বৌদ্ধবন্ধু আবদুল্লাহ আল-হারুন চৌধুরী

58

বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহচর, অসংখ্য জনহিতকর প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা, অধুনালুপ্ত দৈনিক স্বাধীনতা পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, ভাষাসৈনিক, এককালের তুখোড় ছাত্রনেতা মরহুম আবদুল্লাহ আল-হারুন চৌধুরীর নাম মনে আসতেই শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে পড়ে। তাঁর দৈহিক সৌন্দর্য এবং মনোমুগ্ধকর হাসি, পরকে আপন করার অসীম ক্ষমতার অধিকারী এ মানুষটির সান্নিধ্যে আসতে পেরে নিজেকে ধন্য এবং গৌরবান্বিত মনে করি। মূলত আমি কোনদিন একনিষ্ঠ রাজনীতিবিদ ছিলাম না। তবে ছোটবেলা থেকে সমাজকর্মের সাথে সম্পৃক্ত থেকে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে তাঁর সান্নিধ্যে আসা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম ছিল। যে নির্বাচনে সমগ্র পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। বঙ্গবন্ধুর আহব্বানে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মধ্য দিয়ে এ দেশের নিপীড়িত জনতার দীর্ঘদিনের সংগ্রামে সাফল্য আসে। এ নির্বাচনে রাউজান নির্বাচনী এলাকা থেকে দৈনিক আজাদীর সম্পাদক, বিশিষ্ট সংগঠক অধ্যাপক মো. খালেদ জাতীয় পরিষদে এবং চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব আবদুল্লাহ আল-হারুন চৌধুরী বিপুল ভোটাধিক্যে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা-উত্তরকালে যা গণপরিষদ নামে পরিচিতি লাভ করে। এই নির্বাচনের সময় তিনি রাউজানের বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে পরিদর্শন করার এক পর্যায়ে আমার স্বগ্রাম কদলপুর ইউনিয়নে আসলে আমার তাঁর সান্নিধ্যে আসার দুর্লভ সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে কদলপুর ইউনিয়ন পরিষদের মনোনীত চেয়ারম্যান মরহুম মুছা মিয়া চৌধুরীর সাথে চট্টগ্রাম শহরে তাঁর বাসায় আসা-যাওয়ার মাধ্যমে এবং বিভিন্ন সভা, সমিতি, জনসভা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে যোগদানের ফলে তাঁর সাথে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। প্রায় সারাজীবন সরকারি-আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার ফলে আমার একনিষ্ঠভাবে রাজনীতি করার সুযোগ হয়নি। তবে স্কুল-কলেজে অধ্যয়নকালে ছাত্র রাজনীতি করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসেবে ছাত্রলীগ করার সুবাদে সহজে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছি। তাই আমি নিজেকে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মনে করি। কারণ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এবং আওয়ামী লীগের সংগ্রামের মাধ্যমে এদেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচন চলাকালীন সময় থেকে তাঁর মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর প্রতিটি কাজকর্মের একান্ত সমর্থক হিসেবে থাকতে পেরেছি।
এখনও তাঁর অসংখ্য স্মৃতি মানসপটে ভেসে বেড়ায়। সর্বশেষ একটি স্মৃতির কথা মনে পড়লে একদিকে যেমন পুলকিত হই অন্যদিকে তেমনি ব্যথিত হয়ে পড়ি। সন বা তারিখ সঠিক মনে নেই। বেশ কয়েকবছর আগে একবার সপরিবারে ঢাকা যাওয়ার সময় তিনি মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চট্টগ্রামের খুলশীস্থ হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকেন। এমতাবস্থায় এক সন্ধ্যায় আমাদের সংগঠনের মহাসচিব অধ্যক্ষ ডক্টর প্রণব কুমার বড়ুয়াসহ আমি তাঁকে দেখতে যাই। চোখসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যান্ডেজ। তার শয্যাপাশে দাঁড়িয়ে যখন আমরা উভয়ে তাঁর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি তখনই সাথে সাথে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন “অমলেন্দু বাবু” আপনি কেমন আছেন? প্রণব তুমি কেমন আছো? উল্লেখ্য, প্রণব বাবু বাল্যকাল থেকেই তাঁর বন্ধু হিসেবে সুপরিচিত। তাঁর নিজের সুস্থতার প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে আমাদের শুভাশুভ সম্পর্কে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। এরকম কত স্মৃতি আজ তাঁর অনুপস্থিতিতে মনে পড়ে। তাঁর আরো একটা সুখকর স্মৃতি আমার মনে প্রচন্ড দাগ কাটে। ১৯৭৮ সালে আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় মহামান্য মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের যখন চট্টগ্রাম শহরে