বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ও পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে হবে

3

মির্জা ইমতিয়াজ শাওন

দেশে দেশে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য জনগণের সচেতনতার পাশাপাশি প্রযুক্তিরও সহায়তা নেয়া শুরু হয়েছে। উদ্ভাবন করা হয়েছে নতুন নতুন পণ্যের। যেগুলো ব্যবহার করলে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে উল্লেখযোগ্য হারে। বাংলাদেশেও এসব প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবহার শুরু হয়েছে। তবে তা এখনো ব্যপকতা পায়নি। নবায়যোগ্য বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করতে পারে সৌর প্যানেল এ প্রযুক্তি আমাদের দেশে প্রচলিত হয়েছে এটার অধিক স¤প্রসারণ দ্রæততার সাথে হওয়া দরকার এ ক্ষেত্রে জরুরী ভিত্তিতে প্রযোজনীয় ব্যবস্থা এখনি নেয়া উচিত। বেশকিছু নতুন প্রযুক্তি বের হয়েছে যেগুলো ব্যবহারের ফলে বিদ্যুৎ ব্যবহারে প্রচুর সাশ্রয়ী হওয়া যাবে। পাওয়ার জেনারেশন টেকনোলজি’র সূত্রে জনা যায় আমরা যদি ১০০ মেগাওয়াট (ঐঋঙ) বিদ্যুৎ উৎপাদন করি তাতে আমাদের আনুমানিক খরচ হয় ৭০০ থেকে ১০০০ কোটি টাকা আর যদি বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ও পণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত সাশ্রয় করি তাতে কিন্তু ৭০০ থেকে ১০০০ কোটি টাকা খরচ হবেনা। ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা আর ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা কিন্তু একই কথা। উপরন্তু ১০০মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে যে পরিমান কার্বন নিঃসরণ হয়ে গ্রীনহাউজ প্রভাব তৈরি করতো তা থেকেও আমরা রক্ষা পাব। অনেক কম খরচেই প্রযুক্তি নির্ভর পন্য ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা বিদ্যুৎ সাশ্রয় নিশ্চিত করে অর্থনৈতিকভাবে যেমন লাভবান হতে পারি তেমনি বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধে রাখতে পারি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কার্বন ট্রেডের মাধ্যমে আমরা আন্তর্জাতিকভাবেও অর্থনৈতিক সহায়তা পেতে পারি। প্রযুক্তি নির্ভর পণ্য ব্যবহারের প্রক্রিয়া বা পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে তিনি বলেন, একটা ভবনে লাইট, ফ্যান, এয়ারকন্ডিশনই মূলত বিদ্যুতের সর্বোচ্চ ব্যবহার হয়। আমরা যদি প্রতিটি ভবনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই গুলোর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে পারি তাহলে বিদ্যুত ব্যবহারে অপচয় রোধ করে অনেক সাশ্রয় করতে পারবো। আপনাকে ২/১টা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আরো পরিস্কার হবে। ধরুন, একটা ১০ তলা ভবন। নিচতলা থেকে ১০ তলা পর্যন্ত সিঁড়িতে আমরা সারারাত লাইট জ্বালিয়ে রাখি। রাখতে হয় নিরাপত্তাজনিত কারণে। কিন্তু প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা কিন্তু বিদ্যুতের এই অপচয় রোধ করতে পারি আবার নিরাপত্তাজনিত সুবিধাটাও পেতে পারি। একটা মানুষ সিঁড়ির কাছাকাছি আসলেই মূলত তার আলো দরকার। এই পদ্ধতিতে মানুষ সিঁড়ির কাছাকাছি আসলেই অটোমেটিক সিঁড়ির নিকটস্থ বাতি জ্বলে উঠবে আবার যদি মানুষটি চোর বা অনাকাক্সিক্ষত কেউ হয় তাহলে হঠাত বাতি জ্বলে উঠা দেখে ভয়ে পালিয়ে যাবে। আবার ধরুন, আপনি বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৫তলায় আছেন। আপনি দেখবেন সবগুলো রুমে পর্দা লাগানো। অর্থাৎ প্রাকৃতিক আলোকে পর্দায় আটকে দিয়ে ভেতরে সব লাইট জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। এটা বিদ্যুতের অপচয়। আপনি যদি পর্দাগুলোকে ৬০ ডিগ্রি এঙ্গেল করে দেন তাহলে প্রয়োজনীয় আলো আপনার রুমে আসবে যা দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে আপনি অফিসে কাজ করতে পারবেন আবার অন্য দিকে বাহির থেকেও ভেতরে কিছু দেখা যাবেনা। এখন প্রশ্ন হল অতিরিক্ত আলো অথবা কম আলো হলে তা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে? এখানে ডে