‘বিশ্ব নতুন করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয়!’

5

মিয়া জামশেদ উদ্দীন

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, বিশ্ব নতুন করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয়। ১৪ এপ্রিল-২০২৪ইং, রবিবার তেল আবির- ইসরায়েলের ওপর ইরানের হামলার ঘটনা ঘটে। এটি ছিল ইরানের প্রথম ও প্রকাশ্য হামলা করার ঘটনা। এদিকে নেতানিয়াহুয়ার আহ্বানে জাতিসংঘ জরুরী অধিবেশন আহ্বান করেন। এ বিশেষ অধিবেশনে বক্তব্যকালে জাতিসংঘের মহাসচিব আরো বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্য খাদের কিনারে রয়েছে; কিন্তু শক্তি প্রয়োগ করে প্রতিশোধ নেয়া জাতিসংঘের আইনের পরিপন্থী; এখনই সময় যুদ্ধে দ্বারপ্রান্ত থেকে ফেরা।’
তবে জাতিসংঘের মহাসচিবের এসব বক্তব্য যেন সাধারণ আইনের সাংঘর্ষিক। দখলদার ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ছুঁড়ছে। একই সাথে একের পর এক হাসপাতালে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। আরো নির্মম হলো, ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনীদের ত্রাণসামগ্রী দেয়ার নামে ব্রাশফায়ার করে হত্যাযজ্ঞ চালায়। তাহলে শক্তি প্রয়োগ করে প্রতিশোধ নেয়া আইনের পরিপন্থী কি না? অথচ এসব ব্যত্য করে সংঘটিত হতে চলেছে। তাহলে জাতিসংঘের মহাসচিবের এ বক্তব্যের মতান্তর যে আছে, তা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। বাস্তবে আইনের তোয়াক্কা করছে না দেশটি। বিষয়টি যত না ন্যায়নীতি, বাস্তবে তা প্রতিফলন হতে দেখা যায় না, যেন একপেশে নীতি বা কথার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। খোদ জাতিসংঘের স্থায়ী ৫ সদস্য দেশও-এ আইনের তোয়াক্কা করছে না। যদি এমনি হতো, তা হলে ওই ৫টি দেশের একটি দেশ যখন ক্ষেত্রবিশেষে ভেটো দেয়ার পর শতযুক্তি বা মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলেও অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং সেটি আর আলোর মুখ দেখতে পায় না। এটিই চিরন্তন সত্য! মুলত জাতিসংঘ নিজেই অকার্যকর ভূমিকায় ন্যস্ত। তবে জাতিসংঘের মহাসচিবের এ কথাটি সত্য ধরে নেয়া যায়। ‘বিশ্বে নতুন করে যুদ্ধ সহিবার অবস্থা নেই’। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, বিশ্বের কাছে অন্তত দুটি দৃষ্টান্ত আছে। তার একটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। যেটি সূচনা হয় ১৯১৪-১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে।
১৯১৪ সালে ১৮ জুন বসেনিরাজধানী সারায়েভো শহরে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্চডিইক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দর হত্যাকাÐের ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সূচনা হয়। অবশ্য পরবর্তীতে ঘটনাটি সেখানে স্থিত ছিল না। উনিশ শতকে শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে আরো বিস্তৃত লাভ করে এ যুদ্ধ-বিগ্রহ। বিশেষ করে শিল্পের কাঁচামাল আহরণ ও পণ্য বিপণনে উপনিবেশ রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। যার ফলে নতুন নতুন কলোনি খুঁজতে হয়।
অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরি এই হত্যাকান্ডের জন্য সার্বিয়াকে দায়ী করে এবং ওই বছরের ২৮ জুলাই সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এ যুদ্ধে বিশ্ব দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একপক্ষে ছিল অর্থনৈতিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো। তাদের মধ্যে উসমানিয় সাম্রাজ্য, অস্ট্রিয়া- হাঙ্গেরি, জার্মান ও বুলগেরিয়া। এদের কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। অপর পক্ষ ছিল সার্বিয়া, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জাপান, ইতালি, রুমানিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। যাদের বলা হতো মিত্রশক্তি। আর এ যুদ্ধের ফলাফল যা হয়েছে, ৯০ লক্ষ সৈন্য, ১ কোটি ২০লক্ষ নিরীহ লোক প্রাণ হারায়। আহত হয় ১ কোটি সৈন্য, ২কোটি ১০লক্ষ সাধারণ লোকজন আহত হয়। সঙ্গে ভয়াবহ মহামারি দেখা দেয়। এতে আরো ৫ কোটি লোক জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
