বুদ্ধিজীবী হত্যার ছক?

60

১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর দিনটি ছিল রবিবার। ঢাকায় সামরিক অবস্থানের ওপর যৌথবাহিনীর বিমান হামলা অব্যাহত থাকে। এইদিন ঢাকায় কোনো সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়নি । আগেরদিন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র রাশিয়ার প্রতিনিধি ভোরেন্টসভকে হুঁশিয়ার করে বলেন,পরদিন (১২ ডিসেম্বর) মধ্যাহ্নের আগে ভারতকে অবশ্যই যুদ্ধ বিরতি মেনে নিতে বাধ্য করতে হবে। অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কিন্তু কিসিঞ্জার নিশ্চয়ই জানতেন, রণাঙ্গনে আসন্ন বিজয় দৃষ্টে ভারত এই চরমপত্র অগ্রাহ্য করবেই। কাজেই মার্কিন প্রশাসন ঐ দিনই কোন এক সময়ে তাদের আসন্ন হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত পাকিস্তানকে জানিয়ে দেন-উপমহাদেশে তখন ১২ই ডিসেম্বর। এই সংবাদ সঙ্গে সঙ্গে ঈএঝ লে. জেনারেল গুল হাসান টেলিফোনে পশতুন ভাষায় নিয়াজীকে জানিয়ে দেন, পরদিন অর্থাৎ ১৩ই ডিসেম্বরের মধ্যাহ্নে পাকিস্তানী বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য ‘উত্তর ও দক্ষিণ উভয় দিক থেকে বন্ধুরা এসে পৌঁছবে। দক্ষিণের বন্ধু তথা সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগর অবধি আসার জন্য মার্কিন নাগরিক উদ্ধারের যে অজুহাত ব্যবহার করে সেই মার্কিন ও অন্যান্য পাশ্চাত্য নাগরিকদের উদ্ধারকর্ম তিনটি ব্রিটিশ রয়েল এয়ারফোর্সের বিমান কর্তৃক ১২ তারিখেই সম্পন্ন হয়। গুল হাসানের সংবাদের পর ঢাকার সামরিক কর্তৃপক্ষ নিজেদের প্রতিরক্ষার আয়োজন নিরঙ্কুশ করার জন্য চব্বিশ ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারী করে ঘরে ঘরে তল্লাশী শুরু করে। এইদিন রাতে প্রাদেশিক সরকারের বেসামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী আল-বদর ও আল-শামসের কেন্দ্রীয় অধিনায়কদের ডেকে পাঠান সদর দফতরে। তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় গোপন শলা-পরামর্শ। এই বৈঠকে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করা হয়। রাও ফরমান আলী তাদের হাতে তুলে দেন বুদ্ধিজীবীসহ বিশেষ বিশেষ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের নামের তালিকা। বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা হিসাবে সেই রাতেই আলবদর বাহিনী সাংবাদিক নিজামউদ্দিন আহমদ, আ.ন.ম. গোলাম মোস্তফাকে তাঁদের বাসভবন থেকে অপহরণ করে। ওরা যখন বাসায় হানা দেয় তখন নিজামউদ্দিন বিবিসির জন্য সংবাদ লিখে খেতে বসেছিলেন। ঐ অবস্থায় ধরে নিয়ে আলবদররা তাঁকে হত্যা করে। ঢাকা সেনানিবাসের নিরাপদ আশ্রয়ে বসে জেনারেল নিয়াজী বলেন, একটি প্রাণ জীবিত থাকা পর্যন্ত প্রতি ইঞ্চি জায়গার জন্য আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবো। পাকিস্তানীদর শেষ লড়াইয়ের প্রস্তুতি সত্তে¡ও রণাঙ্গনে তাদের পশ্চাদপসরণের ধারা এখনও অপরিবর্তিত। সকাল আটটায় নরসিংদীর উপর পাকিস্তানী দখলদারিত্বের অবসান ঘটে। বিকেলে ভারতের আর একটি ইউনিট (৪ গার্ডস) ডেমরা ঘাট থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে এসে হাজির হয়। জামালপুর থেকে পালিয়ে আসা কিছু শত্রæসৈন্য ও ময়মনসিংহ থেকে বিতারিত শত্রæরা টাঙ্গাইলে সহযোদ্ধাদের সাথে যোগ দিয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সূর্যাস্তের আগে জামালপুর ও ময়মনসিংহের দিক থেকে জেনারেল নাগেরার বাহিনী টাঙ্গাইলে প্যারাস্যুট ব্যাটেলিয়নের সঙ্গে যোগ দিয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মিত্রবাহিনী টাঙ্গাইলের মির্জাপুর, কালিয়াকৈর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ছত্রীসেনা নামিয়ে রাতে প্রচন্ড আক্রমণ চালায়। তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে কাদেরিয়াা বাহিনী। