বেপরোয়া সোর্সদের লাগাম টানবে কে?

12

নগরীতে যে কোনও অপরাধ ও অপরাধীদের তথ্য সংগ্রহের জন্য সোর্স বা তথ্যদাতা হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ব্যবহার করেন পুলিশ কর্মকর্তারা। লিখিত কোনও নিয়োগ না থাকলেও অপরাধীদের পাকড়াও করতে এসব সোর্সই মূল ভরসা পুলিশ কর্মকর্তাদের। তবে এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কথিত সোর্সরা। কথিত সোর্সদের এমন কয়েকটা অপরাধ প্রকাশ্যে আসলেও বেশির ভাগই থেকে যাচ্ছে আড়ালে। কেউ কেউ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সুনির্দিষ্ট বিধান না থাকায় পুলিশের সোর্স বিষয়টি জবাবদিহিতার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এ সুযোগে সোর্সরা অনেক সময় পুলিশকে ব্যবহার করে ফেলে। পুলিশও সোর্সদের দেয়া তথ্য যথাযথভাবে যাচাই না করেই অভিযান চালায়। এতে অনেক সময় নিরীহ মানুষও বড় ক্ষতির শিকার হচ্ছেন।
নগরবাসীর প্রশ্ন, কথিত সোর্সদের লাগাম টানবে কে? অভিযোগ রয়েছে, তথ্য সংগ্রহের চেয়ে সামারি-বাণিজ্যের জন্যই পুলিশের একশ্রেণির কর্মকর্তা এদের বেশি ব্যবহার করে।
পুলিশের সোর্স বা তথ্যদাতা সম্পর্কে সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর পূর্বদেশকে বলেন, গোপন তথ্য অনুসন্ধান করে বের করাই হল সোর্স ব্যবহারের মূল উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে একজন সাধারণ মানুষও পুলিশে সোর্স হতে পারেন। আবার সমাজের কোনও বিজ্ঞজনও হতে পারেন সোর্স। মসজিদের ইমাম, শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তার- যে কেউ সোর্স হতে পারেন। কখনও কোন ঘটনা বা চক্রের সাথে জড়িত কাউকে সোর্স করা যেতে পারে। তবে এর পুরোটাই নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার দক্ষতা বা কৌশলের ওপর।
সিএমপির এ শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, কাগজে-কলমে স্বীকৃত কোনও সোর্স রাখার নিয়ম নেই। তাই কোনও ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্ট সোর্স বলা যাবে না বা কেউ নিজেকে সোর্স বলেও দাবি করতে পারবে না। সিএমপিতে অপরাধ বিভাগের ডিসিদের (উপ-কমিশনার) স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছি, কেউ যাতে পুলিশের কোনও কর্মকর্তার সোর্স বলে দাবি করতে না পারে। এরপরও যদি কোনও সোর্স অপরাধে জড়ায়, তাহলে তার দায়-দায়িত্বও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বহন করতে হবে। কেউ জনসমক্ষে নিজেকে সোর্স বলে পরিচয় দিলে তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। একইসাথে তার প্রশ্রয়দাতাকেও জবাবদিহিতার মধ্যে আসতে হবে। সিএমপিতে কোনও সোর্স নেই। আমরা আমাদের গোয়েন্দা বিভাগকে অধিকতর শক্তিশালী করেছি। পাশাপাশি কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমকে জোরদার করেছি। বিট পুৃলিশিং চলছে, যাতে জনগণই আমাদের সোর্স হয়ে উঠে। আমরা মনে করতে চাই, পুরো নগরবাসীই আমাদের সোর্স।
