বিশ্বে টিকা রাজনীতিতে বাংলাদেশ সফল হবে

10

 

বিশ্বব্যাপী মানুষ এবং করোনাভাইরাস নামক জীবাণুর মধ্যে যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধে আমরা বিশ্বাস রাখি বিজয় মানুষেরই হবে। কিন্তু জীবাণুর সাথে মানুষের এই রকম কঠিন যুদ্ধ ইতিহাসে বিরল। করোনাভাইরাস একটি মারাত্মক অনুজীব, যা মানুষ থেকে মানুষে দ্রুত সংক্রমিত হয়। এই অনুজীব মানুষের ফুসফুস এবং অন্যান্য অঙ্গ আক্রমণ করে। ফুসফুস নষ্ট হলে অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মারা যায়। মানুষের ভেতরে যে রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা আছে তাকে ফাঁকি দিয়ে করোনা মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। করোনাভাইরাস চীনের উহান থেকে পৃথিবীর আনাচে কানাছে কিভাবে এতো দ্রত ছড়িয়ে পড়লো তা এক বিস্ময়কর ব্যাপার। তার চাইতে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই ভাইরাস খুব দ্রুত নিজের রূপ পরিবর্তন করতে পারে। পরিবর্তিত রূপ ধারণ করার পর সে হয়তো দুর্বল হয়, না হয় মহাপরাক্রমশালী হয়ে উঠে। যেমন-বর্তমানে ডেল্টা ধরনের অনুজীব দ্রুত গতিতে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বলেছিলো ডেল্টার উত্থানের পর আস্তে আস্তে এই ভাইরাস স্থিমিত হয়ে যাবে এবং কোভিড-১৯ রোগ পৃথিবী থেকে বিদায় নিবে। কিন্তু এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ডেল্টা ধরন রূপ পরিবর্তন করে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। এই নতুন ধরনের ভাইরাস মানুষের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতাকে পাত্তাই দিবেনা। সে অবস্থা বিবেচনা করে রোগতত্ববিদগণ বলেছেন করোনার আরো ঢেউ আসতে পারে। এইরকম এক বহুরূপী ধরনের যুদ্ধ অতীতে মানুষকে মোকাবেলা করতে হয়েছে কিনা তা আমার চিন্তার মধ্যে আসছে না।
আমরা যদি অতীতের দিকে দেখি, পানিপথের যুদ্ধ, পলাশীর যুদ্ধ, তুরস্কের সম্রাট সুলতান সোলেমানের রাজ্য জয়ের যুদ্ধ ছিল গতানুগতিক তীর ধনু, ঢাল তলোয়ার বা গাদা বন্দুকের যুদ্ধ। ঐ যুদ্ধের পেছনে ছিলো উচ্চাভিলাসী নরপতিদের মানুষের উপরে শাসন শোষন চালানোর যুদ্ধ। পৃথিবীতে মানুষ নিজেদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করে রেখেছে। আল্লাহ্ প্রদত্ত সম্পদ মানুষ নিজেদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে নিয়ে শান্তিতে বসবাস করার সামাজিক সূত্র কখনো উদ্ভাবন করতে পারবে না। মানুষ এক আত্মবিনাশী প্রাণী। মানুষ কখনো বৈষম্যের ঊর্ধ্বে উঠতে পারছে না। বৈষম্যই যুদ্ধের মূল কারণ। কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন, ‘যুদ্ধ মানে শত্রু শত্রু খেলা, যুদ্ধ মানে তোমার প্রতি আমার অবহেলা-’। কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলেছেন করোনাভাইরাস কোথা থেকে আসলো? করোনাভাইরাস কি আগে থেকেই পৃথিবীতে অবস্থান করছিলো? নাকি, জীবাণু অস্ত্র আবিষ্কার করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা কোথাও ভুল করে ফেলেছেন? এই ব্যাপারে একজন ভাইরোলজির অধ্যাপক ঠাট্টার ছলে আমাকে বলেছেন, আপনি কি সাইন্স ফিকশনের ব্যাপারে আগ্রহী? আমাদের গ্যালাক্সির বাহিরে আরো অনেক সোলার সিস্টেম আছে। সেখানে আমাদের সূর্যের মতো স্টার আছে এবং তাকে প্রদক্ষিণরত গ্রহ আছে। সেই গ্রহগুলির চরিত্র আমাদের মতো নয়। সেই গ্রহগুলিতে যে প্রাণী বাস করে তারা হচ্ছে ভাইরাস, এলেজি, ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া, ফাঙ্গাস ইত্যাদি। সেই গ্রহের একটি দিন আমাদের এক হাজার বছরের সমান লম্বা। এই ক্ষুদ্র প্রাণীগুলি সকালে খাবার গ্রহণ করার পরে রাতের খাবারের জন্য আমাদের এক হাজার বছরের সমান সময় অপেক্ষা করতে হয়। তারা ইন্টার-গ্যালাক্সি ভ্রমণ করতে পারে। মানুষের মতো প্রাণীর ফুসফুস হলো তাদের খাদ্য। হয়তো এই গ্রহ থেকে গ্যালাক্সি ভ্রমণ করে করোনা পৃথিবীতে এসেছে। প্রতি এক হাজার বছরে বারবার আসবে। আমি উনাকে বললাম, আপনার এই অসম্ভব কল্পনা সত্য না হলেও চিন্তার খোরাক যোগানোর জন্য খুবই উৎকৃষ্ট। মানুষকে খুঁজে বের করতে হবে, করোনাভাইরাস কোথা থেকে এসেছে এবং কখন সে চলে যাবে। যদি এই প্রশ্নের সমাধান করা না যায় তাহলে করোনা যুদ্ধে মানুষকে অনেক মূল্য দিতে হবে।
