মানুষ ঠকিয়ে ‘গুপ্তধন’ মানিকের ডুপ্লেক্স বাড়ি

15

রাহুল দাশ নয়ন

হাসপাতাল, মসজিদ ও বাজার সবখানেই এদের বিচরণ। অপরিচিত মানুষের পাশে বসে ভাব জমান। মনমাতানো কথামালায় আকৃষ্ট করেন। গল্পের মতো শোনান গুপ্তধনের খবর। কথার ফাঁকে মুঠোফোনে তিনটি কলসির ছবি দেখিয়ে নজর কাড়েন। যে কলসিগুলোতে উপচেপড়া স্বর্ণের কয়েন। যা দেখে চোখ ছানাবড়া। এবার লোভে পড়া ব্যক্তিকে গুপ্তধন পাইয়ে দেয়ার পালা। নিয়ে যাওয়া হয় বাঁশখালীর ছনুয়ায়। হাতে কয়েকটি স্বর্ণের কয়েন ধরিয়ে দেয়া হয়। যা স্বর্ণকারের কাছে নিয়ে গেলে আসল স্বর্ণ
বলেই নিশ্চিত হওয়া যায়। এই আসল সোনার লোভে পড়েই প্রতারিত হতে হয়। স্বর্ণ দেয়ার নামে ছনুয়ায় নিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয় লক্ষ লক্ষ টাকা।
গত ১৭ মার্চ রাতে গুপ্তধন চক্রের মূলহোতা আহমদ কবির প্রকাশ সোনা মানিককে ছনুয়ার ৩নং ওয়ার্ডের নিজ বাড়ি থেকে বাঁশখালী থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করলে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। তার ১১ ভাই, স্ত্রী, বোনসহ নিকটাত্মীয়দের অধিকাংশই এমন প্রতারণার সাথে জড়িত। আর এমন প্রতারণা করেই মানিক বানিয়েছেন কারুকাজ করা কয়েক কোটি টাকার ডুপ্লেক্স বাড়ি।
স্বর্ণ মানিকের হাতে প্রতারণার শিকার হওয়াদের একজন কক্সবাজারের রামুর ঝুমপাড়ার বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম। স্বামী মো. বেলাল থাকেন মালয়েশিয়া। বিদেশেই স্বর্ণ মানিকের ভাগিনা এরশাদের সাথে বেলালের পরিচয়। দুইজনের মধ্যে গড়ে ওঠে সুসম্পর্ক। এরশাদ দেশে এসেও বেলালের সাথে বিদেশে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। একদিন বেলালকে গুপ্তধন পাওয়ার কথা জানান এরশাদ। স্বপ্ন দেখা মানতের এই স্বর্ণ তুলতে গেলে টাকা লাগবে বলে জানালে বেলাল তার স্ত্রী মনোয়ারার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেন। মনোয়ারার ছেলে ও মামা মিলে একদিন ছনুয়ায় যান। সেখানে ভালোভাবে মেহমানদারি করানো হয়। আসরে নিয়ে দেখানো হয় তিন কলসি স্বর্ণ। যেখান থেকে দুটি স্বর্ণের কয়েন দিয়ে মনোয়ারার ছেলে ও মামাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তারা স্বর্ণগুলো জুয়েলার্সে নিয়ে পরীক্ষা করলে আসল স্বর্ণ বলে জানতে পারেন। দ্বিতীয়দফা গিয়ে কয়েনগুলো ফেরত দিয়ে মানতের গুপ্তধন আনার সিদ্ধান্ত হয়। তৃতীয়দফায় প্রায় সাত লক্ষ টাকা নিয়ে মনোয়ারা, ছেলে ও মামা ছনুয়ায় যান। সেখানে গিয়ে টাকাগুলো এক জায়গায় করে ব্যাগ ভরতেই মানিক এসে টাকা ছিনিয়ে নেয়। এই ঘটনায় মামলা করেছেন মনোয়ারা বেগম।