লাইট হারভেস্টিং প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এসব নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এই পদ্ধতিতে লাক্স লেভেলকে ব্যবহার উপযোগী একটা স্ট্যান্ডার্ড মাত্রায় সেট করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আলোকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। যেমন বাইরে যদি আকাশ মেঘলা থাকে তাহলে ভেতরে অটোমেটিক নির্দিষ্ট মাত্রায় বাতির আলো বেড়ে যাবে আবার বাইরে যদি পর্যাপ্ত আলো থাকে অটোমেটিক ভেতরের বাতির আলো কমে যাবে। ডিমিং পদ্ধতিতে এইসব কাজগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হবে। ব্যবহারকারী জানতেই পারবেনা আলোর স্বল্পতা অথবা অতিরিক্ত আলোর প্রখরতা। একইভাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে এয়ারকন্ডিশন। নির্দিষ্ট একটা তাপমাত্রায় সেট করা থাকবে। ব্যবহারকারি রুমে না থাকলে এসি একটা নির্দিষ্ট সময় পর অটো্মিেটক বন্ধ হয়ে যাবে আবার রুমে আসলে অটোমেটিক চালু হয়ে যাবে। বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয় প্রসঙ্গ তুলে ধরে নুরনবী বলেন, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী সিলিং ফ্যান ব্যবহার করা যেতে পারে। সরকারি/বেসরকারি পর্যায়ে কলকারখানায় যত মটোরাইজড লোড আছে সেগুলোতে ইনভার্টার ব্যবহার নিশ্চিত করা যেতে পারে। স¤প্রতি আমরা জাপানিজ একটা কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। তারা একটা টেকনোলজি আবিস্কার করেছে যা দিয়ে ১৫ থেকে ২০% বিদ্যুৎ সাশ্রয় সম্ভব। বৃহৎ ফ্যাক্টরি বা সুউচ্চ ভবনে এটা খুব কার্যকর। বিদ্যুৎ সাশ্রয় করার উপায় বিদ্যুৎ সংযোগ পরীক্ষা, বৈদ্যুতিক যন্ত্র আনপ্লাগ করে রাখা, এনার্জি সেভিং করতে সক্ষম এমন, নির্দিষ্ট একটি নিয়ন্ত্রক পণ্য আছে যেটি বাড়ির সিঁড়িতে ব্যবহার করলে সিঁড়ির জন্য দৈনন্দিন ব্যহৃত বিদ্যুতের অর্ধেক ব্যয় কমে যাবে। এক্ষেত্রে ব্যবহারকারী সিঁড়িতে এলেই কেবল লাইট স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বলবে, অন্য সময় বন্ধ থাকবে। তাহলে সারাদিন বা সারা রাত আর সিঁড়িতে লাইট জ্বালিয়ে রাখতে হবে না। সোলার প্যানেল মূলত সরাসরি সূর্যের আলো থেকে নবায়যোগ্য বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করতে পারে। যেই বিদ্যুৎ আমরা সরাসরি কোন ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রাংশ চালানোর কাজে ব্যবহার করতে পারি অথবা সেটি কোন ব্যাটারিতে সংরক্ষন করে পরবর্তীতে কাজে লাগাতে পারি। সৌর শক্তির বিকাশের কথা বলতে গেলে ১০০ বছরেরও বেশি সময় আগে চলে যেতে হয়। প্রাথমিক দিনগুলিতে সৌরশক্তি প্রাথমিকভাবে বাষ্প উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হতো যা পড়ে পড়ে যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য ব্যবহার করা হত। কিন্তু এডমন্ড বেকারেলের ফটোভোলটাইক প্রভাব আবিষ্কার এর আগে পর্যন্ত সৌরশক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তরের ব্যবহার জানতো না মানুষ। বেকারেলের আবিষ্কার কে ১৮৯৩ সালে চার্লস ফ্রিটস দ্বারা প্রথম প্রকৃত সৌর কোষের আবিষ্কারের দিকে চালিত করে, যা সোনার পাতলা স্তর দিয়ে সেলেনিয়ামের আবরণ দ্বারা গঠিত ছিল। আর এই বিনীত শুরু থেকেই উদ্বুদ্ধ হওয়া ডিভাইস টিকে আমরা আজ সোলার প্যানেল নামে চিনি। বর্তমানে জার্মানির ব্যবহৃত মোট জ্বালানির প্রায় ৩০ শতাংশ জোগান দেয় নবায়নযোগ্য সৌর ও বায়ুশক্তি। আর ২০২৫ সালের মধ্যে দেশটির মোট ব্যবহৃত জ্বালানির ৪৫ শতাংশ জোগান দেবে নবায়নযোগ্য সৌর ও বায়ুশক্তি। আর ২০৫০ সালের মধ্যে এটি হবে ৮০ শতাংশ। জার্মানি ২০২২ সালের মধ্যে তাদের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সোলার প্যানেলের প্রধান উপাদান হলো সোলার সেল এটিই মূলত সূর্য়ের আলো থেকে বিদ্যূৎ শক্তি উৎপাদন করতে পারে। সোলার সেলের আরেক নাম ফোটোভোলটাইক এখানে উল্লেখ্য যে ফটো বলতে লাইট এবং ভোলটাইক বলতে ইলেক্ট্রিসিটিকে বুঝানো হয়েছে। সোলার সেলগুলো সাধারণত এক ধরনের সেমি কন্ডাক্টর ধাতু দ্বারা তৈরি করা হয় যেমন