মহান মে দিবসে শ্রমিকদের প্রত্যাশা

60

এম.এ. সাত্তার

পৃথিবীর প্রতিটি দেশের বিভিন্ন বিষয়ে জাতীয় দিবসগুলো নিজেদের মত আলাদাভাবে পালিত হয়। কিন্তু জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একমাত্র এই দিবসটি পৃথিবীর সব দেশে একসঙ্গে একই দিন পালিত হয়। শ্রমিকদের ৮ শ্রমঘণ্টা প্রতিষ্ঠার দাবিতে, শ্রমিকেরা বুকের তাজা রক্ত বিসর্জন দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে এই মহান দিবস। আর তারই সুফল ভোগ করছে, শ্রমিক, কর্মচারী, কর্মকর্তা, আমলা শ্রমজীবী, কর্মজীবী, সকল পেশা এবং শ্রেণির মানুষ। প্রতিবছর এই দিনটি এলে পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান, মন্ত্রী, আমলা ব্যবসায়ী শ্রেণিসহ সকলেই সুন্দর সুন্দর বক্তব্য এবং আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে এই দিন পালন করছেন। শ্রমিকদের শ্রমঘণ্টাসহ বিভিন্ন দাবির কথা বলছেন। এই মহান দিনটির আনুষ্ঠানিকতা শেষে শোষকশ্রেণি তাদের দেয়া সুন্দর বক্তব্য বেমালুম ভুলে তাদের পুরাতন কায়দায় শ্রমিকদের বিভিন্নভাবে শোষণ করে আসছেন, এটাই বাস্তবতা। সভ্যতার কারিগর শ্রমিক সমাজ যাদের শ্রম এবং ঘামে গড়ে উঠেছে সভ্যতার নির্মাণশৈলী। যুগে যুগে জাতির উন্নয়নে তারা অবদান রেখে চলছে। শ্রমিকদের ২ হাত জাতিগঠনে যে অবদান রাখতে পারে তা অন্য কোনভাবে দ্রæত জাতি গঠনে তা সম্ভব নয়। আমরা গভীরভাবে উপলব্ধি করলে বুঝতে পারবো কতিপয় লোকের দেশপ্রেমে এবং জাতি গঠনে প্রয়োগে ঘাটতি রয়েছে। তাদের নিকট নিজের এবং ব্যক্তি জীবনের উন্নয়নই প্রাধান্য পেয়ে আসছে। মহান মে দিবসের প্রাক্কালে দুঃখ এবং ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলতে হয়, কথায় বলে সরিষায় রয়েছে ভ‚ত। একশ্রেণির শ্রমিকনেতা নামধারী আমলা, এবং দালালগোষ্ঠীর কারণে আমরা লজ্জিত না হয়ে পারিনা। আমাদের অনেক অর্জন আছে, ত্যাগ আছে, স্বাধীনতা সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলনসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শ্রমিকদের গৌরব উজ্জ্বল অনেক ত্যাগী ভূমিকার দৃষ্টান্ত আছে। কিন্তু গুটিকয়েক শ্রমিকনেতা নামধারীদের দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি চাঁদাবাজির কারণে যে কলংকের আবহ সৃষ্টি হয়ে ঢাকা পড়ে আছে এদেশের হাজারও গৌরবগাঁথা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দেশ জাতির সংকটময় মুহ‚র্তে শ্রমিক সমাজ তাদের অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে আন্দোলন এবং সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন, ইতিহাসে শ্রমিক সমাজের অনেক প্রাপ্তি এবং অর্জন রয়েছে। শ্রমিক আন্দোলনে কিছু সুবিধাভোগীর কারণে শ্রমিকদের অর্জন এবং অবদানের মাপকাঠি নিরূপণ ব্যাহত হচ্ছে। তারপরও শ্রমিকসমাজ, দেশ এবং জাতি গঠনে তাদের অবদান রেখে চলেছেন। শ্রমিকদের বড় কোন দাবি নয়। শ্রমিকেরা চায় তাদের বাঁচা মরার গ্র্যান্টি। অর্থাৎ মানুষের যে মৌলিক অধিকার অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসা। তাছাড়া উৎপাদন এবং উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করণের জন্য সুষ্ঠু কর্ম পরিবেশ, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা এবং শ্রমিকদের কল্যাণে বিভিন্ন গঠনমূলক পরিবেশ সৃষ্টি করে উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করা সময়ের দাবি। মালিক-শ্রমিক ঐক্য গড়ে তোলার মাধ্যমে সুষ্ঠু ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ধারা অব্যাহত থাকলে উৎপাদন ব্যাহত হবে না। মানসম্মত পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে বিশ্ব বাজারে টিকে থাকা এবং বাজার সৃষ্টির আধিক্য বিস্তার করাই হবে মূল উদ্দেশ্য। তাছাড়া লুটেরা অসাধু শিল্প মালিকের শোষণ বঞ্চনার অবসান হউক, সুষ্ঠু ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে উঠুক। শ্রমিক আন্দোলনের দিকে তাকালে দেখা যায়, শোষণ বঞ্চনা এবং শ্রমিক মালিকের মধ্যে বৈরীভাব এমনকি বহিরাগতদের হস্তক্ষেপ, দলীয় রাজনীতির আধিক্য, ক্ষমতার দাপট, ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া দখলবাজি ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মত নির্মম ঘটনা বিদ্যমান। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন রাজনীতিমুক্ত, দখলবাজ মুক্ত, শোষণ বঞ্চনা মুক্ত এবং শ্রমিক মালিক ঐক্য গড়ে নিয়মতান্ত্রিক এবং গঠনমূলক ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলতে আমুল পরিবর্তন এবং ট্রেড ইউনিয়নের উন্নয়ন। এটাই হউক মে দিবসের প্রত্যাশা।