গতকাল রাতে প্রতারণা শিকার মনোয়ারা বেগম পূর্বদেশকে বলেন, ‘মানিক টাকা ছিনিয়ে নেয়ার পর শোর চিৎকার করলে মানিকের দুই বোন রোজিনা ও তৈয়বাসহ ১০-১২ ছুটে জন আসে। তারা আমার গলায় হাতে থাকা স্বর্ণগুলোও নিয়ে নেয়। একপর্যায়ে তিনজনের চোখ বন্ধ করে কিছু কথা শিখিয়ে দেয়। তাদের কথামতো না বললে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। পরে চোখ খুলে দেখি আমাদের সামনে অস্ত্র রাখা আছে। দুইজন লোক দুই পাশ থেকে অস্ত্র ঠেকিয়ে আছে। আমরা অস্ত্র বিক্রি করতে গেছি বলে স্বীকারোক্তি নেয়। আমরা গোপন রাখবো বলার পর একটি খালের পাড়ে এনে আমাদেরকে ছেড়ে দেয়। পরে পুলিশকে ঘটনা জানিয়েছি। আমি লোভে পড়ে ভিটিবাড়ি বন্ধক রেখে টাকা দিয়েছি। টাকা উদ্ধার করতে না পারলে বাঁচার উপায় থাকবে না। আমরা স্বামী ঘটনা শোনার পর প্রবাসে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’
স্থানীয়রা জানান, ২০০১ সালের দিকে পুঁইছড়ি ও ছনুয়া এলাকায় কয়েকটি চক্র এই নকল সোনার ব্যবসা করে আসছিল। সেসময় লোকেমুখে বেশ কয়েকজনের নামও ছড়িয়ে পড়ে। যারা নকল স্বর্ণের ব্যবসা করে কোটিপতি বনে গেছেন। এদেরই একজন এই মানিক। তার পুরো পরিবার এমন অপকর্মের সাথে জড়িত। মাঝেমধ্যে সে গ্রেপ্তার হলেও জামিনে এসে আবারও একই ঘটনা ঘটায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছনুয়ার খুদুখখালী এলাকার এক ব্যক্তি বলেন, ‘সোনা মানিক এই প্রতারণা করেই আলিশান বাড়ি বানাচ্ছেন। তার পেশাই হচ্ছে প্রতারণার নামে ডাকাতি করা। তার প্রায় ৩০ জন নিকটাত্মীয় বিভিন্ন স্থানে প্রতারণার সহযোগী হিসেবে বিচরণ করছে। প্রতারণার টাকায় তাদের কাছে ৫-১০টির মতো আসল স্বর্ণের কয়েন আছে। যেগুলোকে পুঁজি করেই মানুষের কাছ থেকে কোটি টাকা হানিয়ে নিচ্ছে। তাদের অর্জিত সম্পদগুলো বাজেয়াপ্ত করা প্রয়োজন।’
পুলিশ জানায়, এর আগে ২০১৮ সালে প্রতারক মানিককে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। এরপর ২০২১ সালের আগস্ট মাসে রাঙ্গামাটির বিজয় কেতন চাকমা নামে প্রতারণার শিকার হওয়া এক ব্যক্তি মামলা করলে স্বর্ণ মানিকের সৎমা রাশেদা বেগম (৫০), মানিকের ভাই নুরুল আলমের স্ত্রী সামারু (২৫) ও সহযোগী আবুল খায়ের (৪০) কে গ্রেপ্তার করা হয়। সম্প্রতি এ চক্রটি আবারোও মাথাচড়া দিয়ে ওঠে। মানুষের আনাগোনা বেশি আছে এমন জায়গায় এদের বিচরণ। এ চক্রের সদস্যরা মসজিদে নামাজ পড়ে মুসল্লি, ইমাম এবং হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের সাথে ভাব জমান। এরপরেই প্রতারণার শুরু।
বাঁশখালী থানার ওসি তোফায়েল আহমদ পূর্বদেশকে বলেন, আমি যোগদান করার পর থেকে চারটি ঘটনায় প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা আয় করেছেন প্রতারক মানিক। সবার অভিযোগ শোনার পর আমার মধ্যে এই প্রতারক মানিককে ধরার আগ্রহ বাড়ে। এর আগেও এমন বহু ঘটনা ঘটিয়েছে। সবাই প্রতারণা শিকার হয়ে ভয়ে মুখ খুলেনি। এখন গ্রেপ্তারের খবর পাওয়ার পর অনেকেই আসছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সাথেও গুপ্তধন পাইয়ে দেয়ার নামে প্রতারণা করেছে। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, প্রতারণার প্রায় ১৯টি মামলা আছে। প্রতারণার টাকাতেই সে বিশালাকার ডুপ্লেক্স বাড়ি বানিয়েছে। মানিকের সাম্রাজ্যে না গেলে মানুষ বুঝতে পারবে না সে কতবড় প্রতারক।