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। ফলে ঢাকা অভিযানের সর্বাপেক্ষা সম্ভাবনাপূর্ণ পথের সদ্ব্যবহার শুরু হয়। দিনাজপুর অঞ্চলের মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী খানসামা থানা আক্রমণ করে। যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর ১৫ জন ও সাত মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাদের হাতে এক মেজরসহ পাকবাহিনীর ১৯ জন ধরা পড়ে। দিনাজপুরের বিরল থানায় বহলা গ্রামে ঘটে গণহত্যার নৃশংস ঘটনা। পাকহানাদার বাহিনীর একটি দল প্রবেশ করে ওই গ্রামে। ঐ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে পিছু হটার এক পর্যায়ে কাঞ্চন ক্যাম্পের খান সেনারা অনুপ্রবেশ করে ওই গ্রামে। তারা গ্রামবাসীকে গ্রাম ছেড়ে যাবার নির্দেশ দেয়। খান সেনাদের নির্দেশ মত তল্পিতল্পা নিয়ে গ্রামবাসীরা গ্রাম ছাড়ার উদ্যোগ নেয়। এই সময় খান সেনারা মাইকযোগে আবার তাদের এক হবার নির্দেশ দেয়। তখন মাগরিবের নামাজের সময়। অনেকে নামাজের কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে। সকলে নামাজের কাতারে দাঁড়ালে পিছন থেকে ব্রাশ ফায়ার করা হয় । এতে ঘটনাস্থলে শহীদ হন ৩৭ জন। নীলফামারী, গাইবান্ধা, নরসিংদী, সরিষাবাড়ী, ভেড়ামারা, শ্রীপুর হানাদারমুক্ত হয়। দক্ষিণে ভারতীয় নৌবাহিনী সপ্তম নৌবহরের আসন্ন তৎপরতা সর্ব উপায়ে বিঘিœত করার জন্য চালনা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ছোট বড় অবশিষ্ট সকল জাহাজ ও নৌযান, উপক‚লীয় অবকাঠামো, কক্সবাজার বিমানবন্দর প্রভৃতি ধ্বংস বা অকেজো করে ফেলে। নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিন অত্যন্ত কঠোর ভাষায় ভারতকে পাকিস্তান ছেড়ে যেতে বলেন। সাংবাদিকদের সাথে আলাপ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মাতৃভ‚মি রক্ষায় শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। তিনি ঘোষণা করেন, কোনো শক্তি নেই পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে পারে। রেডিও পিকিং ঘোষণা করে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের মাধ্যমে পাকিস্তান আক্রমণ করে মূলত চীনকেই দমন করতে চায়। বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার ভারতের মাধ্যমে তথাকথিত ‘বাংলাদেশ’ সমর্থনের অন্যতম কারণ। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাপকভাবে সমর্থন দেয়ার জন্য ভারত সরকার ও ভারতীয় জনগণকে ধন্যবাদ জানান। বিবৃতিতে তিনি আরো বলেন, ‘আমার শেষ সংগ্রাম বাংলাদেশকে স্বাধীন করা, সমাজতন্ত্রবাদ প্রতিষ্ঠা এবং ভারতের সঙ্গে কনফেডারেশন। এ তিন কাজের সমন্বয় সাধন ইনশাআল্লাহ আমার জীবিতকালেই দেখবার প্রবল ইচ্ছা অন্তরে পোষণ করি।’তিনি তাঁর দলের সদস্যদের এবং সমর্থকদের বাংলাদেশ সরকার, আওয়ামী লীগ ও মুক্তিবাহিনীর পক্ষে একসঙ্গে কাজ করার নির্দেশ দেন। বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, মুক্তিসংগ্রামে জয়লাভের আর দেরি নেই। দিল্লীতে কুজনেটসভ এবং মস্কোতে ডি. পি. ধরের যুগপৎ আলোচনার ফলে দ্রæতগতিতে উভয় সরকার মার্কিন ও চীনা হস্তক্ষেপের হুমকি মোকাবিলায় যুগ্ম ভ‚মিকা গ্রহণে সম্মত হন। সপ্তম নৌবহরের আগমন-সংক্রান্ত খবর তখনও ভারতে কেবল স্বল্প সংখ্যক নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে সীমিত। তবু মার্কিন প্রশাসনের হুমকির প্রকাশ্য জবাব দান এবং ভারতের জনসাধারণকে আসন্ন বিপদ ও কঠোর সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে ১২ই ডিসেম্বর দিল্লীতে বিশেষভাবে আয়োজিত এক জনসভায় ইন্দিরা গান্ধী ‘সম্মুখের অন্ধকার দিন’ ও ‘দীর্ঘতর যুদ্ধের সম্ভাবনা’ সম্পর্কে সতর্ক করেন। সেই সঙ্গে সাধারণ পরিষদের সাম্প্রতিক আহব্বানের জবাবে এবং পরোক্ষভাবে মার্কিন চরমপত্র প্রত্যাখ্যান করে জাতিসংঘ মহাসচিক উথান্টকে এক বার্তায় ইন্দিরা জানান, ভারত যুদ্ধবিরতি ঘোষণা এবং ভারতীয় সৈন্য স্বদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রস্তুত আছে, একমাত্র যদি পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে এবং বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় পৌঁছতে সম্মত হয়।বিবিসির খবরে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয়রা রাজধানী ঢাকার চারপাশে প্যারাট্রুপ্স নামিয়েছে। স্থল বাহিনী শহরের দিকে এগোচ্ছে। ভারতের পূর্ব অঞ্চলের কমান্ডার মেজর জেনারেল জ্যাকব বলেন, গতকাল আকাশপথে অপারেশন চালানো হয়েছিল এবং তারা সফল হয়েছেন। কিন্তু তিনি কোনও বিবরণ দেন নাই। ভারতীয় কমান্ডার আরো বলেন যে স্থল বাহিনী যারা আগে মেঘনা নদী পার হয়েছে তারা শহরের প্রায় বিশ মাইল (৩২ কিলোমিটার) এর মধ্যে আছে। তারা কিছু বাঁধার সম্মুখীন হয়েছে। ভারতীয়রা জানায় তাদের সৈন্য এখন নদীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এবং তারা কুমিল্লার সব এলাকার দখল নিয়েছে। মেজর জ্যাকব আরো বলেন ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ইউনিট খুব সক্রিয় এবং ঢাকায় যুদ্ধ চলছে।