ভারি বর্ষণে রাঙ্গুনিয়ায় পাহাড়ধস, আহত ১

20

রাঙ্গুনিয়া, রাউজান ও সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি
গত কয়েকদিনের টানা ভারি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে রাঙ্গুনিয়া, রাউজান ও সীতাকুÐ উপজেলার হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানির নিচে তলিয়ে গেছে শতাধিক ঘর-বাড়ি।
টানা বর্ষণে রাঙ্গুনিয়ার বিভিন্ন ইউনিয়নে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় অন্তত ৩০টি বসতঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। তবে আগে থেকে পরিবারগুলো সরিয়ে নেয়ায় প্রাণহানী হয়নি। উপজেলার বেতাগী ইউনিয়নের একটি বসতঘরে পাহাড় ধসের ঘটনায় এক গর্ভবতী নারী গুরুতর আহত হয়েছেন। তার নাম সায়েমা সুলতানা (২২)। তিনি উপজেলার বেতাগী ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ড হাজী মোজাহের বাড়ির আবু নাছেরের স্ত্রী। তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
পাহাড় ধসের ব্যাপারে কয়েকজন জানান, স্থানীয় আনোয়ার হোসেন ও আজিম সওদাগর নামে দুই ভাই খাস মালিকানাধীন পাহাড়টির দখলদার। তারা গত এক বছর ধরে পাহাড়টি কাটছেন। এতে গত বছরও পাহাড় ধসে একটি বসতঘরের দেয়াল ভেঙেছিল। এরপরও পাহাড় কাটা অব্যাহত রাখে। গত রবিবার রাত ৮টার দিকে পাহাড়টি তাদের বসতঘরের উপর ধসে পড়ে। এতে রান্না করার সময় গৃহবধূ সায়েমা সুলতানা মাটিচাপা পড়েন। তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার পায়ের সব আঙ্গুল ভেঙে যায়, দুই পায়ের গোড়ালিতেই ক্ষত হয়। ৭ মাসের অন্তঃসত্ত¡া ওই নারী আশঙ্কামুক্ত হলেও পেটের বাচ্চার অবস্থা পরীক্ষা করে জানাতে পারবেন বলে জানান দায়িত্বরত চিকিৎসক।
সরেজমিনে দেখা যায়, পাহাড়টি কেটে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পাহাড়ের দুই পাশে ধসে পড়ার চিহ্ন রয়েছে। একটি বসতঘরে পাহাড়টির মাটি ধসে পড়ে ধ্বংস স্তুপের সৃষ্টি হয়েছে। এখনো পাহাড়টির আশেপাশে ঝুঁকি নিয়ে থাকছেন অন্তত ১০টি পরিবার। তবে পাহাড় কাটার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত আজিম সওদাগর। এটি কারা কেটেছে সেটি তিনি জানেন না বলে জানান।
এসময় ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসা বেতাগী ইউপি চেয়ারম্যান শফিউল আলম জানান, পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস ঠেকাতে বেতাগী জুড়ে গত কয়েকদিন ধরে মাইকিংসহ নানাভাবে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এরপরও ঝুঁকিপূর্ণভাবে থাকার কারণে এই ঘটনা ঘটেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ইসলামপুরে ৩টি, পারুয়ায় ১০টি এবং চন্দ্রঘোনায় ১৬টি বসতঘরে পাহাড় ধসে বিধ্বস্ত হয়েছে। এসব ইউনিয়নের স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানবৃন্দ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে এসব ঘরের বাসিন্দাদের আগে থেকেই নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ায় প্রাণহানী থেকে রক্ষা পায় তারা। এছাড়া কাপ্তাই সড়কের সত্যপীর মাজার এলাকায় পাহাড় ধসে পড়ে যানবাহন চলাচল ব্যাহত হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে এসে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করে।
অন্যদিকে রাঙ্গুনিয়ার ১৫ ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত অন্তত ১০ হাজার পরিবার পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে বলে জানা যায়। তাদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হলেও তারা সরছে না জানাচ্ছেন স্থানীয়রা। এছাড়া কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টিতে রাঙ্গুনিয়ার নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আতাউল গণি ওসমানী জানান, পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস রোধে গত তিনদিন ধরে মাইকিং করা হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলা হয়েছে। নিকটস্থ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যারা এখনো পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে থাকছেন তাদের সরিয়ে নিতে প্রয়োজনে অভিযান চালানো হবে।
নিরাপদ স্থানে সরে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে। রাঙ্গুনিয়ায় কয়েকটি ইউনিয়নে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় উপজেলার প্রবেশপথ জিয়ানগর এলাকায় কাপ্তাই সড়কে পাহাড়ধসের কারণে দীর্ঘক্ষণ যান চলাচল বন্ধ ছিল। পরে ফায়ার সার্ভিস এসে মাটি সরিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক করে।
ভারিবৃষ্টির কারণে উপজেলার পাহড়ি অঞ্চলে দেখা দিয়েছে পাহাড় ধস ও বন্যার শঙ্কা। ইতোমধ্যেই বন্যার পানিতে গøাবিত হয়েছে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামীণ সড়ক। ডুবে গেছে বিচ্ছিন্ন হয়েছে এলাকাভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থা।
