিম তীরে রুশ সেনারা ভূখন্ড দখল করে আছে। খেরসনের এই ভূখন্ড যদি রাশিয়া যুদ্ধের সমাপ্তির পর ধরে রাখতে পারে তাহলে ভবিষ্যৎ আক্রমণের জন্য তারা একটি শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে।
এতে আরও বলা হয়েছে, ইউক্রেনকে তাদের সীমিত সম্বলের উপযুক্ত ব্যবহার করতে হবে। যেসব ভ‚খন্ড যুদ্ধের গতি নির্ধারণ করবে না সেগুলো রক্ষার বদলে তাদের উচিত হবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিচক্ষণতার সঙ্গে লড়াই করলেও রাশিয়ার ফায়ারপাওয়ারে কাছে পিছিয়ে পড়ছে ইউক্রেন।
গ্রিভাস বলেন, রাশিয়া যে বিশাল ফায়ারপাওয়ার মোতায়েন শুরু করেছে সেগুলোর চাপে নতি স্বীকার করতে শুরু করেছে রাশিয়া। আমরা দেখছি অতি উচ্চ তীব্রতার যুদ্ধ। এই পরিস্থিতিতে জিততে হলে ভয়াবহ ধ্বংস ও বড় ক্ষতি মেনে নেওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রশ্নটি হলো, কারা দীর্ঘদিন এটি করে যেতে পারবে। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
পানায়োতিস গার্টজোনিকাস মনে করেন, এই মুহূর্তে কোনো সমঝোতা কঠিন বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে একেবারে অসম্ভব না। তিনি বলেন, সময় এখন রাশিয়ার পক্ষে না। অপর দিকে, ইউক্রেনের শক্তি ক্রমশ বাড়ছে। এটি যুগান্তকারী অগ্রগতির কোনো ভিত্তি নয়। রাশিয়া হয়ত আরও কয়েকটি ভূখন্ডগত জয় পাবে, ইউক্রেনও কিছু সাফল্য পেতে পারে। কিন্তু যুদ্ধের মূল্য খুব চড়া। এই কারণে আমরা হয়তো একটি সমঝোতা দেখতে পারি, রণক্ষেত্রের অগ্রগতির ভিত্তিতে তা হবে না।
নিহত হাজারো, বাড়ছে আর্থিক মূল্য
এই যুদ্ধের মানবিক মূল্য স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, তারা রাশিয়ার ৩০ হাজারের বেশি সেনাকে হত্যা করেছে। মার্চের শেষ দিকের পর রাশিয়া নিজেদের নিহত সেনাদের সংখ্যা জানায়নি। ওই সময় তারা বলেছিল, তাদের ১ হাজার ৩৫১ জন সেনা নিহত হয়েছে। কোনো সংবাদমাধ্যম উভয়ের দাবির সত্যতা স্বতন্ত্রভাবে নিশ্চিত করতে পারেনি।
জাতিসংঘ বলেছে, ইউক্রেনে ৪ হাজারের বেশি বেসামরিকের প্রাণহানি হয়েছে এবং প্রকৃত নিহতের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
ইউক্রেন অভিযোগ করেছে, রুশ সেনারা জোর করে ৫ লাখ ইউক্রেনীয়কে রাশিয়া যেতে বাধ্য করেছে। জাতিসংঘের মতে, ৬৬ লাখের বেশি ইউক্রেনীয় দেশ ছেড়েছেন।
উভয়পক্ষের বস্তুগত ক্ষয়ক্ষতিও রয়েছে। ইউক্রেনের অর্থমন্ত্রী সেরহি মারচেঙ্কো বলেছেন, যুদ্ধের সামরিক ও মানবিক ব্যয় ৮.৩ বিলিয়ন ডলার, যা দেশটির বার্ষিক বাজেটের এক-অষ্টমাংশ। কিয়েভ স্কুল অব ইকোনমিকস এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ইউক্রেনের ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামোর মূল্য ১০০ বিলিয়ন ডলার। কিছু বিশ্লেষক বলছেন তা আরও বেশি হতে পারে।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সরঞ্জাম ও ত্রাণ হিসেবে ৫৩.৬ বিলিয়ন ডলার এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকে ৪.৮ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে। পুনর্গঠনের জন্য আরও অনেক অর্থের প্রতিশ্রæতি পেয়েছে তারা।
