বিডিএস বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়

10

পূর্বদেশ ডেস্ক

বাংলাদেশ ডিজিটাল জরিপ (বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভে- বিডিএস) বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কারণ এর মাধ্যমে দেশের নাগরিকদের ভূমি সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি হয়রানি ও বিপুল অর্থ ব্যায় রোধ করা সম্ভব হবে।
ভূমি জরিপ (ভূ-সম্পদ জরিপ/ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে) ঠিকভাবে না হলে তা ব্যক্তি ও পারিবারিক পর্যায়ে এক দীর্ঘমেয়াদী সংকট ডেকে আনে। ভূমি জরিপের সময় মাঠ পর্যায়ের অসৎ কর্মকর্তা ও অসাধু ভূমির মালিক, দালাল কিংবা ভ‚মিদূস্যুর যোগসাজশে ইচ্ছাকৃত অসঠিক জরিপ কিংবা নিছক অসাবধানতাজনিত ত্রুটিপূর্ণ জরিপের কারণে, প্রকৃত মালিক ব্যতিত জমি অন্য ব্যক্তির নামে কিংবা সরকারের নামে চলে গেলে তার নিষ্পত্তিতে মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত যেতে হয়।
অনেক ভূমি সংক্রান্ত মামলা ৫০-৬০ বছরেও নিষ্পত্তি হয় না। এই ধরণের মামলা চালাতে গিয়ে অনেক পরিবার কয়েক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অনেক সময় মামলার খরচ বাদি-বিবাদী-পক্ষের মাসিক অর্থনৈতিক আয়কে অতিক্রম করে। বিপর্যয়কর মামলা-মোকদ্দমা ব্যয়ে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। এসব মামলা-মোকদ্দমার অন্যতম সূত্রপাত অসঠিক ভূমি জরিপ। এছাড়া, প্রচলিত ভূমি জরিপের আরেকটি সমস্যা হচ্ছে এর দীর্ঘসূত্রিতা। বিভিন্ন কারণে একেকটি জরিপ শেষ হতে ২০-২৫ বছরের বেশি লেগে যায়।
এছাড়া, ভূমির মালিকানা ও অধিগমনে দরিদ্র, ভূমিহীন, প্রান্তিক, মহিলা এবং ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য কৃষি ভূমি ও জলাধার রক্ষা ও সংস্কার প্রয়োজন। ভূমি খাত সংস্কারে- খাস জমি এবং চর গরিব ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে বিতরণ; শত্রু এবং অর্পিত সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়া; ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের ন্যায্য স্বার্থ নিশ্চিত করা; নারীদের জমি মালিকানার অধিকার নিশ্চিত করা; বঞ্চিত জনগণের সেবা প্রদানের জন্য ভ‚মি আইনের ফাঁকফোকর বন্ধ করাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্ভুল ও সঠিক জরিপ অত্যাবশ্যক।
জরিপকাজে এই দীর্ঘসূত্রিতা ও জনগণের হয়রানি কমানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভ‚মি মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে ডিজিটাল জরিপ করার নির্দেশ প্রদান করেন। তারই প্রেক্ষিতে ভূমি মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ডিজিটাল জরিপ তথা বিডিএস নামক সম্পূর্ণ নতুন ক্যাডাস্ট্রাল জরিপ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ভ‚মিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী গত বুধবার (৩ আগস্ট) পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সংলগ্ন মাঠে বাংলাদেশ ডিজিটাল জরিপ এর পাইলটিং-এর উদ্বোধন করেন।