পুলিশের তথ্যমতে, বিদায়ী বছরের ৯ অক্টোবর জেলার রাঙ্গুনিয়া থেকে শহরে আসার পথে চান্দগাঁও থানার মৌলভীপুকুর পাড় এলাকায় এক গৃহবধূ গণধর্ষণের শিকার হন। অভিযোগ পেয়ে পুলিশ ঘটনায় জড়িত এক নারীসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করে। এদের মধ্যে ঘটনার মূল হোতা জাহাঙ্গীর ও রিপন পুলিশের সোর্স। একইভাবে গত ২৭ সেপ্টেম্বর নিজের ফুপাতো বোনের বান্ধবীর সহযোগিতায় ডবলমুরিং থানার সুপারিওয়ালাপাড়ার একটি বাসায় ধর্ষণের শিকার হন স্বর্ণা নামের এক কিশোরী। ধর্ষণের মূল হোতা পুলিশের কথিত সোর্স চান্দু মিয়া। তার বিরুদ্ধ পুলিশের সোর্স পরিচয় দিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার অভিযোগ রয়েছে। এর আগে গত বছরের ২৯ আগস্ট রাতে নগরীর রৌফাবাদের বাসায় ফেরার পথে বায়েজিদ থানার অক্সিজেন মোড়ে শফি নামের এক ব্যক্তি বাদশা মিয়া আর রবিনকে সঙ্গে নিয়ে তাদের পথ আটকান স্বামী-স্ত্রী দুজনের। তারা দুজন স্বামী ও স্ত্রী নয়- এমন দাবি করে পুলিশে দেয়ার হুমকি দেয় তারা। পরে সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিক্শা করে তুলে নিয়ে অদূরে ছালমা কলোনিতে রাত আড়াইটা পর্যন্ত পাঁচজন মিলে পালাক্রমে ধর্ষণ করে স্ত্রীকে। এ ঘটনার মূলহোতা শফি পুলিশের কথিত সোর্স। ঘটনার পর অন্য আসামিরা গ্রেপ্তার হলেও পুলিশের কথিত সোর্স শফি এখনও পলাতক। গত বছরের ১৬ জুলাই মধ্যরাতে নগরীর ডবলমুরিংয়ের আগ্রাবাদে একটি বাসায় চুরির আসামি ধরতে গিয়ে পুলিশ মারধর করেন এক কিশোরকে এবং অপদস্থ করেন তার মা-বোনকে। এ অপমানে নিজ ঘরের সিলিংয়ে ঝুলে আত্মহত্যা করে ওই কিশোর। এজন্য দায়ী করা হয় ডবলমুরিং থানার এসআই হেলাল ছাড়াও পুলিশের দুই কথিত সোর্সকে। পরে অবশ্য হেলালকে বরখাস্ত করা হলেও অধরাই থেকে যান সেই সোর্সরা।
একইভাবে কোতোয়ালিথানা এলাকায় মনির ওরফে মোটা মনির ও জনি নামে কথিত দুই সোর্সের দাপটে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ। এসব সোর্সদের বিরুদ্ধে মাদক দিয়ে ফাঁসানো এবং হয়রানিসহ মামলা দেয়ার অভিযোগও কম নয়। এমনকি তাদের অনেকে নিজেও কথিত ‘সোর্সগিরির’ আড়ালে মাদক সেবন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
গত বছরের ১৫ মে জহিরুল ইসলাম নামে একজনকে বাকলিয়া থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তিনি নিজেকে সোর্স হিসেবে পরিচয় দিতেন। এর আড়ালেই মূলত বিক্রি করতেন ইয়াবা।
সোর্স নামধারী অপরাধীদের বিষয়টি সিএমপিতে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয় পুলিশের অব্যাহতিপ্রাপ্ত এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যার ঘটনায়। বিগত ২০১৬ সালের ৫ জুন নগরীর জিইসি মোড়ে বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতুকে হত্যার নির্দেশদাতা ছিলেন তারই কথিত সোর্স আবু মুছা। অস্ত্র সরবরাহ করে অপর সোর্স এহতেশামুল হক ওরফে ভোলা। সেই আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ছোড়া গুলিতে খুন হন মিতু। সিএমপিতে এমন অনেক ঘটনা ঘটিয়েছে পুলিশের কথিত সোর্সরা।
কয়েকটি ঘটনা প্রকাশ্যে আসলেও অনেক ঘটনা থেকে গেছে আড়ালে। পুলিশ রাজনৈতিক দলের কর্মী, ছোটখাট অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়া দাগী আসামি, স্থানীয় বাসিন্দা, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিসহ সাধারণ মানুষকে সোর্স হিসেবে ব্যবহার করে। বিশেষ করে উপ-পরিদর্শক (এসআই) ও সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) পদমর্যাদার কর্মকর্তারাই কথিত এসব সোর্সকে কাজে লাগান। অনেক সোর্সের কাছে থানা পুলিশের দেয়া বিশেষ চিহ্নযুক্ত পরিচয়পত্রও রয়েছে বলে জানা গেছে।