মহান শিক্ষা দিবসের ভাবনা শিক্ষায় অতি চালাকি কাম্য নয়…

32

বাবুল কান্তি দাশ

ব্রিটিশ শাসনের পর আসে পাকিস্তানি শোষণ। বাংলাকে সর্বোতভাবে ধ্বংস করার লক্ষ্যে এগুতে থাকে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী সুপরিকল্পিতভাবে। বাংলার কৃষ্টি সংস্কৃতি ভাষা শিক্ষা ধ্বংসের এক অশুভ খেলায় মেতে উঠে। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের পর পরই ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। যে কমিশনে নেতৃত্ব দেয় আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তার এককালের শিক্ষক এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষা সচিব এস এম শরীফ। শরীফ কমিশন নামে পরিচিত এই কমিশন ১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানের সা¤প্রদায়িক ভাবাদর্শে প্রণীত ছিল এই প্রতিবেদন। এতে শিক্ষা বিষয়ে আরো যে সকল প্রস্তাবনা ছিল তা প্রকারান্তরে শিক্ষা সংকোচনের নামান্তর। সাম্প্রদায়িক, অবৈজ্ঞানিক বাংলার কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক কমিশনের এই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে বাংলার বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন অবস্থান নেয়। গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। পরিষদ ১৭ সেপ্টেম্বর প্রদত্ত শিক্ষানীতির বিরোধিতা করে দেশব্যাপী হরতালের কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়। এই দিন সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়। ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি শাসন, শোষণ সর্বোপরি শিক্ষা সংকোচনের বিরুদ্ধে এই সমাবেশ শেষে মিছিল বের করা হয়। জগন্নাথ কলেজে গুলি হয়েছে এ গুজব শুনে মিছিলটি দ্রæত নবাবপুরের দিকে যাত্রা শুরু করে। হাইকোর্টের সামনে এসে মিছিলটি পুলিশী বাধার সম্মুখীন হয়। মিছিলকারীরা পুলিশের সাথে সংঘাতে না গিয়ে তারা আব্দুল গণি রোডের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এমতাবস্থায় পুলিশ মিছিলের পেছন থেকে লাঠিপেটা, কাঁদানো গ্যাস নিক্ষেপ এবং একপর্যায়ে গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে আন্দোলনকারী ওয়াজিউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা ও বাবুল শহীদ হন। আহত হন অনেকে। তাদের স্মরণে ১৭ সেপ্টেম্বর দেশে শিক্ষা দিবস পালন করা হয়। বাংলা ভাষা এবং বাঙালি জাতিসত্তার মর্মমূলে আঘাত হেনেছিল শরীফ কমিশনের প্রস্তাবনা। আর এতেই ফুঁসে ওঠে বাংলার আপামর ছাত্র জনতা।
দমন পীড়ন ও প্রতিকূলতার মধ্যেও ছাত্র সমাজ আন্দোলন অব্যাহত রাখে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে পাকিস্তানি শাসক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে মুক্তি দেয়। লক্ষ্য ছিল আন্দোলনকে ব্যাহত করা, স্তিমিয়ে রাখা। পরবর্তীতে ছাত্র সমাজ ও আন্দোলনকারী জনগণের পক্ষে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর গোলাম ফারুকের সাথে আলোচনায় বসে। আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বোধে নিয়ে সরকার শরীফ কমিশনের রিপোর্ট স্থগিত করে। এখানে উল্লেখ্য যে কমিশনের প্রতিবেদনে ছাত্র শিক্ষকদের কার্যকলাপের ওপর তী² নজর রাখা, শিক্ষকদের ১৫ ঘণ্টা কাজের বিধান এমনকি বর্ণমালা সংস্কারের প্রস্তাবনা ছিল।
১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন, ৬৯’র নুর খান শিক্ষা কমিশন ও গণঅভ্যুত্থান যা অনিবার্য পরিণতি রূপে ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তেমনিভাবে সর্বগ্রাসী ছিল সংকট উত্তরণে। দেশের সার্বিক উন্নয়নের চাবিকাঠি হচ্ছে শিক্ষা, এ কথা যদি দেশের নীতিনির্ধারকদের মাথায় না থাকে এবং এ বিষয়ে চেতনার চৈতন্য না ঘটে তাহলে যে কোন সংকট, বিপর্যয়ের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। শিক্ষাকে গৌণ ভেবে অগ্রসর হওয়া মানে বোকার স্বর্গে বাস করা। সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদে গণমুখী, বিজ্ঞানভিত্তিক ও সার্বজনীন ধারায় শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা বাস্তবায়নে এখনো আমরা মনোযোগী নই বলা যায় তা উপেক্ষিত। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের অঙ্গীকার ছিল গণমুখী, সার্বজনীন, বিজ্ঞানভিত্তিক অসা¤প্রদায়িক ও বৈষম্যহীন শিক্ষার ব্যবস্থা করা। স্বাধীনতার প্রায় পঞ্চাশ বছর পার হয়ে আসলেও তা বাস্তব রূপায়নে এখনো অনেক পিছিয়ে। যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি কুদরত ই খুদা শিক্ষা কমিশন। ৭৫ পরবর্তী সময়ে অনেক শিক্ষা কমিশন হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি কমিশনের চতুরতায়। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের আগেই সরকার ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারকে ভাগ্যবান বলতে হয় তারা অনেক সময় পেয়েছে। ২০১০ সালে ঘোষিত হয় জাতীয় শিক্ষানীতি। দশ বছর পার হলেও তা বাস্তবায়নে অবহেলা, বলা যেতে পারে অমনোযোগী। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছুতে গণমুখী সার্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নাই।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে তাদের চিন্তা চেতনায় দেশাত্মবোধ দেশপ্রেম জাতীয়তাবোধ সর্বোপরি সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে এখনই মনোযোগী হতে হবে শিক্ষানীতির যথাযথ প্রয়োগে, উদ্যোগী হতে হবে বাস্তবায়নে। ন্যায়বোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মানবাধিকার সচেতনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা সৎ জীবনযাপনের মানসিকতা, শৃঙ্খলায় হোক আজকের দিনের অঙ্গীকার। জাতীয় ইতিহাস ঐতিহ্য কৃষ্টি সংস্কৃতির শুদ্ধ ধারায় শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করে জীবনঘনিষ্ঠ জ্ঞানার্জনে সহায়ক হই। প্রজন্মান্তরে বিস্তরণ ঘটুক তথ্যপ্রযুুক্তি সমৃদ্ধ যুগোপযোগী জ্ঞানার্জন। গড়ে উঠুক সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ। সার্থক এবং সফল হোক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ।

লেখক : শিক্ষক ও সভাপতি
চট্টগ্রাম সাহিত্য পাঠচক্র