বিডিএস বিষয়ক সাধারণ তথ্য
বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভের মূল উদ্দেশ্য অল্প সময়ে সমগ্র বাংলাদেশে ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে তথা ভূ-সম্পদ জরিপ শেষ করা এবং পরবর্তীতে মাঠে গিয়ে সার্ভের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে নিয়ে আসা। এছাড়া কোনো এলাকায় প্রাকৃতিক কারণে বড় ধরণের ভ‚মির বিচ্যুতি না ঘটলে রিভিশন্যাল সার্ভের প্রয়োজনীয়তাও থাকবে না ডিজিটাল ম্যাপ পার্টিশনের সুবিধার জন্য। এ প্রকল্পের আওতায় নির্ধারিত জিও-রেফারেন্সকৃত মৌজা ম্যাপ ‘ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন’ প্রকল্পে সরবরাহ করা হবে। জমি বিক্রির পর নামজারি খতিয়ান পরিবর্তনের সাথে সাথে ম্যাপের সীমানা পরিবর্তন হয়ে যাবে।
বিডিএস ম্যাপে জমির পরিমাণ, জমির আইলের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, আকার ইত্যাদি সম্পর্কে জানা যাবে। এই জরিপে তৈরি ম্যাপটিতে সেন্টিমিটার পর্যায় পর্যন্ত এই ভ‚মি পরিমাপের নির্ভুলতা থাকবে। পরিমাপের ক্ষেত্রে ইমেজ থেকে সুবিধা-মতো রেফারেন্স এর কো-অর্ডিনেটের মান ও মৌজা ম্যাপের যে কোনো প্লটের দূরত্বের মাপ ও প্লটের খতিয়ান নির্ধারিত দৈর্ঘ্য-প্রস্থ মাপ ও চার কোনার চারটি কো-অর্ডিনেট মান নিয়ে কনভেনশনাল ও আধুনিক ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভ‚মির যে কোনো প্লটের পরিমাপ, ল্যান্ড ডিমার্কেশন, ল্যান্ড ডিভাইডেড করা সম্ভব হবে। দরকার হবে না আলাদাভাবে স্থাপিত কোনো রেফারেন্স জিওডেটিক পিলার তথা জরিপের জন্য পিলার স্থাপনের।
প্রচলিত ভূমি জরিপে যেখানে ২০-২৫ বছর লাগে, সেখানে খুব অল্প সময়ে বাংলাদেশ ডিজিটাল জরিপ করা সম্ভব হবে। এই জরিপ শুরুর সাথে সাথে খসড়া ম্যাপ তৈরি করে ওয়েবসাইটে দেয়া হবে যাতে জমির মালিক পৃথিবীর যেকোনো স্থান থেকে তার জমির ম্যাপ দেখে জমির পরিমাণ কমবেশি হলে সাথে সাথে আপত্তি দাখিল করতে পারেন। ডিজিটাল জরিপে যাবতীয় তথ্য ডিজিটাল ও নির্ভুল হওয়ায়, জরিপে স্বচ্ছতা আসবে, মামলা মোকদ্দমা কমে আসবে, সাথে জনগণের ভোগান্তিও কমে আসবে। দলিল ও নামজারি করার সময় জালিয়াতি করে জমি আত্মসাৎ বন্ধ করা সম্ভব হবে।
প্রসঙ্গত, সারাদেশে ডিজিটাল জরিপকরণের সক্ষমতা অর্জনের জন্য সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ভূমি মন্ত্রণালয় ১২১২.৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ‘ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভ‚মি জরিপ করার জন্য ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের ডিজিটাল জরিপ পরিচালনার সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্প’ নামে ৫ বছর মেয়াদি প্রকল্পের মাধ্যমে এই জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। অপেক্ষাকৃত স্বল্প সময়ে, নির্ভুলভাবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভ‚মি জরিপ করার জন্য বাংলাদেশ ভূমি জরিপ তথা বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভেতে স্যাটেলাইট, ড্রোন তথা ইউএভি এবং গ্রাউন্ড কন্ট্রোল স্টেশনের সমন্বয়ে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।
এজন্য তিনটি পার্বত্য জেলা ব্যতীত সারাদেশের ৪৭০টি উপজেলার মৌজা পর্যায়ে জিওডেটিক সার্ভের মাধ্যমে ২,৬০,৩১০টি জিও-রেফারেন্সিং পয়েন্ট নির্ধারণ করা হবে ও ১,৩৩,১৮৮টি মৌজা ম্যাপের ডাটাবেজ ডাটাবেজ প্রস্তুত করা হবে।ভূমিতে পূর্বে জরিপ করা থাকলে উক্ত জরিপের ডিজিটাইজ ম্যাপের সাথে নতুন প্রস্তুত ম্যাপের সুপার ইম্পোজের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হবে নতুন জিও রেফারেন্স মৌজা ম্যাপ। এছাড়া পরবর্তীতে, ‘মৌজা ও প্লটভিত্তিক জাতীয় ডিজিটাল ভূমি জোনিং প্রকল্প’- থেকে সংগ্রহ করা স্যাটেলাইট ইমেজের সাথেও সমলয় করা হবে এই মৌজা ম্যাপ।