স্বল্প মেয়াদে রাশিয়ার অর্থনৈতিক ক্ষতি কম। ফোবর্স ম্যাগাজিন রাশিয়ার সরঞ্জামগত ক্ষতি ১৩ বিলিয়ন ডলার বলে উল্লেখ করেছে। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জ্বালানি রফতানি থেকে এই অর্থ চলে এসেছে।
ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের অর্থনীতির অধ্যাপক জর্জ পাপাকন্সটান্টিনউ বলেন, প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ বাধাধরা। ফলে দাম বেড়েছে এবং যুদ্ধের পর থেকে রাশিয়ার আয় প্রায় দ্বিগুণ রয়েছে- প্রায় ৬০ বিলিয়নের মতো। ফলে যুদ্ধে যদি দিনে ১ বিলিয়ন ব্যয় হয়, সেই যুদ্ধই দিনে আনছে ১ বিলিয়ন। ফলে সমানে সমান।
রুশ অর্থনীতির বিরুদ্ধে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে রুবল। পশ্চিমা পণ্য ও সেবায় নিষেধাজ্ঞার ফলে উদ্বৃত্ত বেড়েছে ও বিদেশি মুদ্রার চাহিদা কমেছে।
‘হারছে রাশিয়া’
দীর্ঘ মেয়াদে পরিস্থিতি ভিন্ন। কারণ রাশিয়া বাইরের কোনো সহযোগিতা পাচ্ছে না। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ফলে রুশ ব্যাংকগুলো বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন, বিদেশি মুদ্রা রিজার্ভের অর্ধেক জব্দ এবং সংবেদনশীল প্রযুক্তি ও গুরুত্বপূর্ণ সেবা রাশিয়ায় রফতানি বন্ধ। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্য নিষিদ্ধ করেছে রুশ কয়লা ও গ্যাস। রুশ তেল আমদানিতে আংশিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং তারা পাঁচ বছরে রুশ গ্যাস আমদানি বন্ধের পরিকল্পনা করছে।
বাণিজ্যিক রুট যে বদলে যাচ্ছে, এতে তা স্পষ্ট হচ্ছে। আরও দূর থেকে ইউরোপ জ্বালানি ও খাদ্য নিয়ে আসছে।
জর্জ পাপাকন্সটান্টিনউ বলেন, রুশ অর্থনীতির সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধি অতীতের তুলনায় অনেক কম হবে। দেশটির বাণিজ্যিক অংশীদার খুব বেশি থাকবে না, বিদেশি বিনিয়োগকারীর সংখ্যা থাকবে কম, এটি উপকরণ ও জোগান নিশ্চিত করতে পারবে না। ফলে আগে যা উৎপাদন হতো তা করতে সক্ষম হবে না। ইউরোপের তুলনায় এটি বড় আকারের ক্ষতি।
গ্রিভাস বলেন, এটি স্পষ্ট যে রাশিয়া হারছে। চড়া মূল্যে কিছু অঞ্চল দখল করছে তারা, এটি সত্য। কিন্তু বিভিন্ন পর্যায়ে তারা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে এবং তারা নিজেদের ও ইউরোপের মধ্যে একটি উপসাগর তৈরি করেছে।
যুদ্ধ যদি আরও চার মাস চলে তাহলে জর্জ পাপাকন্সটান্টিনউ মনে করেন, পশ্চিমা কর্পোরেশনের রুশ বাজার থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করা অপরিবর্তনযোগ্য হবে। একই সঙ্গে তিনি দীর্ঘমেয়াদে বিপদও দেখছেন।
তিনি বলেন, বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থাকে আমরা অস্ত্রে পরিণত করছি। আমাদের অন্য উপায় নেই। তাই আমরা রাশিয়া, চীন ও ভারতকে সুইফট-এর বিকল্প ব্যবস্থা, বিকল্প বিনিয়োগ নিরাপত্তা, বড় বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও নিজেদের মধ্যে আরও বিনিয়োগের দিকে দিকে ঠেলে দিচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, আমরা যত বেশি রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করব, তাতে তত বেশি চীনের দিকে ঝুঁকবে। আর চীন এটিকে যত বেশি সম্ভব কাজে লাগাবে।