একখানা জায়গার জন্য চারদিকে হন্যে হয়ে খোঁজ করছেন, তখন তিনি খবর পেয়ে তাঁর আত্মীয় কুমিল্লা চিওরা কাজী বাড়ির স্বনামধন্য ব্যবসায়ী জনাব কাজী জাকির হোসেন একন্ড জমি বিক্রয়ের খবর দেন। তারপর অনেক দেন-দরবারের পর তাঁর মধ্যস্থতায় বর্তমান ১৫, কাতালগঞ্জস্থ নবপন্ডিত বিহারের জমি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অতঃপর এ জমির রেজিস্ট্রেশনের ব্যাপারে সেপ্টেম্বর ১৯৭৮ সালে একদিন মেঘলা সকাল বেলায় জামালখান সড়কস্থ ‘দৈনিক স্বাধীনতা’ পত্রিকা অফিসে উভয় পক্ষের বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয়। সেই বৈঠকে মহামান্য মহাসংঘনায়ক বড়ভান্তে, সুগতানন্দ ভান্তে, প্রফুল্ল বাবু, বসুভূতি মুৎসুদ্দী, বড়ভান্তের বেহাই শশধর বাবু, প্রণব বাবু, সুদত্ত বাবু, বোধিপাল ভান্তে, রাজগুরু বিজয়ানন্দ ভান্তে প্রমুখ অফিসের অভ্যন্তরে অবস্থান করছেন। তখন আনুমানিক বেলা ১০ টা। অপরপক্ষে জনাব কাজী জাকির হোসেনসহ সবাই হারুন সাহেবের আগমনের অপেক্ষায়। আমি আর ইন্দুবাবু বাহিরের কামরায় অপেক্ষমাণ। কিছুক্ষণ পর হারুন ভাই স্বাধীনতা অফিস কক্ষে ঢুকেই আমাকে আর ইন্দুবাবুকে দেখে সাদরে ভিতরে নিয়ে গেলেন এবং সেদিনই বর্তমান ১৫ কাতালগঞ্জস্থ নবপন্ডিত বিহারের জায়গায় বায়নানামা সম্পাদিত হয়। সেদিনও তাঁর আন্তরিকতা আমাকে অতীব মুগ্ধ করে।
অসা¤প্রদায়িক ও মানবতাবাদী এ মহান নেতার কত যে গুণ ছিল তা ক্ষুদ্র পরিসরে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তাঁর মধ্যে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান কোন ভেদাভেদ ছিল না, তাঁর কাছে সবাই সমান। রাউজানে ঘুণেধরা রাজনীতির বিষবাষ্পে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় জনগণ যখন মুক্তির নেশায় পাগল, তখনই বঙ্গবন্ধুর আহব্বানে তিনি এগিয়ে এলেন, সেই শান্তির বারতা নিয়ে। সফলতাও তাঁর জীবনে কম আসেনি। অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও তিনি কোনদিন নীতিচ্যুত হননি। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার জন্য কাজ করে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন সাধারণ মানুষের ওপর এদেশীয় পাকিস্তানি দোসরেরা নিপীড়ন ও নির্যাতনে লিপ্ত তখন তিনি সকলের পাশে এসে দাঁড়ান। বিশেষ করে সংখ্যালঘু-স¤প্রদায়ের নিরাপত্তায় বিশেষ ব্যবস্থা নেন। রাউজানের প্রতিটি হিন্দু ও বৌদ্ধ গ্রামে স্বয়ং তিনি নিজে এবং প্রয়োজনে কর্মীবাহিনী সহকারে সকলকে রক্ষায় এগিয়ে আসেন। ১৯৭১ এর মুক্তি সংগ্রামে তিনি বৌদ্ধদের পাশে এমনভাবে দাঁড়ালেন যে, রাজাকার আলবদরসহ অন্য কেউ আর তাদের আক্রমণ করার সাহস করেনি। এমনকি প্রতিটি বৌদ্ধ গ্রাম ও বৌদ্ধ পরিবারে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি গড়ে উঠে। অনেকেই শহীদ হন। তাঁর যোগ্য নেতৃত্ব ও অসীম সাহসিকতা এবং সর্বোপরি বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারের জন্য তাঁকে বৌদ্ধদের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বৌদ্ধবন্ধু’ অভিধায় অভিষিক্ত করা হয়।
তিনি অত্যন্ত শিক্ষানুরাগী ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত সহযোগিতায় রাউজানের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উপকৃত হয়েছে। বিশেষ করে আমার প্রিয় বিদ্যাপীঠ রাউজান আর্যমৈত্রেয় স্কুলের স¤প্রসারণ, উন্নয়ন ও আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলায় তাঁর অবদান অপরিসীম। অন্যদিকে তিনি ছিলেন বন্ধুবৎসল ও অতিথিপরায়ণ। সময়ে-অসময়ে তাঁর বাসায় কেউ আপ্যায়ন ছাড়া বা অভুক্ত অবস্থায় ফিরে যেতে পারেনি। তাঁর মতো নেতা আজকের দিনে আমাদের বড়ই প্রয়োজন। তাই তাঁর কথা বারবার মনে পড়ে। তাঁর মৃত্যুর পর আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁর দেওয়ানবাজারস্থ বাসায় গিয়ে তাঁর স্ত্রী, পুত্র-কন্যাসহ সকলের সাথে দেখা করে তাদের প্রতি বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সকল অঙ্গ সংগঠনের পক্ষ থেকে শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়। আমাদের সংগঠনের প্রাণপুরুষ প্রয়াত মহামান্য মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত নবপন্ডিত বিহারে সকল কর্মকর্তা ও সদস্য-সদস্যাবৃন্দ তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার-মাগফেরাত কামনা করি। তাঁর স্ত্রী, পুত্র-কন্যাসহ সকল আত্মীয়-স্বজনের নিরাময় দীর্ঘজীবন কামনা করি।

লেখক: সংগঠক, শিক্ষানুরাগী ও বৌদ্ধ চিন্তাবিদ