সঙ্গে ৪টি সাম্রাজ্য পতন হয়। ১৯১৮ সালে রোমান সাম্রাজ্য হয় রুশ সাম্রাজ্যে, একই বছর জার্মান ও অস্ট্রেয়া-হাঙ্গেরী সাম্রাজ্য এবং ১৯২২ সালে ওসমানীয় সাম্রাজ্য। অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, এস্তোনিয়া, হাঙ্গেরি , লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং তুরস্ক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অধিনে থাকা অধিকাংশ আরব অঞ্চল ব্রিটিশ ও ফরাসি সাম্রাজ্যের অধিনস্থ হয়ে গেল। ১৯১৭ সালে বলশেভিকরা রাশিয়ার এবং ১৯২২ সালে ইতালি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো ১৯৩৯ সালে। জার্মান নেতৃত্বে অক্ষশক্তি পোল্যান্ড আক্রমণ করে। ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল বেজে ওঠে। বিশেষ করে ইয়াহুদী জাতীর ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে জার্মান এক নায়ক এডলফ হিটলার এ যুদ্ধ ঘোষণা করে। শিশু- নারীসহ নির্বিশেষে ৮৮ লক্ষ ইয়াহুদীকে হত্যা করে নাৎসি বাহিনীর প্রধান হিটলার। এটি বিশ্বে হলোকস্ট হিসেবে অধিক পরিচিত। তবে এ যুদ্ধে ৫ কোটি সাধারণ মানুষ প্রাণ হারান। ওই যুদ্ধে সর্বপ্রথম পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগ হয় জাপানের ওপর। জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরপর দুটি পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে মিত্রশক্তি যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তি হয়।
অপর অক্ষশক্তি জার্মানের নাৎসি ফোজেরও শোচনীয় পরাজয় হয় রাশিয়ার বলশেভিক বাহিনীর হাতে। এর মধ্যে দিয়ে এডলফ হিটলারের যবনিকা ঘটে। চীন ও জাপানের মধ্যেকার যুদ্ধ চলছিল ১৯৩১ সাল থেকে। এ যুদ্ধেও একীভূত হয়। চীন মিত্রশক্তির সাথে একীভূত হয়ে যুদ্ধে জড়ায়। জাপান ১৯৩৭ সালে চীনের ওপর ব্যাপোরোয়া হামলা চালায়। যুক্তরাজ্যের অধিনস্থ ভারতেও হামলা চালায় জাপান। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে জাপান প্রশান্ত মহাসাগরের অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবার আক্রমণ ও ইউরোপীয় উপনিবেশগুলো আক্রমণ করে দ্রæত এগিয়ে যেতে থাকে। জার্মান ইতালির সাথে মিত্রদেশ গড়ে তোলে ইউরোপীয় মহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করে। যুক্তরাজ্যও কমনওয়েলথ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অবস্থান বজায় রাখতে মিত্রশক্তির সাথে একাত্ম হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যায়।
১৯৪৫ সালে জাপান ও জার্মান নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তি হয়। যুদ্ধে পরবর্তীতে ইউরোপ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এক অংশ পশ্চিম ইউরোপ ন্যাটো ভুক্ত হয়। অপর অংশে অন্তর্ভুক্ত হয় সোভিয়েত রাশিয়ার। যুদ্ধের এ বীভৎসতায় সাধারণ লোক শিকার হয় বেশী। শিশু ও নারীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়তে হয়। প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য হারায়। এক কথায় বলতে, প্রাণীক‚ল বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ১৪ এপ্রিল ইসরায়েল ওপর ইরানের এ হামলা আবারও ভাবিয়ে তোলে। দুইশো বছরের ইতিহাসে ইরানের পক্ষ থেকে প্রথম হামলা করার দৃষ্টান্ত।
২০২৩ সালের অক্টোবরের প্রথমদিকে আকস্মিক হামলা চালায় হামাস ইসরায়েলর ওপর। ওই হামলায় ইসরায়েলের ১৪শো নিরীহ লোক প্রাণ হারায়। তবে হামাসের এ হামলা ছিল নাটকীয়ভরা। একটি পরাশক্তিধর রাষ্ট্রের ওপর কথিত এ হামলা ভাবিয়ে তোলে।