১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে-মার্কেটে ৮ শ্রমঘণ্টার দাবিতে আন্দোলনের পূর্ণতা লাভ করে, কিন্তু এর পূর্বে ১৬৮৪ সালে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে শ্রমিকেরা ১৭৬৩-১৭৭০ সালে নিউইয়র্ক পিপা প্রস্তুতকারক শ্রমিকদের ইউনিয়ন গঠন করে। একইভাবে ১৭৭৮ সালে নিউইয়র্ক ঠিকা ছাপাখানার শ্রমিকেরা ঐক্যবদ্ধ হয়। আমেরিকার মহিলা দর্জি শ্রমিকেরা ১৮২৩ সালে ধর্মঘট করে। এতে শিল্প শ্রমিকেরা আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মঘটে যোগদেন। ১৮৭৪ সনে আমেরিকার চমকিন স্কয়ারে শ্রমিকদের এক জনসভায় পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। ১৮৭৫ সনে পেনসিলভা নয়া কয়লাশ্রমিকদের আন্দোলনে ১০ জন শ্রমিকনেতা গ্রেপ্তার হয়। তাদেরকে বর্বরোচিতভাবে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হয়। নিউইয়র্কে ১ম আন্তর্জাতিক সম্মেলন বাতিল হয়ে যায়। ১৮৭৬ এবং ১৮৭৭ সনে আমেরিকার ইস্পাত ও রেলশ্রমিকেরা ধর্মঘট করে। ১৮৮৪ – ১৮৮৬ সালের প্রথম দিকে ফ্রান্সের কয়লাশ্রমিকেরা দীর্ঘ কঠিন ধর্মঘট করে। ১৮৮৪-১৮৮৬ আমেরিকা মাত্র ২ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই হাজার ২ শতাধিক শিল্প কারখানার ৩০৯২ টি ধর্মঘট সংঘটিত হয়। ১৮৮৪ সালে ৭ অক্টোবর সম্মিলিত শ্রমিক আন্দোলনে ৮ শ্রমঘণ্টার দাবিতে ১৮৮৬ সনে ১ এপ্রিল কয়েকটি শ্রমিক সংগঠনের সভায় প্রায় ২১ হাজার শ্রমিক যোগদান করে। সেসময় শ্রমিকনেতা আলবার্ট পারসন্স, আগস্ট, স্পাইজ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। ১৮৮৬ সালে ১ মে দেশব্যাপী ধর্মঘটে প্রায় ৩ লক্ষাধিক শ্রমিক অংশগ্রহণ করেন এবং দেশ অচল করে দেয়। ৮ শ্রমঘণ্টার দাবিতে শ্রমিকনেতা পারসন্স ও তার স্ত্রী লুসীর নেতৃত্বে ৮০ হাজার শ্রমিক অংশগ্রহণ করে এবং শিকাগোর শ্রমিক সভায় ৮ শ্রমঘণ্টার দাবিতে লাগাতার ধর্মঘটের ডাক দেয়। ধর্মঘটের ২য় দিনে রবিবার ২ মে একই সময় আমেরিকার সিকাগো শহরে মেককমিক কৃষিযন্ত্রের শ্রমিকদের ছাঁটাইকৃত শ্রমিকদের ছাঁটাইয়ের পূর্বে ধর্মঘট পালন করেছিল। ধর্মঘটিদের ধর্মঘটে সংহতি জানাতে কারখানার শ্রমিকেরা মিছিল নিয়ে আসতেই মালিকের লেলিয়ে দেয়া পুলিশবাহিনী মিছিলে গুলিবর্ষণ করে। এতে ৬ জন শ্রমিক মারা যায়। এই হত্যাকাÐের প্রতিবাদে আমেরিকা, কানাডা, সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় উঠে এবং ৪ মে হে- মার্কেট চত্বরে শ্রমিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে বোমায় ২ জন, ও পরে আরও ৬ জন মোট ৮ জন পুলিশ নিহত হয়। ২০০ মত শ্রমিক আহত হয়। ৪ জন শ্রমিকনেতা নিহত হয়। গ্রেপ্তার হয় শ্রমিকনেতা স্পাইজ, জর্জ এঞ্জেল, ফিলডেন মাইকেল, স্কোয়ার এডলক ফিসার, লুইস লিঙ্গে এবং অস্কার নিবকো গ্রেপ্তার হওয়া নেতাদের বিচারের নামে শুরু হয় প্রহসন ও ফাঁসিতে ঝুলানোর নির্মম সিদ্ধান্ত। এই সকল শ্রমিকনেতাদের আত্মাহুতি এবং তাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই দিনটি যেমন দুঃখের তেমনি আনন্দের। মালিক-শ্রমিক বাঁধো জোট এই নীতিতে কল-কারখানার উন্নয়ন নিশ্চিত করে উৎপাদন এবং উৎপাদিত পণ্যের গুণগতমান বজায় রেখে শ্রমিকদের ৮ শ্রমঘণ্টা নির্ধারণ করে উৎপাদনের এবং উন্নয়নের চাকার সমন্বয় ঘটিয়ে দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিতার প্রাধান্যের বলয় থেকে শ্রমিকদের মুক্ত করে গঠনমূলক সুষ্ঠু ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে উঠুক। এই প্রত্যাশায় মহান মে-দিবস দীর্ঘজীবী হউক।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, শ্রমিকনেতা ও প্রাবন্ধিক