গত শনিবার সকাল থেকেই উপজেলাজুড়ে মাইকিংয়ের মাধ্যমে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের নিরাপদস্থানে সরে যেতে সতর্ক সংকেত দিচ্ছেন উপজেলা প্রশাসন। তবে যারা যারা সরবে না, তাদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সরিয়ে দেয়া হবে।
এদিকে প্রতিটি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদেরও ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে নির্দেশনা দিয়েছেন ইউএনও।
উপজেলায় পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে বসবাস করছে প্রায় ৬ হাজার মানুষ। ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া না হলে যেকোনো সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) জামশেদুল আলম বলেন, ‘পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে যারা বসবাস করছেন তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যারা সরবে না, তাদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সরিয়ে দেয়া হবে। প্রত্যেক ইউনিয়নে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখতে।’ উল্লেথ্য পাহাড় ধ্বসে গত দুবছর আগে ২২ জনের প্রান হানি হয়েছে।
এদিকে গতকাল সোমবার রাত ১০টায় রাউজান উপজেলার পৌরসভা, ডাবুয়া, হলদিয়া রাউজান সদর ইউনিয়নের হাফেজ বজলুর রহমান সড়কের নাতোয়ান বাগিয়া পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বাঁশের সাঁকো দিয়েই পারাপার হতে হচ্ছে স্থানীয়দের। একই ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড অংশে খালের বাধ পেরিয়ে বৃষ্টির পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানির ¯্রােতে স্থানীয় হযরত রুস্তম শাহ সড়কের সেতু ভেঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ভারি বর্ষণে পাহাড়তলীতে দুটি কাঁচা বসতঘর ধসে পড়েছে। মানবেতর জীবন-যাপন করছেন বাড়ির বাসিন্দারা। এসময় ঘরে থাকা আশা দাশ ও বৃত্তি দাশ নামে দুই নারী আহত হন।
রাউজান সদর ইউনিয়নে ক্ষতিগ্রস্ত কালভার্ট ও রাস্তা পরিদর্শন করেছেন স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান বিএম জসিম উদ্দিন হিরু। এসময় উপস্থিত ছিলেন রাউজান ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্য এম মোজাম্মেল হক খোকন।
পরিদর্শনের সময় ইউপি চেয়ারম্যান সড়কে হযরত রুস্তম শাহ কালভার্ট দ্রæত মেরামতের আশ্বাস দেন।
অন্যদিকে গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে সীতাকুÐ পৌরসভা ও উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে জলমগ্ন হয়ে পড়েছে হাজারো মানুষ। বেশিরভাগ গ্রাম্য সড়ক পানির নিচে তলিয়ে গেছে। কয়েকটি বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে পানি জমে থাকায় পাঠদান ব্যাহত হয়েছে।
জানা যায়, সীতাকুÐ পৌরসদর নামার বাজার সড়ক ও শতাধিক বসতবাড়ি পানির নিচে থাকায় স্থানীয়দের মানবেতর দিন কাটছে। এছাড়া আমিরাবাদ, শিবপুরসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে পানিবন্দী রয়েছে মানুষ। পানিবন্দী থাকায় সোমবার সকালে কাজের সন্ধানী মানুষ সড়ক দিয়ে আসার সময় ড্রেনে পড়ে আহত হওয়ার মত ঘটনাও ঘটেছে। উপজেলার সৈয়দপুর মধ্যেরদারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি উঠায় কোমলমতি শিশুদের পাঠদানে বিঘœ ঘটে। শিক্ষকরা বাধ্য হয়ে পানিতে নিমজ্জিত ক্লাসে পাঠদান করান শিশুদের। একইভাবে উপজেলার সোনাইছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাস রুমে পানি ঢুকায় পাঠদান ব্যাহত হয়। বিদ্যালয় মাঠে ছিল কোমর সমপরিমাণ পানি। ছাত্র-ছাত্রীরা কষ্ট করে বিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন। উপজেলার ভাটিয়ারি, সোনাইছড়ি, কুমিরা, বাঁশবাড়িয়া, মুরাদপুর ও সৈয়দপুর ইউনিয়নের বেশির ভাগ সড়ক পানিতে ডুবে ছিল। এসব এলাকার বেশিরভাগ বসতঘরের বারান্দায় পানি উঠেছে। গ্রামীণ সড়ক পানিতে ডুবে থাকায় স্থানীয়দের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। অনেককে আবার ডুবে থাকা সড়কে জাল দিয়ে মাছ ধরতে দেখা গেছে। তলিয়ে গেছে স্থানীয় শত শত পুকুর। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মৎস্য চাষীরা।
সীতাকুÐ নামার বাজার এলাকার ব্যবসায়ী মিন্টু বলেন, “কিছু লোকের জন্য আমাদের নামার বাজার এলাকার পানি দ্রæত নামছে না। আজও (সোমবার) চাকুরিজীবী এক লোক ড্রেনে পড়ে পানিতে চলে যাওয়ার সময় আমি ও অন্যরা মিলে তাকে উদ্ধার করি। এ সময় সেই আহত হয়। বর্ষা আসলে আমার দোকানে পানি ডুকে হাজার হাজার টাকা জিনিস-পত্রের ক্ষতি হয়। কিন্তু বর্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথে সবাই ফের ভুলে যায়।”
এসব বিষয়ে সীতাকুÐ পৌরসভার মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা বদিউল আলম বলেন, “প্রতি বছর আমরা শুষ্ক মৌসুমে পৌরসভার সব ড্রেন পরিষ্কার করেছি। মূলত বড় খালগুলো দীর্ঘ সময় সংস্কার না করায় এই জলবদ্ধতা। আমার বাড়ির এলাকা অনেক উঁচু জায়গায়, সেখানেও এবার পানি উঠেছে। পানি নিষ্কাশনের জন্য বড় বড় খাল সংস্কার করে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ না নিলে এই জলবদ্ধতা রোধ করা সম্ভব নয় বলে আমি মনে করি।”