সর্বশেষ ১ এপ্রিল (২০২৪) সিরিয়ার দামেস্কে অবস্থিত ইরানি কনস্যুলেটে হামলা চালিয়ে দেশটির কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যা করে। ইসরায়েলের এ ঘটনার পর ইরানের এ জবাব দেয়া। ২০২২ সালের জানুয়ারি ইরানের জেনারেলের কাসেম সোলেইমানি হত্যা করা হয়। এ হত্যার সাথে ইসরায়েল সরাসরি জড়িত বলে ইরান তা মনে করে। এর আগেও ইরানের কয়েকজন পারমাণবিক বিজ্ঞানিকে হত্যা করা হয়। রবিবার (২৪এপ্রিল) গভীর রাতে ইসরায়েলের ওপর যে হামলা চালিয়েছে, তার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করে না খোদ নেতানিয়াহু সরকার। ইরানের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, অন্তত ৭২০টি লক্ষ্যস্থলে হামলা চালানো হয়। তার মধ্যে ১০০টি ক্ষেপণাস্ত্র, ৩০টি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, ১৬০টি সুইসাইড ড্রোন ব্যবহার করা হয়।
ইরান আপাতত হামলা করার পরিকল্পন নেই বলে জানান। যদি হামলার টার্গেটে পরিণত হয়, তা হলে পাল্টা হামলা করার প্রস্তুতি নিয়েও রেখেছে জানান তারা। তাদের সম্ভাব্য হামলার টার্গেট কোথায় হতে পারে- বিশ্লেষকদের মতে, ইরাক, সিরিয়া ও জর্ডানে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটির ওপর। তা আবার পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ বাঁধলে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠতে পারে এসব ঘাঁটি। পাশাপাশি গেরিলা কায়দায় দখল-হামলা জোরদার করতে পারে। ইরান তাদের ছায়াশক্তি হিসেবে দেখে আসছে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি বাহিনী।
অন্যদিকে নেতানিয়াহু সরকারও বারবার বলে আসছে, তারা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার ওপর পারমাণবিক হামলা চালাবে। একসঙ্গে মিত্রশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য নেতানিয়াহু সরকারকে সকল প্রকার সহযোগিতা দেবে বলে যে ধারণা, তা উড়েও দেয়া যায় না। নেতানিয়াহু সরকার বা ইসরায়েলের প্রধান শক্তি হলো যুক্তরাষ্ট্র। চীন তার দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বৃহৎ বাজার কব্জা নিতে ইরান ও হামাস যুদ্ধাদের সকল প্রকার সহযোগিতা দেবে এবং দিয়ে আসছে, এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে। রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরে যে সুযোগের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সাথে যুদ্ধে জড়ালে ন্যাটোভুক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশগুলো দখলের চেষ্টা তাদের, সঙ্গে ইরানকে পারমাণবিক বোমাবহন সক্ষম সাবমেরিন সহ ভারী ভারী যতসব অস্ত্রশস্ত্রের সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসবে। ইরানও তাদের হরমুজ প্রণালীতে বাঁধা দিয়ে আন্তর্জাতিক নৌ পথে তেল পরিবহন বন্ধ করে দিতে পারে। এতে সৃষ্টি হবে তেলের তীব্র সংকট। তবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো আপাতত-এ শর্ত দিতে পারে যে, দখলদার ইসরায়েল অধিকতর ফিলিস্তিনীদের ভূ-খন্ড স্বীকৃতি নিশ্চিত করতো, তাহলে সমাধানের একটি লাগাম টানা যাবে।
অন্যথায় মধ্যেপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদীদের সকল ঘাঁটি সরিয়ে নিতে বাধ্য করা, এ শর্তে ইসরায়েল ও তার মিত্রদের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। সঙ্গে সকল প্রকার যুদ্ধ-বিগ্রহ সৃষ্টিতে কোনো পক্ষকে উষ্কানো যাবে না। একই সাথে ওআইসিভুক্ত সকল দেশ জরুরী ভিত্তিক বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করা যেতে পারে। এতে যুদ্ধ-বিগ্রহের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নিতে পারে, ভবিষ্যতে তাদের করণিয় কি। আধিপত্যর নামে মানুষ হত্যার মহোৎসবে মেতে ওঠার নামান্তর। ইয়াহুদী, ফিলিস্তিন, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ও হিন্দু নামে কেন জাত ভেদাভেদ। এসব জিইয়ে রেখে কতদিনবা ক্ষমতায় থাকা যায়।
লেখক : মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, কবি ও কলামিস্ট