করোনা যেভাবে ধরন পাল্টায় এবং ভয়ংকর রূপ ধারণ করে, মানুষও তেমনি ধরন পাল্টাচ্ছে। কোটি কোটি করোনাভাইরাস ঐক্যবদ্ধ। তাদের সাথে ডেঙ্গুর জীবাণু, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস মানুষকে মারার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। মানুষ করোনার বিরুদ্ধে কি ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছে? করোনাভাইরাসের উপদ্রব দেখা দেওয়ার সাথে সাথে মানুষের কি করা উচিত ছিলো? আমি মনে করি লকডাউনের মতো এক কাল্পনিক সমাধান সূত্র বের করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোন ‘হিরো’র কাজ করেনি। লকডাউন মানা মানুষের পক্ষে সম্ভব কিনা আপনারাই ভেবে দেখুন। আমার মতে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা বলতে পারতো, পৃথিবীর সকল ধনী এবং গরিব দেশ একত্র হয়ে বিশাল একটি কমন ফান্ড তৈয়ার করো। বিশ্বের সব ঝানু ঝানু বিজ্ঞানিদের নিয়ে করোনা প্রতিরোধক টিকা আবিষ্কারের জন্য বিশ্বের বড়ো বড়ো গবেষণাগারে বসে যাও। মানুষের জন্য করোনার টিকা বানাও। তা না করে বড়ো বড়ো ব্যবসায়িক জায়ান্টগুলি টিকা উৎপাদনে পুঁজি বিনিয়োগ করেছে। ফলে এখন আমেরিকার টিকা উৎপাদন হয়েছে, ব্রিটেনের টিকা উৎপাদন হয়েছে, চীনের টিকা উৎপাদন হয়েছে, রাশিয়ার টিকা উৎপাদন হয়েছে, ব্যবসায়িদের কাছ থেকে এই টিকা কিনার জন্য বিভিন্ন দেশের সরকারকে ছোটাছুটি করতে হচ্ছে। ধনী দেশগুলি তার একজন নাগরিকের জন্য ৫০ ডোজ করে টিকা কিনে মজুদ করেছে। বাংলাদেশের মতো দেশ নগদ টাকা নিয়ে একবার ভারতের কাছে যাচ্ছে, টাকা পরিশোধ করেও টিকার জন্য অপেক্ষা করছে, আরেকবার রাশিয়া, চীনের কাছে যাচ্ছে, হয়তো তাদের কাছ থেকে টিকা কিনতে পারবে। বাংলাদেশের মতো দেশকে জাপানের মতো, আমেরিকার মতো, ভারতের মতো বড়ো দেশের উপহারের টিকা নিতে হচ্ছে। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে মানুষের এই মন মানসিকতাকে আপনি কি সঠিক বলে মনে করছেন? পৃথিবীর অনেক গরিব দেশ টিকা কিনার অর্থ জোগাড় করতে পারবেনা। তাদের কি অবস্থা হবে? অপরদিকে ধনী দেশগুলি বলছে তারা তাদের নাগরিককে ২ ডোজ টিকা দেওয়ার পরে আবার ১টি বুস্টার ডোজ দিবে। হয়তো টিকা উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলি ১ বছর পরে বলবে টিকার দ্বারা যে এন্টিবডি তৈয়ার হয় তা শেষ হয়ে গেলে মানুষকে ৩য় ডোজ, ৪র্থ ডোজ টিকা নিতে হবে। তাহলে কি আমরা ‘মানুষ’ টিকা উৎপাদনকারীদের কাছে জিম্মি হয়ে যাবো? বাংলাদেশ সরকার শুরু থেকেই টিকা সংগ্রহের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। এমনকি ভারত থেকে টিকা কেনার জন্য টাকাও পরিশোধ করেছে। যারা সরকারের সমালোচনা করেন তাদের বোঝা উচিত টিকা নিয়ে যে বিশ্বরাজনীতি চলছে তাতে বাংলাদেশ টিকা কেনার ব্যাপারে যেটুকু সাফল্য অর্জন করেছে তা প্রশংসার দাবি রাখে। করোনার বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করছি। এটা বাঁচা মরার লড়াই। এটা টিকে থাকার লড়াই। এই লড়াইয়ে মানুষকে সাবধান হতে হবে।
‘ইউনিটি উইদ ইন ডাইভারসিটি’ বলে একটা কথা আছে। করোনার সাথে যুদ্ধে আমরা গতানুগতিক লড়াই করছি না। এই লড়াইয়ে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃংখলা বাহিনী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সাংবাদিক, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক এই বহুমুখী সমাজ শক্তিকে একত্রিত করতে হবে। সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। মাস্ক পরিধান এবং টিকা এ দুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বলে আমি মনে করি। হাসপাতাল ও আইসিইউর সংখ্যা বাড়িয়ে আমরা কি করোনা মোকাবেলা করতে পারবো? টিকা নিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে পৃথিবীর গরিব দেশগুলি কিভাবে টিকে থাকবে আমি বুঝতে পারছিনা। হয়তো ধনী দেশগুলির দয়ার উপরে নির্ভর করতে হবে। আমি আশা করি টিকা রাজনীতিতে বাংলাদেশ তার জনগণের জন্য সাফল্য নিয়ে আসতে পারবে। বাংলাদেশে যে গণটিকাদান শুরু হয়েছে তা অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশ জনগণের বড়ো অংশকে টিকা প্রদানের যে লক্ষ্যমাত্রা সরকার ধার্য করেছে তা সফল হবে। আল্লাহ্ আমাদের সহায় হোন।

লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, কলামিস্ট