জার্মেনিয়াম, সিলিকন, কার্বন সিলিকন কার্বাইড ইত্যাদি । এগুলো দ্বারা তৈরি সোলার সেলকে যখন সূর্যের আলোর সংস্পর্শে আনা হয় তখন সেই আলো থেকে ফোটোভোলটাইক হালকা শক্তি ফোটন শোষণ করে নেয়। এর ফলে সেখানে কিছু ভোল্টের সৃষ্টি হয়ে থাকে আর এমন অনেকগুলো সেল যখন একত্রিত করা হয় তখন সবগুলো একসাথে অনেক বেশি ভোল্ট সৃষ্টি করতে পারে আর এভাবেই সোলার সেলের মাধ্যমে সোলার প্যানেল বিদ্যুশক্তি উৎপাদন করে থাকে। কোন ব্যক্তি দুইটা লাইট ও একটা ফ্যান চালাবে সোলার প্যানেল দ্বারা। ধরা যাক লাইট দুটির ক্ষমতা ১০ ওয়াট করে ২০ ওয়াট ও ফ্যানটির ক্ষমতা ২০ ওয়াট তাহলে মোট প্রয়োজন ৪০ ওয়াট। আমরা যদি প্রতিদিন ৬ ঘন্টা করে চালাতে চাই তাহলে মোট প্রয়োজন ৪০ * ৬ = ২৪০ ওয়াট। এর জন্য ব্যাটারি প্রয়োজন হবে ২৪০ / ১২ = ২০ এম্পিয়ার বা ১২ ভোল্টের ব্যাটারি। সোলার প্যানেলের লেড এসিড ব্যাটারির চার্জিং কারেন্ট ১০% । তাহলে ২০ এম্পিয়ার ব্যটারির চার্জিং কারেন্ট হবে ২০*১০/১০০ = ২ এম্পিয়ার আর ২ এম্পিয়ার কারেন্ট উৎপাদন করতে সোলার প্যানেল লাগবে ২*১২ = ২৪ ওয়াট। তারমানে এই ব্যক্তির ২৪ ওয়াটের সোলার প্যানেল লাগালেই তার বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করতে পারবে।
বাংলাদেশে একটি সোলার প্যানেলের দাম প্রায় ৮,০০০ টাকা যা ৩০০ ওয়াট পর্যন্ত শক্তি আউটপুট দিতে পারে। প্যানেলের দাম সাধারণত মোট শক্তি, প্যানেলের গুণমান এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধের ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য দেশগুলো উৎপাদনের দিকে যেমন জোর দেয় তেমনি উৎপাদিত বিদ্যুতের সঠিক ও যথার্থ ব্যবহারের ওপরও অনেক বেশি জোর দেয়া হয়। এজন্য বিদ্যুতের ক্ষেত্রে সাশ্রয়ের বিষয়টি সবসময় আলোচনায় থাকে। অর্থাৎ অনেক কষ্টে উৎপাদিত বিদ্যুৎ যেন সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়, যেন এ ক্ষেত্রে অপচয় না হয় সেজন্য সবাইকে সতর্ক থাকার কথা বলা হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাংলাদেশ অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। সরকারের প্রচেষ্টা আছে নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্র তৈরিতে। বেসরকারিভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকেও প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে যাতে চাহিদা অনুযায়ী নিয়মিত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। তবে নানাভাবে বিদ্যুৎ যে সাশ্রয়ও করা যায় সে বিষয়টি সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়েই উপেক্ষিত থাকছে। সৌর শক্তির বিকাশ ও ব্যবহার পরিবেশকে দূষিত করে না, এটি একটি পরিচ্ছন্ন শক্তি। প্রতি বছর পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশে পৌঁছে যে সৌর বিকিরণ তা ১৩০ ট্রিলিয়ন টন কয়লার সমান হয়, যা বিশ্বে বৃহত্তম শক্তি হিসেবে উপগণিত হচ্ছে। ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা ছাড়াই পৃথিবীতে সূর্যালোক জ্বলছে, ভূমি বা সমুদ্রের উপরে, উচ্চ পর্বত বা দ্বীপগুলি সর্বত্রই উন্নত এবং ব্যবহারযোগ্য, সংগ্রহ করা সহজ, এবং শোষণ ও পরিবহনের কোনো প্রয়োজন নেই। বিদেশি সোলার প্যানেল আমদানিতে যুক্ত হয়েছে ১শতাংশ আমদানি শুল্ক এটা শূন্যে নামিয়ে এবং এ ক্ষেত্রে নগদ প্রণোদনা দিয়ে সোলার প্যানেল এর ব্যবহার বারাতে হবে। একই সাথে সোলার প্যানেল স্থাপনে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও যন্ত্রাংশ সহজলভ্য ও সূলভ করা গেলে বিকল্প বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো যাবে। একই সাথে উন্নত বিদ্যুৎ বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি আমদানী ও উৎপাদনে নমনীয় ও কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে তা সহজলভ্য ও সূলভ করতে হবে এবং বেশি বিদ্যুৎ খরচ হয় এমন পুরোনে প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি আমদানী ও উৎপাদনে বাধা তৈরি করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও উদ্যেক্তা